• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দূর হোক সব অমঙ্গলের ছায়া


প্রভাষ আমিন
প্রকাশিত: এপ্রিল ১৩, ২০২৩, ০৭:২৭ পিএম
দূর হোক সব অমঙ্গলের ছায়া

মানুষ সংঘপ্রিয় এবং উৎসবপ্রিয়। জীবনের নানা ব্যস্ততায় তারা আনন্দের, উৎসবের উপলক্ষ্য খোঁজে। বাঙালি একটু বেশিই উৎসবপ্রিয়। আমাদের উৎসবের কিছু ধর্মীয়, কিছু জাতীয়, কিছু আবার রাষ্ট্রীয়। ২১ ফেব্রুয়ারি শোকের দিন হলেও সাত দশকের পথচলায় এই শোকের দিনকেও আমরা উৎসব বানিয়ে ফেলেছি। ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর আমাদের রাষ্ট্রের জন্মোৎসব। ঈদ, পুজা, বড়দিন, প্রবারণা পূর্ণিমা—এই ধর্মীয় উৎসবগুলোতেও আমরা মেতে উঠি আনন্দে। তবে বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ, নববর্ষ। এই একটি দিনে সব ধর্মের, সব শ্রেণির, সব পেশার মানুষ বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে, আনাচে কানাচে উৎসবে মেতে ওঠে। শুধু বাঙালি নয়, আদিবাসীরাও বৈসাবী উৎসব নিয়ে সামিল হয় বাংলা বর্ষবরণে। এই একটি দিনে বাংলার ঘরে ঘরে আনন্দের বান ডাকে যেন। গ্রামে গ্রামে বৈশাখী মেলা, হরেক খাবার, হরেক খেলনা, নাগরদোলা; সত্যিই যেন আনন্দের মেলা বসে। পুরাতনকে ঝেড়ে ফেলে নতুনকে আবাহনের এই উৎসবের বাঙালি সাজে নতুন রঙে।

বাংলাদেশে তিনটি সাল আমরা ব্যবহার করি। আমাদের ধর্ম, জাতীয়তা বা সংস্কৃতির সাথে যার কোনো মিল নেই, সম্পর্ক নেই; সেই খ্রিস্টাব্দ ব্যবহার করি সবচেয়ে বেশি। অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সর্বত্রই খ্রিস্টাব্দের জয়জয়কার। আমরাও ইংরেজি মাসের তারিখ যতটা জানি, বাংলা বা হিজরি মাসের তারিখ ততটা জানি না। খ্রিস্টাব্দে ‍‍`নিউ ইয়ার‍‍` যতটা উদযাপিত হয়, তার চেয়ে বেশি হয় ‍‍`থার্টি ফার্স্ট‍‍`। হিজরি সাল বা আরবি ক্যালেন্ডার প্রতিদিন না লাগলেও আমাদের নিয়মিতই লাগে। ইসলাম ধর্মের সব হিসাব-নিকাশ এই চান্দ্র মাস বা হিজরি সাল ধরেই হয়। তবে হিজরি সালে নববর্ষ বা নিউ ইয়ার উদযাপনের রেওয়াজ নেই। বরং হিজরি বর্ষের প্রথম মাস মহররম আসে কারবালার শোকাবহ স্মৃতি নিয়ে। তবে বাংলা বছরের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ আমাদের জীবনে আসে উৎসবের ডালি সাজিয়ে- গানে, মেলায়, উৎসবে, রঙে অনন্য হয়ে।

মৌলবাদীদের কেউ কেউ পহেলা বৈশাখকে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি বলেন, এর বিরোধিতা করেন। কিন্তু বাংলা সনের সাথে কোনো ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। কিছুটা সম্পর্ক থাকতে পারে ইসলাম ধর্মের সঙ্গে। কারণ বাংলা সন গণনা চালু করেছিলেন মোগল সম্রাট আকবর। বাংলা সনের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক হলো কৃষিকাজের, কৃষকের। শুরুতে এটাকে ফসলি সনও বলা হতো। ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য শুরুর পর হিজরি সাল অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় হতো। কিন্তু হিজরি সাল চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলতো না। প্রতিবছরই হিজরি সালে দিনের ওলটপালট হয়ে যায়। তাই কৃষকদের ওপর অসময়ে খাজনা দেয়ার চাপ তৈরি হতো। এই ঝামেলা মেটাতেই সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সম্রাট আকবরের নির্দেশে প্রাচীন বর্ষপঞ্জি সংস্কার করে ফসলি সন বা বাংলা সন চালু করা হয়। আর এই সংস্কারের কাজটি করেছিলেন তখনকার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি। তিনি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম চালু করেন। আকবরের সময় থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তখন চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। সকল দেনা মিটিয়ে পহেলা বৈশাখ শুরু হতো নতুন আশা নিয়ে। ব্যবসায়ীরা নতুন বছর শুরু করতেন নতুন খাতা দিয়ে, যেটাকে বলা হয় হালখাতা। হালখাতা উৎসবও হয়। ব্যবসায়ীরা পাওনা আদায়ে উৎসব করতেন।

পহেলা বৈশাখের সাথে কোনো হিন্দুয়ানির সম্পর্ক নেই। যে দুজনের নাম আছে- একজন সম্রাট, একজন জ্যোতির্বিদ, দুজনই মুসলমান। পহেলা বৈশাখের উৎসবটা হিন্দুয়ানি যেমন নয়, ইসলামিকও নয়; পহেলা বৈশাখ বাঙালির সংস্কৃতি, এই মাটির সংস্কৃতি। আমরা শহুরে লোকজন যতই দেয়ালে ইংরেজি ক্যালেন্ডার ঝুলিয়ে রাখি, গ্রামের মানুষের সব হিসাব কিন্তু বাংলা সনে। তাদের ক্যালেন্ডার লাগে না, আকাশ আর প্রকৃতি দেখেই মাস-ঋতুর হিসাব মেলায়। বাংলা মাসগুলোকে গ্রামের মানুষ ডাকেও নিজেদের মত করে। জ্যৈষ্ঠ মাস তাদের ভাষায় জষ্ঠি, কাতি মানে কার্তিক, অগ্রহায়নকে ডাকে আগুন, ফাল্গুনকে ফাগুন, আর চৈত্র হলো চইত মাস। বৃষ্টি-বাদলা, ঝড়-বন্যা-খড়ার হিসাব তাদের মুখস্ত। প্রকৃতির দিকে তাকালেই বোঝা কোন ঋতু চলছে। কৃষ্ণচূড়ার মত কড়া রঙের ফুল মানেই গ্রীস্মকাল, গন্ধরাজের মত সুগন্ধী মানেই বর্ষা, কাশ মানেই শরত। নতুন বছর বাংলারে কৃষকদের জন্য জন্য সত্যি সত্যি নতুন আশা নিয়ে আসে।

পহেলা বৈশাখ বাঙালির উৎসব। এই উৎসবে শামিল হয় মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ- সবাই। বাঙালি মুসলমানরা যেমন অন্য বাঙালির সঙ্গে মিলে নববর্ষ পালন করে। অন্য দেশের মুসিলমানরাও নিজ নিজ অঞ্চলের উৎসব পালন করে। ইরানের মুসলমানরা তাদের নববর্ষ ‘নওরোজ’ পালন করে বিপুল উৎসবে। ইসলাম প্রবর্তনের সময় পহেলা বৈশাখ ছিল না, তাই এর সাথে ইসলামের কোনো বৈরিতা থাকার সুযোগই নেই। উইটিউবে এক হুজুর দেখলাম গলা ফুলিয়ে আল্লাহর কসম কেটে বলছেন, পহেলা বৈশাখে যারা পাঞ্জাবি কিনবে; তারা জাহান্নামী, জাহান্নামী, জাহান্নামী। সেই কথাটিও কিন্তু তিনি বলছেন, পাঞ্জাবী পরেই। আমি যে পাঞ্জাবি পরে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করি, সেই পাঞ্জাবী পরেই ঈদের নামাজে যাই। পোশাক হলো মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য। পোশাকের কোনো ধর্ম নেই। দেশে দেশে, অঞ্চলে অঞ্চলে পোশাক বদলে যায়। বাঙালি মুসলমানরা জীবনযাপন করে এ অঞ্চলের পোশাক পরে। গরমের দেশ সৌদি আরবের মুসলমানরা যে পোশাক পরবে, শীতের দেশ রাশিয়ার মুসলমনারা নিশ্চয়ই সে পোশাক পরবে না। ধর্মকে যারা সংস্কৃতির মুখোমুখি করতে চান তাদের উদ্দেশ্য সৎ নয়। আদতে তারা ধর্মেরই অবমাননা করেন।

গ্রামে গ্রামে বৈশাখী মেলা বসলেও ঢাকায় বর্ষবরণের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে পহেলা বৈশাখের ভোরে ছায়ানটের বর্ষবরণ। কিন্তু ছায়ানটের বর্ষবরণও বাঙালি সংস্কৃতির আদি উৎসব নয়। ষাটের দশকে পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালি সংস্কৃতি বিরোধী আগ্রাসনের প্রতিবাদে গড়ে ওঠে ছায়ানট। পাশাপাশি স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে তাল মিলিয়ে ১৯৮৯ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। সব অমঙ্গলকে দূর করার আকাঙ্ক্ষায় শুরু হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউএনডিপির বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। দুয়ে মিলে রাজধানীর বর্ষবরণে লাগে উৎসবে রঙের বাড়তি ছোঁয়া। কিন্তু পাকিস্তান আমলের মত গত কয়েক বছর ধরে ধর্মীয় বিবেচনায় বর্ষবরণ আর মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরোধিতা করা হচ্ছে। সময় এসেছে আবারও রুখে দাড়ানোর। ছায়ানটের মত মঙ্গল শোভাযাত্রাও বাঙালির আদি সংস্কৃতি নয়। কিন্তু এ দুটি আয়োজন শহুরে বাঙালির বর্ষবরণে নতুন মাত্রা এনেছে, উৎসবে নতুন রঙ এনেছে। মঙ্গলকে যারা হিন্দুয়ানী বলেন, মঙ্গলবারকে তারা কী বলবেন। সংস্কৃতির সাথে ধর্মের বিরোধের চেষ্টা আসলে ধর্মেরই অবমাননা। 

শুরুতে এ অঞ্চলের উৎসবের কথা বলছিলাম। রমজান আমাদের দেশে এবং ঘরে অন্যরকম আবহ নিয়ে আসে। রমজান সংযমের মাস। কিন্তু সেই সংযমটাও আমরা পালন করি উৎসবমুখরতায়। ভোররাতে সেহরি খাওয়ার সময় একধরনের উৎসব। দিনভর অপেক্ষার পর সন্ধ্যায় ইফতার আরেক ধরনের উৎসব। মনে হতে পারে সারাদিন না খেয়ে থাকাটা কষ্টকর। কিন্তু একজন বিশ্বাসী মুসলমানের কাছে এটা কষ্ট নয়, এই সংযমেও আনন্দ আছে। আর এক মাসের সংযম শেষে অফুরান আনন্দ নিয়ে আসে পবিত্র ঈদুল ফিতর। সংযম-আনন্দ- সব মিলিয়ে রমজান এক অনাবিল উৎসবেরই নাম। এবার বাঙালির প্রাণের উৎসব নববর্ষ এসেছে রমজানের উৎসবের মধ্যেই। এর আগেও রমজানে পহেলা বৈশাখ হয়েছে। ভোররাতে সেহেরি খেয়েই অনেকে ছুটে গেছেন রমনা বটমূলে বর্ষবরণের ঐতিহ্যের অংশ হতে। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রায়ও সামিল হয়েছেন বিপুল সংখ্যক মানুষ। বর্ষবরণের শামিল হওয়া বাঙালি মুসলমানদের অনেকেই রোজা রেখেই উৎসব করেছে। একসময় মৎস্য ভবন, দোয়েল চত্বর, নীলক্ষেত থেকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়ের ভেতরের পুরো রমনা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নববর্ষে আনন্দের মেলা বসতো। মঙ্গল শোভাযাত্রা চারুকলা থেকে শুরু হয়ে দোয়েল চত্বর, হাইকোর্ট, শিশুপার্ক, শাহবাগ হয়ে চারুকলায় শেষ হতো। তবে এটা মানতেই হবে নিরাপত্তার কড়াকড়িতে গত কয়েকবছর ধরেই উৎসব কিছুটা নিয়ন্ত্রিত। সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে মোকাবেলার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো, আরো বেশি করে উৎসবে সামিল হওয়া, স্বতঃস্ফূর্ততায় সব শঙ্কা উড়িয়ে দেয়া। সরকার এবার দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উৎসবমুখর পরিবেশে ও যথাযথ আড়ম্বরের মাধ্যমে নববর্ষ উদযাপনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নির্দেশনায় জাতীয় সঙ্গীত ও এসো হে বৈশাখ গানের মাধ্যমে বর্ষবরণের আয়োজন শুরুর কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে অন্তর্ভূক্তির বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে প্রচার এবং শিক্ষার্থীদের নিয়ে র‌্যালি করারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। 

মৌলবাদীদের নানা অপপ্রচার, হুমকি সত্বেও বাঙালির প্রাণ থেকে শেকড়ের উৎসব কেড়ে নেয়া যাবে না। রবিঠাকুরেই আমরা সুর মেলাই, ‍‍`মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা/অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা‍‍`। নতুন বছর যেন আমাদের সবার মনের সব গ্লানি ও কালিমা মুছে দেয়।

 

লেখক: সাংবাদিক

Link copied!