জাতীয় সংসদের ২২৯, সিলেট-১ আসনটিকে বলা হয় ‘মর্যাদাপূর্ণ’ এবং ‘নির্ধারণী আসন’। এই আসন থেকে যে দলের প্রার্থী জিতেছে, তারাই গঠন করেছে সরকার। দেশ স্বাধীনের পর প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত এর ব্যত্যয় হয়নি। এরশাদ পতনের পর দেশ সংসদীয় গণতন্ত্রের দিকে ফেরার পরেও এই ধারা বহাল আছে। দেখা যায়, পুরো সিলেট বিভাগের অন্য আসনগুলোর ফলাফল যা-ই হোক না কেন, সিলেট-১ আসনের নির্বাচিত সংসদ সদস্যই সরকারি দলের।
এই আসন থেকে নির্বাচিতদের মধ্যে বিএনপি নেতা খন্দকার আব্দুল মালিক বাদে বাকি সবাই সংসদ ও সরকারের মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন-করছেন। এম সাইফুর রহমান, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, আবুল মাল আবদুল মুহিত, এ কে আব্দুল মোমেন হয়েছেন মন্ত্রী। এম সাইফুর রহমান বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী স্পিকার, আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী এবং তার ভাই এ কে আব্দুল মোমেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন।
খন্দকার আব্দুল মালিক ব্যবসায়ী হলেও সিলেট বিএনপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। এম সাইফুর রহমানের বাড়ি মৌলভীবাজার, তবে তিনি ‘অতিথি প্রার্থী’ হিসেবে সিলেট-১ আসনে বিএনপির মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সাইফুর রহমানকে দিয়ে সিলেট-১ আসনে ‘অতিথি প্রার্থী’ মনোনয়নের যে ধারা শুরু হয়েছে, সেটা এখনো চলছে। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এরশাদ সরকারের আমলের সংসদ সদস্য ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। আবুল মাল আবদুল মুহিতও ছিলেন এরশাদ সরকারের আমলের অর্থমন্ত্রী ছিলেন, যদিও তিনি এরশাদের ‘নীতির সঙ্গে একমত না হয়ে’ পদত্যাগ করেছিলেন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ও আবুল মাল আবদুল মুহিত দুজনই ছিলেন মূলত আওয়ামী লীগের ‘অতিথি’। তাদের পথ ধরেই কিনা এ কে আব্দুল মোমেনের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ এবং সংসদ সদস্য নির্বাচন ও মন্ত্রী হওয়া, যদিও বড় ভাই মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকাকালে ছোট ভাই মোমেন ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায়’ সিলেটের রাজনীতিতে সক্রিয় হতে শুরু করেছিলেন। অর্থাৎ সিলেটের স্থানীয় রাজনীতি না করেই এম সাইফুর রহমান থেকে শুরু করে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, আবুল মাল আবদুল মুহিত ও এ কে আব্দুল মোমেনেরা সিলেটের গুরুত্বপূর্ণ এই আসনের জনপ্রতিনিধি হয়েছেন।
আগামী বছরের শুরুর দিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এই নির্বাচনে এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রার্থিতার দৌড়ে যাদের নাম এখন পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হুসেইন, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদ ছেড়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হওয়া ইনাম আহমেদ চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজসহ আরও কয়েকজন। এঁদের মধ্যে সম্ভাবনায় পিছিয়ে থাকা মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ ছাড়া আর কেউই দলটির স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। অর্থাৎ আগামী দিনগুলোতেও সিলেট-১ আসনের আওয়ামী লীগের মনোনয়ন কোনো ‘অতিথি প্রার্থীর’ দিকেই ঝুঁকছে!
জাতীয় সংসদের সিলেট-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে যেখানে স্থানীয়দের ‘উপেক্ষা’ করে ‘অতিথি’ প্রার্থীরা প্রাধান্য পাচ্ছিলেন সেখানে ব্যতিক্রম ছিল সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন। ২০০২ সালে সিলেট সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পর এখন পর্যন্ত নির্বাচন হয়েছে চারবার। বিগত প্রতিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। দুইবার তিনি মেয়র নির্বাচিত হন, এবং পরাজিত হন দুইবার। ২০১৩ ও ২০১৭ সালের সিটি নির্বাচনে তিনি বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে পরাজিত হন। এরপর তিনি ২০২০ সালের ১৫ জুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী জুন-জুলাইয়ে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কামরানের অবর্তমানে সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন-লড়াই এত দিন স্থানীয় কয়েকজন নেতার মধ্যে আবর্তিত হচ্ছিল। যাদের মধ্যে আছেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমদ, সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন, যুগ্ম সম্পাদক এ টি এম এ হাসান ও আজাদুর রহমান আজাদ, সাংগঠনিক সম্পাদক আরমান আহমদ শিপলু ও সদস্য প্রিন্স সদরুজ্জামান চৌধুরী। তবে হঠাৎই বদলে গেছে দৃশ্যপট। গত দুই সপ্তাহ ধরে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী নামে এক যুক্তরাজ্য প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা সিলেটে এসে দাবি করছেন তিনি নাকি দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘গ্রিন সিগন্যাল’ পেয়েছেন।
আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর অনুসারীদের এই দাবির পর সারা সিলেট ছেয়ে গেছে ব্যানার-পোস্টার-ফেস্টুনে। ‘আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে মেয়র পদে দেখতে চাই’ দাবিসংবলিত প্রচারণা-উপকরণের সঙ্গে মধ্যম সারির নেতা-কর্মীদের ছবিও শোভা পাচ্ছে সেসব জায়গায়। প্রচারণার এই পন্থার বাইরে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী প্রতিদিন নগরের বিভিন্ন জায়গায় গণসংযোগ করছেন। এই গণসংযোগে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক সাংগঠনিক সম্পাদকও থাকছেন প্রায়ই। ময়মনসিংহ বিভাগের দায়িত্বে থাকা সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল সরাসরি আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে সমর্থন দিচ্ছেন। সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) আনোয়ারুজ্জামানের পক্ষ থেকে শীতবস্ত্র বিতরণের একটি অনুষ্ঠানে শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল বলেছেন, ‘জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আমরা আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে আছি। সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাকে নৌকার কান্ডারি করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী।’
ময়মনসিংহ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা নাদেলের সিলেটের স্থানীয় রাজনীতি নিয়ে মন্তব্যের পর নড়েচড়ে বসেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। মঙ্গলবার (৭ ফেব্রুয়ারি) সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘সোমবার সিটি করপোরেশনের কোনো একটি ওয়ার্ডে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ময়মনসিংহ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক সিলেট সিটি মেয়র নির্বাচনের মনোনয়ন প্রসঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি জননেত্রী শেখ হাসিনার বরাত দিয়ে যে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন, তা মহানগর আওয়ামী লীগের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য হলো: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছ থেকে এ-সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে আমরা পাইনি। অতএব ঐতিহ্যবাহী সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সিলেট মহানগরের শৃঙ্খলাসহ দলীয় ভাবমূর্তি যাতে বিনষ্ট না হয় এবং বিভ্রান্তি যাতে না ছড়ানো হয় সংশ্লিষ্টদের প্রতি এ বিষয়ে আহ্বান জানানো যাচ্ছে।’
সিলেটের স্থানীয় আওয়ামী লীগ বলছে সিটি নির্বাচন নিয়ে তারা কোনো নির্দেশনা পায়নি, আবার যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর অনুসারীরা বলছেন, তিনি হাইকমান্ডের নির্দেশনা পেয়েছেন। এটা নিয়েই এখন বিভক্ত স্থানীয় আওয়ামী লীগ। একদিকে স্থানীয় নেতাদের অন্তত সাতজন মনোনয়নপ্রত্যাশী, অন্যদিকে প্রবাসী এই মনোনয়নপ্রত্যাশীর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মধ্যে আছেন কেবল শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল ও সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিব। এমন অবস্থায় আসছে নির্বাচনেও মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে দলীয় কোন্দল! এদিকে, অন্য সব স্থানীয় নির্বাচনের মতো সিলেট সিটি নির্বাচনও বিএনপি বর্জন করলে এই নির্বাচন উন্মুক্ত হয়ে যেতে পারে। আর যদি বিএনপি এখানে অংশ নেয় তবে ধারণা করা হচ্ছে বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীই দলটির মনোনয়ন পেতে পারেন। আরিফুল হক চৌধুরী বিএনপির, এমনকি স্বতন্ত্র হিসেবে প্রার্থী থাকলে ভোটের লড়াইয়ে অন্তর্দ্বন্দ্বে থাকা আওয়ামী লীগ কতখানি সুবিধা করতে পারবে, সেটাই দেখার বিষয়!
জাতীয় সংসদের সিলেট-১ আসন, স্থানীয় সরকারের সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যদি এভাবে ‘অতিথি প্রার্থী’ ও ‘প্রবাসী প্রার্থীর’ দিকে ঝুঁকে আওয়ামী লীগ তাহলে স্থানীয় নেতাদের কী ভবিষ্যৎ—এমনই খেদ অনেকের। তাদের আক্ষেপ বেশির ভাগ সময় প্রকাশ্য হয় না ঠিক, তবে এটা পোড়ায় অনেককেই। সিলেট আওয়ামী লীগ কি তবে স্থানীয় রাজনীতিসংশ্লিষ্ট কাউকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে পাবে না—প্রশ্ন যাদের তারাও জানে এই প্রশ্নের উত্তর নেই, এমনকি প্রশ্ন করার সুযোগও খুব একটা নেই!
লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক