• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পয়লা মের শ্রমিক দিবস : পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ


ড. মো. আইনুল ইসলাম
প্রকাশিত: মে ১, ২০২৩, ০৯:১৯ এএম
পয়লা মের শ্রমিক দিবস : পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ

আমরা সবাই জানি, শ্রমিকের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও ন্যায্য দাবি আদায়ের এক ঐতিহাসিক দিন আজ পয়লা মে। ১৮৮৬ সালের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমের মর্যাদা, শ্রমের মূল্য এবং দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশের গুলিতে ৮ জন শ্রমিক নিহত হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর সরকার গঠনের পরপরই ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলওর সদস্যপদ লাভ করে। বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশে প্রথম শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্মত্যাগকারী শ্রমিকদের শ্রদ্ধা জানিয়ে ১ মে তারিখটিকে ‘জাতীয় শ্রমিক দিবস’ ঘোষণা করে সর্বস্তরে সরকারি ছুটির প্রচলন করেছিলেন। বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে এই একটি দিনই জরুরি সেবা ছাড়া রাষ্ট্রের আর সবকিছুই বন্ধ রাখা হয়। তবে যারা দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভর করে তাদের রুটি-রুজির সংস্থান করেন, তাদের কিন্তু এই দিনটিতেও শ্রম দিতে হয়।

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এবং ২০১৩ সালের সংশোধিত শ্রম আইন যুগোপযোগী ও আধুনিকায়ন করেছে। ২০১০ সালে হামিম গার্মেন্টসসহ তিনটি গার্মেন্টস কারখানায় দুর্ঘটনায় বিপুল  শ্রমিকের প্রাণ হারানো, ২০১২ সালে আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের গার্মেন্টস কারখানায় আগুন লেগে ১১১ জন শ্রমিকের পুড়ে মারা যাওয়া এবং ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ভবনধসের ঘটনায় ১২০০-এর বেশি পোশাক শ্রমিকের করুণ মৃত্যু ও হাজার হাজার শ্রমিকের আহত ও পঙ্গুত্ব বরণের হৃদয়বিদারক ঘটনার পর বাংলাদেশ সরকার শ্রমিকদের জন্য বেশকিছু আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন করেছে। 
যথা :

  • নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতের লক্ষ্যে ২০১৩ সালে জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি নীতিমালা করা হয়েছে।
  • ২০১৫ প্রণয়ন করা হয়েছে গৃহকর্মীদের বঞ্চনা ও নির্যাতন বন্ধের লক্ষ্যে গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণনীতি।
    ২০১৫ সালে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শ্রমবিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।
  • ২০১৭ সালে শুধু গার্মেন্টস শিল্পের জন্য আলাদা ত্রিপক্ষীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। শ্রমিকের যেকোনো সমস্যা ও অভিযোগ গ্রহণ, নিষ্পত্তি ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদানের জন্য সার্বক্ষণিক হেল্পলাইন ১৬৩৫৭ চালু করা হয়েছে।
  • শ্রমিকদের স্বার্থ যাতে বিঘ্নানিত হয়, সে জন্য সরকার প্রতিটি কারখানাকে পরিদর্শনের আওতায় আনার চেষ্টা করছে। কলকারখানা ও উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শনের জন্য শ্রম পরিদপ্তরকে অধিদপ্তরে উন্নীত করা হয়েছে। বাংলাদেশের ২ হাজার ২৬২টি কারখানায় সেফটি কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং যেকোনো বিরোধ নিষ্পত্তিতে সামাজিক সংলাপের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সব শিল্পখাতে শ্রমিক-মালিক-সরকার ত্রিপক্ষীয় কমিটি কাজ করছে।  
  • বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক শিল্পের লাখ লাখ্ষ শ্রমিকের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য গঠন করা হয়েছে বাংলাদেশ শ্রমিককল্যাণ ফাউন্ডেশন। দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যু হলে, কোনো শ্রমিক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে কিংবা তাদের ছেলেমেয়ের উচ্চশিক্ষা, নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন সহায়তা শ্রমিককল্যাণ তহবিল থেকে প্রদান করা হচ্ছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন শ্রমিককল্যাণ ফাউন্ডেশনের এই তহবিলের এফডিআর ফান্ডের প্রাপ্ত লভ্যাংশ থেকে এখন পর্যন্ত ৬ হাজার ৫০০ জনকে ৩৭ কোটি ৭ হাজার টাকার বেশি সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। এরপরও এফডিআরসহ এ তহবিলে জমা রয়েছে ৩২৮ কোটি টাকা।
  • ২০১৮ সালে বাংলাদেশ তার শ্রম আইন সংশোধন করে নতুন করে প্রণয়ন করেছে। 
  • শ্রমিকদের বেতন-ভাতা প্রদানে প্রযুক্তির ব্যবহার করা হচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ২০২৫ সালের মধ্যে সকল প্রকার শিশুশ্রম নিরসনে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ইতিমধ্যে ২৮৪ কোটি টাকার ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন প্রকল্পের (চতুর্থ পর্যায়) কাজ শুরু হয়েছে। 
  • যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের মানসনদে পরিবেশবান্ধব কারখানার তালিকায় সারা বিশ্বের শীর্ষ ১০ পরিবেশবান্ধব কারখানার ৮টিই বাংলাদেশের। লিড সার্টিফায়েড সবুজ কারখানার তালিকায় বিশ্বের সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব ১০০ কারখানার মধ্যে ৫০টিই এখন বাংলাদেশের। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে সবুজ কারখানার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮৭টিতে। 
  • এসব কারখানার এই খাতে বিনিয়োগ করে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশের উন্নতি ঘটানোর ফলে মালিকপক্ষের মুনাফার পরিমাণ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে শ্রমিকের উৎপাদিকা শক্তির বৃদ্ধির মাধ্যমে। এর অর্থ হচ্ছে, শ্রমিকদের জন্য মালিকপক্ষ ভালো কিছু করলে, তার মুনাফার পরিমাণও আগের চেয়ে বৃদ্ধি পাওয়া অনেকটাই নিশ্চিত হয়।

ওপরে উল্লেখ করা বিষয়গুলো বিবেচনায় বলা যায়, বাংলাদেশ শ্রমিকদের স্বার্থে অনেক কিছু করার চেষ্টা করছে। তারপরও বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য এখন আরও অনেক কিছু করা প্রয়োজন। অতীতে আমাদের শিল্প-কলকারখানায় দুর্ঘটনার প্রধান কারণ ছিল মালিক শ্রেণির গাফিলতি এবং অতিরিক্ত মুনাফার মানসিকতা, যা এখনও রয়ে গেছে—

  • আজকের এই উচ্চ দ্রব্যমূল্যের বাজারে অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকেরা তাদের ন্যায্য মজুরি পাচ্ছে না। যেখানে শ্রমিক আন্দোলন হয়েছিল ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের, সেখানে বাংলাদেশের অনেক মিলকারখানা ও গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে এখনও ৮ ঘণ্টার পরিবর্তে ১২ ঘণ্টা কাজ করানো হচ্ছে।
  • এবারের ২০২৩ সালের ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ১০ এপ্রিলের মধ্যে পোশাকসহ শিল্পখাতের শ্রমিকদের বোনাস ও বেতন-ভাতা পরিশোধের নির্দেশনা থাকলেও ১৭ এপ্রিল বিকেল ৫টা পর্যন্ত দেশের শিল্প অধ্যুষিত এলাকাগুলোর মাত্র ৪০ শতাংশ কারখানা শ্রমিকদের ঈদের বোনাস পরিশোধ করেছে। বেতন-ভাতা ও পুরোনো বকেয়া পাওনা পরিশোধের কার্যক্রমও এ সময় চলমান ছিল।
  • বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী মাসের প্রথম ১০ দিনের মধ্যে আগের মাসের বেতন পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা কখনই যথাযথভাবে পরিপালন হতে দেখা যায় না। ঈদের আগে শিল্পমালিকেরা সাধারণত ছুটির আগের দিন পর্যন্ত বেতন-ভাতা ও বোনাস পরিশোধ করেন। এ বছরের চিত্রটিও একই রকম ছিল। আমরা যেখানে ২০৫০ সালে ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছি, তখন এসব লক্ষণ মোটেও ভালো নয়। আমাদের এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
  • আজকাল প্রতিটি দেশের সরকার আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ন্যূনতম মজুরি ও ওভারটাইম প্রিমিয়াম, মজুরির পরিমাণ নির্ধারণ পদ্ধতি, প্রদানের সময় ও পদ্ধতি প্রভৃতি বিষয় নির্ধারণ করে থাকে। শ্রমিকেরা আন্দোলন করে যে মজুরি নিশ্চিত করতে পারে না, সরকারের হস্তক্ষেপে তা সহজে সম্ভব হয়। সে কারণে ধনী ও উন্নত দেশসহ বিভিন্ন দেশের সরকারকে এখনো এসব ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে দেখা যায়।

১৮৪০ সালে ইউরোপের প্রথম শিল্পবিপ্লবের পর যুগের পরিক্রমায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের হাত ধরে আমরা এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছি। এখন রক্ত-মাংসের মানুষের শ্রমিকের জায়গাটি স্ক্রু আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর রোবট দখল করে নিচ্ছে। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ইউরোপে ১৮৪০ সালের প্রথম শিল্প বিপ্লবের ৪৬ বছর পর ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমের মর্যাদা, শ্রমের মূল্য এবং দৈনিক কর্মঘণ্টা প্রতিষ্ঠার দাবিতে রক্তাত্ত আন্দোলন হয়েছিল। এর অর্থ হচ্ছে, শিল্প বিপ্লবের সুফল শ্রমিকেরা পাননি। এর কারণ হচ্ছে মূলত, মালিকদের ক্রমবর্ধমান পুঁজি ও মুনাফা অর্জনের মানসিকতা। পুঁজি ও শ্রমের এই বিরোধের একমাত্র সমাধান হলো‒ব্যক্তিগত পুঁজির মালিকদের হাত থেকে উৎপাদনের উপায়সমূহের অর্থাৎ কলকারখানা, যন্ত্রপাতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষিজমি, অ-কৃষিজমি, যোগাযোগ-পরিবহন, ব্রিজ-হাইওয়ে, বন্দর, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানা শেষপর্যন্ত ‘প্রত্যক্ষ উৎপাদক’ বা শ্রমিকদের হাতে হস্তান্তরিত হওয়া। কিন্তু আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় এই হস্তান্তরপ্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা যেহেতু সম্ভব না, সেহেতু শ্রমিক ও মালিকদের মধ্যে সুম্পর্ক ও পারস্পরিক চাওয়া-পাওয়াকে মূল্য দেওয়াই সবচেয়ে ভালো পন্থা। এতে করে দুই পক্ষেরই লাভ। 

বাংলাদেশে এখন শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক উন্নয়ন করা সবচেয়ে জরুরি। কারণ, বর্তমানে দেশে তরুণের সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি, যা মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশের বেশি। আগামী ৩০ বছর তরুণ বা উৎপাদনশীল জনগোষ্ঠীই বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকবে। বিশ্বের খুব কমসংখ্যক দেশের এ ধরনের ভাগ্য হয়। বাংলাদেশের জন্য চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল ভোগ করার এটাই সব থেকে বড় হাতিয়ার। জ্ঞানভিত্তিক এই শিল্পবিপ্লবে প্রাকৃতিক সম্পদের চেয়ে দক্ষ মানবসম্পদ বা শ্রমিকই হবে সবচেয়ে বেশি মূল্যবান। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে বিপুল পরিমাণ মানুষ চাকরি হারালেও এর বিপরীতে সৃষ্টি হবে নতুন ধারার নানাবিধ কর্মক্ষেত্র। নতুন যুগের এসব চাকরির জন্য প্রয়োজন উচ্চস্তরের কারিগরি দক্ষতা। ডেটা সায়েন্টিস্ট, আইওটি এক্সপার্ট, রোবটিকস ইঞ্জিনিয়ারের মতো আগামী দিনের চাকরিগুলোর জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী তরুণ জনগোষ্ঠী।

  • অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা দেখা গেছে, আগামী দুই দশকের মধ্যে মানবজাতির ৪৭ শতাংশ কাজ স্বয়ংক্রিয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্রের মাধ্যমে হবে। 
  • বিশ্বের ম্যানুফেকচারিং খাতে বর্তমানে ২০ লক্ষ রোবট কাজ করছে, যা পরিচালনা করছে মাত্র হাজেরখানেক রক্ত-মাংসের মানুষ।
  • চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে শ্রমনির্ভর এবং অপেক্ষাকৃত কম দক্ষতানির্ভর চাকরি বিলুপ্ত হলেও উচ্চ দক্ষতানির্ভর যে নতুন কর্মবাজার সৃষ্টি হবে, তার জন্য আমাদের তরুণ প্রজন্মকে প্রস্তুত করে তোলার এখনই সেরা সময়। দক্ষ শ্রমিকশক্তি তৈরি করা সম্ভব হলে জনমিতিক লভ্যাংশকে কাজে লাগিয়ে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল ভোগ করতে পারলে বাংলাদেশের অবস্থা আমূল বদলে যাবে। 
  • এখন পৃথিবীর দ্বিতীয় শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ জাপানের অর্থনৈতিক অবস্থা পড়তির দিকে। কিছুদিনের মধ্যেই অন্য কয়েকটি দেশ জাপানের স্থান দখল করে নেবে। এর মূল কারণ হচ্ছে, জাপানের কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমে যাওয়া এবং বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি। 
  • ২০৬০ সালের দিকে বাংলাদেশও এই একই পরিস্থিতিতে পড়বে, যখন বৃদ্ধ নাগরিকেরাই থাকবেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। 
  • কাজেই বাংলাদেশের সুবিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করতে হলে শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা ও কর্মদক্ষতা জরুরি ভিত্তিতে যুগোপযোগী করতে হবে। 
  • দুর্ভাগ্যের বিষয়, শিল্পকারখানায় কী ধরনের জ্ঞান ও দক্ষতা লাগবে, সে বিষয়ে আমাদের শিক্ষাক্রমের তেমন সমন্বয় নেই। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আত্মস্থ করতে হলে শিক্ষাব্যবস্থাকেও ঢেলে সাজাতে হবে। 
  • প্রাথমিক পাঠ্যক্রম থেকেই তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। 
  • শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে দক্ষতার বিষয়গুলো শিক্ষার্থীর মধ্যে সঞ্চারিত হয় এবং এই কাজটি করতে হবে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে। 
  • একই ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে উচ্চশিক্ষা স্তরেও। 
  • প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য টিচিং অ্যান্ড লার্নিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের গ্র্যাজুয়েট তৈরির জন্য স্কিল বিষয়ে নিজেরা প্রশিক্ষিত হবেন। শিক্ষার্থীদের প্রচলিত প্রশ্নোত্তর থেকে বের করে এনে তাদের কেসস্টাডি, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রজেক্ট ইত্যাদির মাধ্যমে মূল বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত করবেন। শিক্ষার্থীদের প্রকাশযোগ্যতা, দলীয় কাজে দক্ষতা তৈরির জন্য ওইসব কেসস্টাডি, অ্যাসাইনমেন্ট কিংবা প্রজেক্টের উপস্থাপনাকে করতে হবে বাধ্যতামূলক এবং সেটি শুধু নিজ নিজ শ্রেণিকক্ষে সীমাবদ্ধ  না রেখে ছড়িয়ে দিতে হবে নানা অঙ্গনে। 
  • উচ্চশিক্ষার সর্বস্তরে শিল্পের সঙ্গে শিক্ষার্থীর সংযোগ বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে শিক্ষানবিশ কার্যক্রম বাধ্যতামূলক করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের ডিগ্রি অর্জনের পাশাপাশি বাস্তব জীবনের কার্যক্রম সম্পর্ক হাতে-কলমে শিখতে পারে। 
  • সারাদেশে আরও সাশ্রয়ী মূল্যে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করতে হবে। 
  • সরকারি-বেসরকারি অফিসের ফাইল-নথিপত্র ডিজিটাল ডকুমেন্টে রূপান্তরিত করতে হবে। অর্থাৎ পেপারলেস প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। 
  • কেবল পরিকল্পনার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের শ্রমিকদেরও সম্পদ হিসেব প্রস্তুত করতে হবে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, আইওটি, ব্লকচেইন এসব প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে। এসব প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, পণ্য সরবরাহ, চিকিৎসা, শিল্পকারখানা, ব্যাংকিং, কৃষি, শিক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে কাজ করার পরিধি তাই ব্যাপকভাবে উন্মুক্ত।
  • সত্যিকার অর্থে, যেহেতু তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের সুফলই আমরা সবার কাছে পৌঁছাতে পারিনি, চতুর্থ বিপ্লবের সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য আমাদের প্রস্তুতি কতটুকু, তা আরও গভীরভাবে ভাবতে হবে। 
  • শুধু দক্ষ শ্রমিকগোষ্ঠী নেই বলে আমাদের পোশাক শিল্পের প্রযুক্তিগত খাতে কম-বেশি ৩ লাখ বিদেশি নাগরিক কাজ করেন, যারা বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশের ১ কোটি শ্রমিক বার্ষিক যে পরিমাণ রেমিটেন্স দেশে পাঠান, তার প্রায় অর্ধেকই বাংলাদেশের পোশাক শিল্প খাত থেকে বেতনভাতা তুলে নিয়ে যান। 
  • শুধু শিক্ষিত নয়, দেশে দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
  • শুধু দেশেই নয়, যারা বিদেশে কাজ করছেন, তাদেরও যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে পাঠাতে হবে। বিদেশে আমাদের ১ কোটি শ্রমিক আয় করেন ১৫ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ভারতের ১ কোটি ৩০ লাখ শ্রমিক আয় করেন ৬৮ বিলিয়ন ডলার। কর্মক্ষেত্রে আমাদের শ্রমিকদের অদক্ষতাই তাদের আয়ের ক্ষেত্রে এ বিরাট ব্যবধানের কারণ। সংগত কারণেই আমাদের উচিত, কারিগরি দক্ষতার ওপর আরও জোর দেওয়া। 

আশার কথা হলো এই যে, বর্তমান সরকার শ্রমিকদের কল্যাণসাধন করে এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সুফল ঘরে তুলতে সাধ্যমতো চেষ্টা করছে। সরকার শিল্পবিপ্লবের ভিত্তি হিসেবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে শিল্পের বিকাশ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীবাহিনী তৈরি করা এবং পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। এসব অর্জন করতে হলে সরকারি-বেসরকারিসহ আমাদের সবার যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, একটি সমৃদ্ধ ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থানির্ভর বাংলাদেশ গঠন করতে হলে আমাদের অতীতের অনেক পশ্চাৎপদ ধ্যান-ধারণা ও স্বার্থপর মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। কেননা, সমাজে একা ভালো থাকার চেষ্টা, মানব ইতিহাসে কখনোই সাফল্য পায়নি।

লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশে অর্থনীতি সমিতি।

 

Link copied!