২৫ জুন বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক অবিস্মরণীয় স্টেশন। যতই দ্রুতগতির এক্সপ্রেসের মতো ছুটে চলুক বাংলাদেশ ক্রিকেট, এই স্টেশনে একটু নামতে মন চাইবে দেশের ক্রিকেটানুরাগীদের। আর ক্রিকেট ইতিহাস নিয়ে যাদের চর্চা একটু বেশি, তাদের কাছে ২৫ জুন আরও একটা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। সেটা শুধু বাংলাদেশ ক্রিকেটের কারণে নয়, বিশ্ব ক্রিকেটের আর্থিক রেখাচিত্র পাল্টে যাওয়ার সূচনালগ্ন হিসেবে।
আজ থেকে ২৩ বছর আগে এই ২৫ জুন বাংলাদেশ পেয়েছিল টেস্ট স্ট্যাটাস। সেটা ক্রিকেটের তীর্থভূমি লর্ডসে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলের সভায়। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পরই পাল্টে যেতে থাকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের চেহারা। তার আগে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার প্রায় অসম্ভব এক স্বপ্ন নিয়ে দৌড়াচ্ছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কর্তারা! টেস্ট স্ট্যাটাস পাবে তো বাংলাদেশ! এ রকম এক প্রশ্নের দোলাচলে গোটা দেশের মানুষ! যাদের নিজস্ব একটা ক্রিকেট মাঠ ছিল না, যাদের ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট তখনো ন্যাপকিন পরা বয়সে তাদের টেস্ট প্লেয়িং কান্ট্রির মর্যাদা দেবে তো আইসিসি?
‘দেবে। আমরা জানি আমাদের সীমাবদ্ধতা কোথায়। ক্রিকেট কূটনীতি দিয়ে সেই দুর্বলতাকে কাটিয়ে উঠব আমরা।’ আইসিসির সভায় যোগ দিতে যাওয়ার আগে মিডিয়াকে বলে গিয়েছিলেন সেই সময়ের বোর্ড সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী। ক্রিকেট কূটনীতি কী, সেটা সবচেয়ে ভালো জানা যার, সেই সৈয়দ আশরাফুল হক অবশ্য আইসিসির মিটিংয়ে দুই-তৃতীয়াংশ ভোট আগেই নিশ্চিত করে ফেলেছিলেন। তার জন্য তাকে বড় একটা ব্ল্যাঙ্ক চেক দিয়ে রেখেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে। বিসিবির এই সাবেক পরিচালক এবং সাধারণ সম্পাদক এক দিন তার তেজগাঁওয়ের বাড়িতে বসে বলছিলেন, ‘আমাদের ভাগ্য ভালো ছিল ও রকম একজন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছিলাম। কাদের সাহেবের মতো একজন ছিলেন ক্রীড়ামন্ত্রী। আমি শ্রীলঙ্কার বোর্ড সভাপতিকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী নিজে তাকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়েছিলেন! লংকান বোর্ড সভাপতি রীতিমতো বিস্মিত! এত আন্তরিক হতে পারেন প্রধানমন্ত্রী! এরপর আপা বলেছিলেন, যা কিছু করতে হয় করব। টেস্ট স্ট্যাটাস আমাদের পেতেই হবে।চেষ্টা করে যাও।’
সরকার। ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তা। সাধারণ মানুষ। প্রবাসীরা। গণমাধ্যম সবাই সবার জায়গা থেকে কাজ করেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটের এই চেহারা বদলের দিনটার জন্য।বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় জড়িয়ে থাকার রেকর্ড যার সেই বোর্ড পরিচালক আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি স্মৃতি তিয়াসি হয়ে কাল এক কফি শপে বসে বললেন, ‘কত হোম ওয়ার্ক করতে হয়েছিল আমাদের সে সময়! একেক সময় একেক ধরনের প্রেজেন্টেশন! রাত নেই, দিন নেই। একটামাত্র কম্পিউটারে বসে কাজ করতে হয়েছে! এখন ভাবলে অবিশ্বাস্য মনে হয়! মিটিংয়ের দিন আমরা ঢাকা থেকে ফোন করে লন্ডনপ্রবাসীদের লর্ডসের গেটে জড়ো হতে বলেছিলাম। তারা এক ধাপ এগিয়ে সেখানে গিয়ে স্লোগান দিতে শুরু করে টেস্ট স্ট্যাটাস দিতে হবে দিতে হবে! কী আবেগ আমাদের ক্রিকেট নিয়ে!
পাশে বসে থাকা বাংলাদেশ দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল আরও নস্টালজিক হয়ে পড়লেন। স্মৃতির ঝাঁপি খুললেন। ‘আমি তখন ইংল্যান্ডে। পোর্ট মাউথে। আমাকেও আনা হলো লর্ডসে।’ স্মৃতিকাতর হয়ে কৃতজ্ঞতা জানালেন বাংলাদেশে বেসরকারি টেলিভিশন জগতে পরিবর্তনের ঢেউ তুলে দেওয়া অন্যতম পুরোধা অকালপ্রয়াত মিশুক মুনীরের প্রতি। বেসরকারি টেলিভিশন একুশে টিভির পক্ষ থেকে আইসিসির ওই মিটিং কাভার করতে গিয়েছিলেন সুপন রায়। তার অপারেশনের দায়িত্বে ছিলেন মিশুক মুনীর! সুপন স্পোর্টস কাভার করতেন না। কিন্তু লাইভ ভালো করবেন সে কারণেই তাকে নিয়ে যাওয়া। সুপন লাইভের মধ্যেই নাকি বলে ফেললেন, ‘ভুল হয়ে গেল!’ শুনেই মিশুক মুনীর রেগে ফায়ার। তারপর আমার ইন্টারভিউ করতে বললেন। মিশুক সাহেব নিজেই ক্যামেরা অপারেট করলেন। সেই গণমাধ্যমের ভূমিকা আজ আমরা কজন মনে রেখেছি? প্রশ্ন বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টের সেঞ্চুরিয়ানের।
বাংলাদেশ ক্রিকেট যে আজ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পায়, তার ভিত তো ওই টেস্ট স্ট্যাটাস প্র্যাপ্তি। আসলে আজ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড যে বিশ্বের অন্যতম বিত্তশালী বোর্ডে রূপ নিয়েছে, তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ২০০০ সালের ২৫ জুন লর্ডসে।
কাকতালীয়ভাবে ৪০ বছর আগে সেই লর্ডসে ভারত জিতেছিল বিশ্বকাপ। ক্রিকেট বিশ্ব আর্থিকভাবে যে জায়গায়, তার পেছনে কপিল দেবের ভারতের বিশ্বকাপ জয়। ওই বিশ্বকাপ জয়ের পর ভারত-পাকিস্তান যৌথভাবে বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পায়। ইংল্যান্ডের মাটি থেকে বিশ্বকাপকে বের করে আনা হয়। দেশের খেলা দেখাতে সে সময় ভারতীয় বোর্ড টাকা দিতে বাধ্য হতো দূরদর্শনকে। কিন্তু জগমোহন ডালমিয়ার সৌজন্যে আজ ক্রিকেট ম্যাচ সম্প্রচার করতে বিভিন্ন চ্যানেলকে ব্ল্যাঙ্ক চেক নিয়ে ঘুরতে হয় বিভিন্ন বোর্ডের দরজায়। বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোও বুঝতে পারল ক্লায়েন্ট ধরে রাখতে ক্রিকেট বড় মাধ্যম।
আসলে ভারতের ’৮৩-এর বিশ্বকাপ জয় দমকা হাওয়ার মতো খুলে দেয় ক্রিকেটের বড় বাজার। আর বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর খুলে যায় বাংলাদেশের ক্রিকেট আর ক্রিকেটারদের জন্য বিজ্ঞাপনের বাজার। সেই বাজারে পৌঁছানোর জন্য বাংলাদেশের কুপন নম্বর ‘২৫’! কিন্তু আমরা কি তাদের মনে রাখি, যারা খেলেছিলেন সে সময় ক্রিকেটকে ভালোবেসে? যারা ক্রিকেটকে ভালোবাসতে গিয়ে জীবন যৌবনের অনেক কিছু ফেলে এসেছেন মাঠে। যাদের পরিশ্রম আর মেধায় আমাদের টেস্ট স্ট্যাটাস আমরা কি তাদের প্রতি একটু কৃতজ্ঞতা, সৌজন্যতা দেখাতে পারছি!
আর্থিকভাবে আমরা ধনী হয়েছি। ক্রিকেটীয় পারফরম্যান্সে সম্মৃদ্ধ হচ্ছি। কিন্তু ক্রিকেট কালচার গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছি! ২৫ আমাদের ক্রিকেটের জন্য এক আলো ছড়ান দিন। সেই দিনটাকে আমরা ভুলে গেলে আমাদের ক্রিকেটের শিকড়ে সারপানির অভাব দেখা দেবে।