• ঢাকা
  • সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

রাজনীতিতে মিছিল-সমাবেশের পাশাপাশি সহমর্মিতাও থাকুক


আফরিদা ইফরাত
প্রকাশিত: জুলাই ৩১, ২০২৩, ১০:২৮ এএম
রাজনীতিতে মিছিল-সমাবেশের পাশাপাশি সহমর্মিতাও থাকুক

গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। কথাটির ব্যাপ্তি বোঝা প্রয়োজন। প্রথমেই একটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি। চট্টগ্রামে ৩০ জুলাই একটি উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। অনেকটা নিরানন্দে ও প্রচারের মুখ না দেখেই নির্বাচন হয়ে গেল। ১২ জুলাই সম্ভবত গত ২০ বছরে এই প্রথম একটি শান্তিপূর্ণ দৃশ্য দেখা গেল। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল সংঘাত এড়িয়েই তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেছিল।

বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা বাদ দিয়েই একটি সংঘাতমুক্ত রাজনৈতিক কর্মসূচি দেখা গেছে। এরপর দুই দলের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘোষিত হয়। এ সময় এই প্রথম বিরোধী দল বিএনপি বা তাদের সমমনা দলের জনপ্রিয়তা ও কর্মতৎপরতা চোখে পড়ার মতো। দুটি দলের ক্ষেত্রেই কথা একটি, তারা যেন তাদের অধিকারের ভোট দিতে পারে। দুটি দলের ক্ষেত্রেই দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। একটি দল দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে আসবে না এবং অপর দল মনে করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রশ্নই আসে না। দাবি আদায়ের মঞ্চে দুই দলই তাদের অবস্থান শক্ত রাখে। দেশের প্রধান বিরোধী দল এক মাসের ভেতরে গুরুত্বপূর্ণ কিছু রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়েছে। এসব রাজনৈতিক কর্মসূচি তাদের সমর্থন ও সক্ষমতার বিষয়টি সামনে এনেছে। কিন্তু প্রথম থেকেই অনেকের আশঙ্কা ছিল রাজনীতি কি সহিংসতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কি-না।

বিষয়টি সেদিকেই এগিয়ে গিয়েছে। বিএনপি তাদের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ ঘোষণা দিলেও আস্তে আস্তে তাদের অবরোধমূলক কর্মসূচির দিকে এগিয়ে যেতে হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে হলেও তাদের এই কর্মসূচি নিতে হয়েছে। সমস্যা হলো, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের প্রক্রিয়া যেভাবে এগিয়ে চলে, অবরোধমূলক কর্মসূচি সেভাবে চলে না। উল্টো তা জনগণের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পথঘাটে সহিংসতা এবং সংঘর্ষের পরিস্থিতি কারোই কাম্য নয়। কিন্তু যেমনটা বলেছি, দুই দলের দৃষ্টিভঙ্গি দুইরকম। তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার প্রক্রিয়াও আলাদা।

গত ১২ জুলাই ঢাকায় বড় দুই দলের কর্মসূচি ছিল। সংবাদমাধ্যমে ওই কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ হিসেবে বিশ্লেষিত হলেও দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে সংঘাতের ঘটনা ঘটে। তবে বড় কোনো সংঘাত ছাড়াই কর্মসূচি সম্পন্ন হয়; এ সত্য এড়ানোর অবকাশ নেই। তখন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিনিধিদল দেশে অবস্থান করছিল। ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি দলও। তারা তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে নিজেদের সন্তোষের কথা জানান। আজকে আবারও রাজধানীতে দেশের প্রধান দুটি দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি রয়েছে। পাল্টাপাল্টি এ কর্মসূচি ঘিরে সাধারণের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে, রয়েছে উৎকণ্ঠাও।

অনেকেই আশঙ্কা করছেন, উভয় দলের বড় জমায়েত থেকে পরিস্থিতি ‘রণক্ষেত্রে’ রূপ নিতে পারে। তবে তা হয়নি। রাজনীতি যেহেতু জনকল্যাণের জন্য এবং জনগণকে সামনে রেখেই রাজনীতি, তাই স্বাভাবিকভাবেই আমাদের প্রত্যাশা তাই। নির্বাচনব্যবস্থা কিংবা প্রক্রিয়া নিয়ে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের মুখোমুখি অবস্থান, আলোচনার টেবিলের চেয়ে মাঠের রাজনীতির গুরুত্ব বাড়ানো, তা নিয়েই মূলত সাধারণ মানুষের শঙ্কা। কারণ, মানুষ সংঘাত চায় না। তারা চায় না, তাদের শান্তিপূর্ণ নাগরিক জীবনে অশান্তির হাওয়া প্রবেশ করুক। তাদের কর্মব্যস্ত দিনের কর্মঘণ্টা নষ্ট হোক। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সাধারণের সঙ্গতই প্রত্যাশা, রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমে যেন প্রকৃতার্থেই জনগণের কল্যাণ হয় তেমন কিছুর।

রাজনৈতিক সংকট আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। আমাদের ইতিহাসে সেই সংকট ঘনীভূত হয়নি এত দিন কারণ প্রধান বিরোধী দল বলে অনেকের দাবি সেই বিএনপি কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেনি। কিন্তু তারা শান্তিপূর্ণ সমাবেশের মাধ্যমে জনগণের কাছেই রাজনীতিকে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু রাজনীতি যখন সহিংসতার দিকে যায় তখন তা জনগণকেও বিমুখ করে। এখানে বিদেশিরাও নানা মন্তব্য করছে। আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর সংকট আমাদেরই করতে হবে। বাংলাদেশের ইতিহাসও সেভাবেই। আমাদের সমস্যা আমাদের কাছেই থাকবে। এ কথা সত্য বিদেশিরা বিভিন্ন সময়ে কথা বলে। কিন্তু তাদের কথা বলার সুযোগ কোথায়?

বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে গেছে। বিদেশি বিনিয়োগ আসছে। তাই বিনিয়োগের বিষয়টি ভেবে তারা এখানের রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা জানাতেই পারে। তবে তারা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলতে পারে না। তবে তারা কোন আঙ্গিকে বলছে, তা আমাদের জানতে হবে। গণতন্ত্র মানবাধিকারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে। সেসব নিয়ে আলোচনা হতে পারে। যে কেউ বিশ্বায়নের যুগে এসব নিয়ে আলোচনা করতে পারে। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে আমরাও যেহেতু আন্তর্জাতিক যুক্তিতে স্বাক্ষর করেছি তাই এসব বিষয়ে মতামত আসতেই পারে। তবে সংকটের সমাধান আমাদেরই করতে হবে।

রাজনীতিতে পাল্টাপাল্টি এই সংঘর্ষের আলোচনাতেই মূল আলোচনায় আসতে হয়। ৩০ জুলাই চট্টগ্রাম নগরে একটি উপনির্বাচন হয়েছে। অনেকটা প্রচার ছাড়াই নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হলো। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় একজন নাগরিক ভোট দেবেন এবং জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করবে সেভাবেই তারা রাষ্ট্র কার্যক্রম পরিচালনার দায়ভার দিয়ে থাকেন। ভোটাধিকারও তাই একধরনের মানবাধিকার। গণতান্ত্রিক চর্চার রাষ্ট্রে তাই কিছু প্রতিষ্ঠান থাকে। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তাদের দেশে অবশ্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান থাকায় বিতর্ক থাকে না। নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়। এমন অনেক দেশেরই ক্ষেত্রে উদাহরণ টানা যায়। আমাদের এখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হয়নি। ফলে রাজনৈতিক দলের মধ্যে আস্থা নেই। যদিও আমরা দেখতে পেয়েছি, ২৯ জুলাই সংঘর্ষের পর বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমানের কাছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খাবারসহ প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছেন। তার স্বাস্থ্যের খবর নিয়েছেন। এ রকম পরিবেশ সংঘাত ছাড়া আলোচনার মঞ্চ গড়ে দিলে রাজনৈতিক দলের আস্থা গঠনে সাহায্য করে। যেহেতু আমরা এখনো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়তে পারিনি, তাই বিষয়গুলো এভাবেই সমাধান করতে হবে। অন্তত ফল পাঠানো আর সংঘর্ষের পর খোঁজ নেওয়ার এই সংস্কৃতি আলোচনার পথ সুগম রাখার ইঙ্গিত কিছুটা হলেও দেয়। তবে রাজনৈতিক দলের মধ্যে তো আস্থা নেই।

এই মুহূর্তে আমাদের একমাত্র উপায় নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা। সেজন্য গণমাধ্যমকেও ভূমিকা নিতে হবে। নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করার বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাদের সহযোগিতা করার সুযোগ দিতে হবে। সঙ্গে রাজনৈতিক দলের জন্য কোড অব কন্ডাক্ট বেঁধে দিয়ে জবাবদিহি নিশ্চিত করার সুযোগ আছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান নেই আর কত বলা? রাজনৈতিক দলের মধ্যে আস্থা নেই। নির্বাচনের বেশি সময়ও নেই। আমরা সহিংস পরিস্থিতি চাইনা। জনগণেরও তাই প্রত্যাশা।

মূল বিষয় হলো, মানুষের নির্বাচনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিটি দলকে তাদের ম্যানিফেস্টোর মাধ্যমে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। একইসঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা করায় ভুল নেই। সে পথও যে খোলা তা ফল দেওয়ার এই আনুষ্ঠানিকতাতে একটু ইঙ্গিত দেয়।

লেখক : সংবাদকর্মী

Link copied!