বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতির আকার এক হাজার বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি, যা দেশটিকে বিশ্বের ৩৩তম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত করেছে। উপরন্তু বৈশ্বিক করোনা মহামারি, যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও দুই দশক ধরে দেশটি প্রায় ছয় শতাংশ হারে বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরে এসে বাংলাদেশ চিত্তাকর্ষক এই অর্থনৈতিক অগ্রগতি বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে।
বস্ত্র শিল্পে বিশ্বে নেতৃস্থানীয় বাংলাদেশ দেশে ওষুধ উৎপাদন করে বিশাল জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা চাহিদা মেটাচ্ছে। ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে শিল্পায়নের মাধ্যমে একটি উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হতে চাচ্ছে। এসব সংবাদ বাংলাদেশের মানুষকে অবশ্যই খুশি করছে। কিন্তু আধুনিক বিশ্বের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বা এফডিআই আকর্ষণের তুলনামূলক বিচারে বাংলাদেশ দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে। পিছিয়ে পড়ার এই বিষয়টি দেশের অর্থনীতি ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আংকটাডের (ইউএনসিটিএডি) ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০২৩ বলছে, দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি বাংলাদেশে এক বছর আগের তুলনায় সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট, এফডিআই) কমেছে এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শতাংশ হিসাবের দিক থেকে এটি এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। অর্থনৈতিককভাবে দেউলিয়া ঘোষিত শ্রীলঙ্কা এবং দ্বীপদেশ মালদ্বীপও এফডিআই আকর্ষণে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো করেছে। এ অবস্থায় স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, বাংলাদেশ সরকারের নানা পদক্ষেপের পরও নতুন এফডিআই কম আসার প্রবণতা কেন শুরু হয়েছে? এই প্রবণতা কী দীর্ঘস্থায়ী হবে? দীর্ঘস্থায়ী হলে সংকটগ্রস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ হাল কী অবস্থায় দাঁড়াবে?
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা‑অনিশ্চয়তা সাম্প্রতিক সময়ের কম এফডিআই প্রবণতায় সামান্য ভূমিকা রাখলেও নীতি ও পরিচালনা ব্যবস্থা এবং মাঠপর্যায়ের দুর্বল অবস্থা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করতে বড় ভূমিকা রেখেছে। তাদের মতে, অবস্থাদৃষ্টে গৃহীত নীতি‑পদক্ষেপ ভালো মনে হলেও বাস্তবায়নপর্যায়ে বড় ধরনের সমস্যা, ঘাটতি ও অবহেলা রয়েছে এবং এই অবস্থা চললে দেশের ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন যথেষ্ট প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয় হবে।
অর্থনীতিশাস্ত্রের দৃষ্টিতে বিনিয়োগ ছাড়া অর্থনীতি স্থবির‑অচল। কম বিনিয়োগের মানে কম উৎপাদন। আর কম উৎপাদন মানে মানুষের কম কর্মসংস্থান। ফলে মানুষের অর্থনৈতিক টানাপোড়েন। আমরা জানি যে টাকা তখনই বাড়ে, যখন তা উৎপাদনশীল কোথাও বিনিয়োজিত হয়। কারণ, টাকা নিজে হাঁটতে পারে না, তার নিজের কোনো ওড়ার ক্ষমতাও নেই। কিন্তু ব্যক্তিমানুষ টাকাকে হাঁটাতে পারে, উড়িয়েও নিতে পারে; যদি ব্যক্তিমানুষটির বিনিয়োগ প্রত্যাশা ও লাভের সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ টাকা উড়বে‑হাঁটবে, যদি কেউ তার মূল্য যোগ করাতে জানে। আর টাকার এই মূল্যই হলো আসলে তার রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট বা বিনিয়োজিত অর্থের লাভ। সাধারণ ভাষায় বলা যায়, লাভের আশায় সঞ্চয়ের টাকা কোথাও ব্যবহার বা লগ্নি করাকেই বিনিয়োগ বলে। যেমন জমি ও স্বর্ণ ক্রয়, ব্যবসায় খাটানো, ব্যাংকে স্থায়ী আমানত করা, সঞ্চয়পত্র‑বন্ড‑শেয়ার ক্রয় প্রভৃতি। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অর্থনীতিতে অর্থের বিনিয়োগ হয় মূলত দুভাবে, দেশি ও বিদেশি অর্থে। দেশের মানুষের উৎপাদনী শক্তি ও নবমূল্য সৃষ্টিকারী বস্তুসামগ্রী দেশি বিনিয়োগ সৃষ্টি করে। অপরদিকে বিদেশ থেকে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানপর্যায়ে, বহুজাতিক কোম্পানি রূপে এবং বিদেশি সরকার ও তাদের এজেন্টের মাধ্যমে কোনো দেশে বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালিত হলে তাকে সরাসরি বিদেশি বা বৈদেশিক বিনিয়োগ (ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট, এফডিআই) বলে। বাংলাদেশ সরকারের ওয়েবসাইটে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সুবিধা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের সুযোগ অনেক। সরকার বিনিয়োগে একটি সহায়ক ও প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নীতির ক্ষেত্রে বেশকিছু পুরোনো ব্যবস্থার সংস্কার করেছে এবং ধাপে ধাপে শিল্প ও অবকাঠামোগত ক্ষেত্রে নিজের সম্পৃক্ততা সরিয়ে বেসরকারি অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করছে। এ ছাড়া সুষম গতিতে বাণিজ্য ক্ষেত্রে উদারীকরণ করছে, শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা, যৌক্তিক শুল্ক নির্ধারণ এবং রপ্তানি সুবিধা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আংকটাডের ২০২৩ সালের বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদন বলা হয়েছে, ২০২২ সালে সারা বিশ্বে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমলেও বাংলাদেশে বেড়েছে। এ সময় দেশে এফডিআই প্রবাহ ২০ শতাংশ বেড়ে ৩৪৮ কোটি ডলার হয়েছে, যা স্থানীয় মুদ্রায় ৩৭ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকার মতো (প্রতি ডলার ১০৮.৫০ টাকা)। দেশে ১৯৯০ সালের পর ২০২২ সালের ওই এফডিআই ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এবং বিগত ৩৩ বছরের মধ্যে ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ ৩৬১ কোটি ডলারের এফডিআই এসেছিল। আংকটাডের ওই প্রতিবেদন মতে, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) মধ্যে এফডিআই পাওয়ার বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। সামগ্রিকভাবে ২০২২ সালে এলডিসিভুক্ত দেশগুলোয় যেখানে এফডিআই প্রবাহ ১৬ শতাংশ কমেছে, সেখানে বাংলাদেশে ২০ শতাংশ বেড়েছে। সব এলডিসির পাওয়া মোট এফডিআইয়ের ৭০ শতাংশই পেয়েছে মাত্র পাঁচটি দেশ, যার মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয় স্থানে রয়েছে। বাকি চার দেশ হচ্ছে ইথিওপিয়া, কম্বোডিয়া, সেনেগাল ও মোজাম্বিক। ২০২২ সালসহ আগের কয়েকটি বছরের বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ার এই প্রবণতা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছে। কিন্তু এর পর থেকে হঠাৎ করে বাংলাদেশে এফডিআই বাড়ার পরিবর্তে তা একলাফে বেশ কমে আসার প্রবণতা শুরু হয়েছে। আংকটাডের সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের এফডিআই জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ। ডলারের হিসাবেও এফডিআইয়ের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। অথচ রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়ন করে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত অর্থনীতির দেশে পরিণত হতে হলে বাংলাদেশকে বার্ষিক জিডিপির ১ দশমিক ৬৬ শতাংশের সমপরিমাণ সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ পেতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মাসখানেক আগে প্রকাশিত বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ে আসা অর্থসংক্রান্ত এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০২২-২৩ অর্থবছরে নিট এফডিআই প্রবাহ ছিল ৩২৪ কোটি ৯৬ লাখ ৮০ হাজার ডলার, যা আগের (২০২১-২২) অর্থবছরে ছিল ৩৪৩ কোটি ৯৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে নিট এফডিআই প্রবাহ কমেছে ৫.৫২ শতাংশ। নিট প্রবাহের এই চিত্রের বিপরীতে বিদেশি নতুন বিনিয়োগকারীরা নতুন মূলধনও এনেছেন অনেক কম। ২০২১-২২ অর্থবছরে নতুন মূলধন বিনিয়োগ ছিল ১৩৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। কিন্তু গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ৭৯ কোটি ৫৯ লাখ ডলারে। এই হিসেবে নতুন বিদেশি মূলধনী বিনিয়োগ কমেছে ৪০ দশমিক ৯১ শতাংশ। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে এফডিআই অঙ্গনে কেন এই উল্টোমুখী প্রবণতা শুরু হয়েছে, তা সঙ্গত কারণে চিন্তার সৃষ্টি করেছে। কেননা সাধারণত দেখা যায়, এফডিআই আসা শুরু হলে তা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। তা ছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন বেশ সংকটে রয়েছে। এ অবস্থায় অর্থনীতি বিশ্লেষক ও সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে নানা ধরনের মন্তব্য ও বিশ্লেষণ আসছে। এসব মন্তব্য ও বিশ্লেষণে কিছু মিল‑অমিল থাকলেও সবচেয়ে বড় বৈপরীত্য হলো, নীতি ও বাস্তবতা নিয়ে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, কাগজে-কলমে যত ভালো নীতিই থাকুক না কেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যথাযথ আচরণ ও সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এখনো অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে।
সাধারণ দৃষ্টি নিয়ে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসা কমে যাওয়া এবং বিনিয়োগ কম আসার গভীরে গেলে দেখা যায়, প্রায়োগিক দুর্বলতা জিইয়ে রেখে আর যা‑ই হোক মুনাফাপ্রত্যাশী বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অপরিচিত দেশের বিনিয়োগ মাঠে খেলতে নামানো আসলে বেশ কষ্টকর। এখানে মাঠ ভালো না এবড়োখেবড়ো এবং খেলার মাঠে নীতি পরিচালনাকারী রেফারি (দেশের সরকার) কী ব্যবহার প্রদর্শন করছেন, সেটাই মূল বিবেচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। খেলার নীতি বাস্তবায়নে গড়িমসি এবং বারবার ভিডিও অ্যাসিটেন্ট রেফারির (ভিএআর) সহায়তার মতো অত্যধিক বিবেচনামূলক সিদ্ধান্তগুলো বিনিয়োগের মাঠে পুঁজির মালিকদের খেলতে নামতে দোদুল্যমানতার পাশাপাশি নিরুৎসাহিত করছে। বিপুল দর্শক (শ্রমিক) ও কম টিকিট মূল্য (স্বল্প পারিশ্রমিক) এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের কাছে বিবেচ্য কোনো বিষয় নয়। কারণ, যিনি টাকার মালিক, তিনি সবার আগে বিবেচনা করেন আসলেই কি গন্তব্য বা বিনিয়োগ মাঠে জেতা ও লাভের হার বেশি এবং এই হার কি অতিস্বল্পমেয়াদি এবং তা কি নিশ্চিত এবং নিশ্চয়তা প্রদানকারীর চারিত্রিক ইতিহাস ভালো তো? পুঁজির মালিক এভাবেই ভাবেন, কারণ অবারিত মুক্তবাজারের বিশ্বে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনেক বিকল্প আছে। তারা যদি কোনো দেশকে অর্থলগ্নীর জন্য আকর্ষণীয় মনে না করেন, তাহলে অন্য দেশে চলে যাবেন। যেমন দেউলিয়া শ্রীলংকায়, চারিদিকে পানি থইথই করা মালদ্বীপে কিংবা যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষপীড়িত ইথিওপিয়ায়।
বিনিয়োগের মাঠে দুর্বলতা থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে নতুন বিনিয়োগ আসা কেন কমেছে, তার কারণ খুঁজতে গেলে প্রথমেই আসে ডলার সংকট ও তার মূল্য ওঠানামা করার বিষয়টি। গত দুই বছরের টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের মূল্য বেড়েছে প্রায় ২৫‑৩০ শতাংশ। তারপরও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আসছেন না। এর কারণ বৈদেশিক মুদ্রা বিশেষত ডলারের সংকট। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির দর ১০০ টাকা করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত এই দর দিয়ে দেশের কোথাও ডলার পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার বিক্রির দর বৃদ্ধির দিনই ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ঘোষিত প্রতি ডলারের সর্বোচ্চ দর ছিল ১০৭ টাকা। আর খোলাবাজারে ডলারপ্রতি মূল্য ছিল আরও বেশি, কমপক্ষে ১১২ টাকা। বাফেদার ঘোষিত দর হিসাব নিলে দেখা যায়, এক বছরেরও কম সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে (অবমূল্যয়ন) হয়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী অনেক বিদেশি কোম্পানি ও ব্যক্তি সময়মতো নিজ দেশে মুনাফা নিয়ে যেতে পারেননি। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, অর্থের মালিক সঞ্চিত অর্থ কোথাও বিনিয়োগের আগে তার ফেরত আসা ও লাভ নিয়ে চিন্তা করেন। যেহেতু তিনি অর্থকে ওড়াতে ও হাঁটাতে জানেন, সেহেতু সবসময় তিনি অর্থকে সচল রাখতে চান। যখন তিনি দেখছেন যে বাংলাদেশে পদ্ধতিগত সমস্যায় তিনি অর্থকে ঠিকমতো ওড়াতে পারছেন না, স্বভাবতই তিনি তখন নতুন বিনিয়োগ করা থেকে বিরত থাকেন এবং অন্যকেও বিনিয়োগে না আসার বার্তা পোঁছে দেন। এখানে উল্লেখ্য, প্রত্যাশিত মাত্রায় রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় না বাড়ায় বাংলাদেশ এমনিতেই ডলার সংকটে রয়েছে। তার ওপর এখন নিজস্ব টাকারও সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ব্যয়ের তুলনায় আয় না বাড়ায় বাংলাদেশ নিজস্ব টাকার সংকটে পড়েছে। সাধারণত রাজস্ব আয়ে ঘাটতির টাকা সরকার ব্যাংকসহ নানা উৎস থেকে ঋণ করে মেটায়। কিন্তু সরকারের ঋণ করার মতো উৎসও কমে গেছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ডলার সংকট ও আমানত প্রবাহ কমায় তারল্য সংকট বাড়ছে। বিদেশি ঋণদাতারাও বাংলাদেশের সংকট দেখে ঋণদানে শক্ত হচ্ছে। সব মিলিয়ে ডলার ও টাকার সংকট সামগ্রিকভাবেই দেশি‑বিদেশি বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করছে।
বিদেশি বিনিয়োগ কমার দ্বিতীয় বড় কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান ও আসন পেতে বসা অর্থপাচার ও দুর্নীতির সংস্কৃতি। যুক্তরাষ্ট্র‑ভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) হিসাবে, শুধু আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমেই প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে পাচার হচ্ছে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার করে (৮২ হাজার কোটি টাকা)। অর্থনীতি শাস্ত্র বলে, এক দেশের অর্থ আরেক দেশে পাচার হলে ভুক্তভোগী দেশের ব্যবসা‑বাণিজ্যে গতি কমে যায়। যেহেতু পাচার করা অর্থ আর ফেরতে আসে না, সেহেতু অর্থের ঘাটতি কমাতে বাড়তি কর‑ঋণ নিতে হয়। এতে করে অর্থনীতির সামগ্রিক ভারসাম্যটাই নষ্ট হয়ে যায়। ক্রমাগত ভারসাম্য নষ্ট হতে থাকা অর্থনীতিতে কষ্টে সঞ্চিত অর্থ কে‑ই বা বিনিয়োগ করতে চায়। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে ফেলা বিদেশিরা এখন দেখছেন, অর্থের ঘাটতিতে পড়া বাংলাদেশে বিনিয়োগ করা অর্থে অর্জিত লাভের টাকা নিজ দেশে পাঠাতে দেরি হচ্ছে। কারণ, পাচারসহ নানা কারণে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভই তো কমে গেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের টাকাকে বিদেশি মুদ্রায় রূপান্তরিত করা তার জন্য সময়সাপেক্ষ বিষয় হয়ে উঠেছে। এই অবস্থা বিদেশি বিনিয়োগ আনতে অনাগ্রহ সৃষ্টি করছে।
উল্লিখিত দুই মূল সমস্যা ছাড়াও বাংলাদেশে নতুন বিদেশি বিনিয়োগ কম আসা ও তুলনামূলক কম বিদেশি বিনিয়োগের আর যেসব কারণ রয়েছে, তার মধ্যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বিদ্যুৎ‑জ্বালানি সংকট এবং নিচু স্তরের সেবার মান অন্যতম। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের আগে লাখ লাখ টাকা খরচ করে ফিজিবিলিটি টেস্ট বা সম্ভাব্যতা যাচাই করেন। এ সময় যদি তারা দেখেন যে বাংলাদেশের অর্থনীতির সামষ্টিক বিষয়াবলী ছাড়াও বিদেশি ঋণ, ঋণ ব্যবস্থাপনা, ঋণ পরিশোধ, দেশীয় ঋণ, স্পেশাল বন্ড, ট্রেজারি বিল, ট্রেজারি বিলের রেট, এক্সচেঞ্জ রেট, ফ্লোটিং রেট, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ, সুদের হার, কস্ট অব লিভিং, লিভিং স্টান্ডার্ড, অর্থপাচার, ঋণ খেলাপি, রাজস্ব আয়, কর‑জিডিপি অনুপাত, কর ব্যবস্থায় সমস্যা, বাণিজ্য ঘাটতিসহ বহুবিধ সমস্যা রয়েছে; তখন তার বিনিয়োগ করার সমস্ত ইচ্ছা নষ্ট হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে জোরালভাবে উপস্থিত থাকা বিদ্যমান মুদ্রার বেআইনি লেনদেন-পাচার, ঘুষ, দুর্নীতি, লালফিতার দৌরাত্ম্য, শেয়ারবাজারের কারসাজি, নিম্নমানের নির্মাণকাজ, প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দাম দেখানো, অবৈধ কমিশন পাওয়ার ইচ্ছা, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মাস্তানি, জমি-সম্পত্তি নিয়ে জটিলতা, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের আধিপত্য ও কারসাজি, ব্যবসা-বাণিজ্যে স্বজনতুষ্টি, অনিয়ম, আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে দেশীয় ব্যবসায়ীদের কর্তৃত্ব এবং অদক্ষ শ্রমখাত সবকিছুই আসলে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট না করার অন্তর্নিহিত কারণ।
পরিশেষে বলা যায়, বিপুল তরুণ জনগোষ্ঠী ও সস্তা শ্রমিকের বাংলাদেশের মানুষের আতিথেয়তার বিশ্বজোড়া খ্যাতি রয়েছে। কিন্তু অর্থের মালিক বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আদর‑যত্নে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। সঙ্গত কারণেই রাষ্ট্রের পরিচালক ও অভিভাবক হিসেবে সরকারকেই এর দায় নিতে হয়। সরকারের সর্বোচ্চ মহলের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা সত্ত্বেও কেন বিদেশিরা বিনিয়োগে আসতে চায় না, তার কারণ খুঁজে দ্রুতই তা সমাধান করা গেলে আশা করা যায়, বাংলাদেশ অবশ্যই বেশি বেশি বিদেশি বিনিয়োগ পাবে।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি