ঈদ এলেই মনে পড়ে সেই গল্পের কথা। ‘আজ ঈদ। মদিনার ঘরে ঘরে আনন্দ। পথে পথে ছেলে মেয়েদের কলরব।...’ শিশু শ্রেণির ‘আমার বইয়ে’ পড়া সেই গল্পে, ঈদগাহের কোণে বসে একটা ছেলে কাঁদছিল। নবীজী ছেলেটির কাছে গিয়ে তার কষ্টের কথা শোনেন। তারপর তাকে কোলে করে বাড়ি নিয়ে যান। নতুন জামাকাপড় আর খাবার দিয়ে ছেলেটির দুঃখ দূর করার চেষ্টা করেন।
ছেলেবেলায় আব্বার হাত ধরে গ্রামের ঈদগাহে গিয়ে গল্পের ছেলেটিকে মনে মনে খুঁজতাম। ভাবতাম, ঈদ মানে মানুষের দুঃখ, কষ্ট দূর করা, অসহায়ের পাশে দাঁড়ানো, নিজের আনন্দকে ভাগাভাগি করে নেওয়া। ঈদগা থেকে বাড়ি ফিরে দেখতাম ঘরভর্তি মানুষ। মা হাসিমুখে তাদের খাওয়াচ্ছেন। কিশোর-তরুণদের দেখতাম, গোটা পাড়া ঘুরে ঘুরে প্রতিটা ঘরেই সেমাই পায়েস খেতে। কে, কার বাড়িতে কতবার খেয়েছে তা নিয়ে গল্পের পাল্লা চলতো।
দিনটা এমন ছিল যে, কোনো বিরোধ বা নিছক তর্কাতর্কির জেরে সারা বছর যাদের সঙ্গে কথাবার্তা বন্ধ ছিল, ঈদের দিনে হাসিমুখে তাদের কথা হতো। সব হিংসা, বিদ্বেষ ভুলে কোলাকুলি হতো। দৃশ্যটি যে কত মধুর, আনন্দের ছিল, তা ছড়িয়ে পড়ত সবার মাঝে। নিজ হাতে বানানো নানা পদের খাবার পরিবেশন করে পরম মমতায় ঘরে ঘরে চলতো আপ্যায়নের ধুম।
ঈদের দিনে নতুন জামা পরে দূরের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে দল ধরে বেড়াতে যাওয়া ছিল সাধারণ দৃশ্য। ঈদুল ফিতরে আত্মীয়ের বাড়িতে নানা পদের খাবার, ফলমূলসহ আরও সব উপহার পাঠানো হতো। ঈদুল আজহায় কাছের দূরের আত্মীয়-স্বজন আর পাড়াপ্রতিবেশীদের ঘরে পাঠানো হতো কোরবানির মাংস। মাকে দেখতাম, পাড়ার সবচেয়ে অভাবীদের পেটপুরে খাওয়াত। বেশি করে মাংস দিত। কখনও কখনও গোপনে নগদ টাকা কিংবা জামাকাপড় পৌঁছে দিত।
শুধু কি তাই? ঈদের দিনটি ঘিরে নানা আয়োজন থাকতো গ্রামে। পাড়ায় পাড়ায় নাটক, গান, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। সব বয়সীরাই হুমড়ি খেয়ে পড়তো সেইসব অনুষ্ঠান দেখতে। পাড়ার ছেলেরাই অভিনয় করতো নাটকে। তারাই গান গাইতো, নানা কৌতুক, অভিনয় করতো। নিজ গ্রাম বা আশপাশ গ্রামের সব ধর্মের মানুষই অনুষ্ঠান উপভোগ করতে আসতেন।
ঈদের দিনে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষও আমন্ত্রণ পেতেন। তারা ঈদ আনন্দে সামিল হয়ে নিজেদের উৎসবের জন্যও আমন্ত্রণ করে যেতেন। গ্রামে নানা সময়ে বিভিন্ন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান হতো। এক ধর্মের মানুষ অংশ নিতেন অন্য ধর্মের উৎসবে। ধর্মীয় রীতিনীতি নিয়ে কোনো হিংসা, বিদ্বেষ দেখা যায়নি কখনও। সম্প্রীতির বন্ধনে উৎসবমুখর হয়ে উঠতো ধর্মীয় উৎসবের দিনগুলো।
ছেলেবেলার ঈদ উৎসবের চিরচেনা এইসব দৃশ্য সময়ের টানে আমূল বদল গেছে। ঘরে ঘরে আজ ঈদ উদযাপন হয় ঠিকই, তবে সেই আনন্দ প্রাণে প্রাণে ছড়িয়ে পড়ে না। আগে সারা বছর অপেক্ষা করে একটা বা বড়জোর দুটো নতুন জামা মিলতো। যে জামা ছিল মহামূল্যবান। অথচ এখন গোটা শপিংমল যেন তুলে আনা হয় ঘরে। ডজন ডজন জামা-কাপড় কেনা হয়, পরা হয়। কিন্তু সেই একটি জামার যে সুখ সেটা আর মেলে না।
আগের মতো পাড়াপ্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে উৎসব করে খাওয়া, আপ্যায়ন আর হয় না। কোথায় যেন একটা অদৃশ্য দেয়াল উঠে গেছে কাছের, দূরের মানুষে মানুষে। এখন ঈদের দিনে বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে দলবেঁধে আড্ডা জমে কোনো হোটেল, চায়ের স্টল, রেস্টুরেন্টে বা কফিশপে। ঘরে তৈরি সেমাইয়ের বদলে এখন খাওয়া হয় স্ট্রিট বা ফাস্টফুড। সারা বছরের রাগ, ক্ষোভ, অভিমান ভুলে প্রতিবেশীদের বুকে জড়িয়ে ধরে উষ্ণতা বিনিময়ের প্রথাও শিথিল হয়ে গেছে। বরং ঈদের দিনেও ঘটে খুন, ধর্ষণের মতো ভয়ঙ্কর সব ঘটনা।
আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে ঘুরতে যাওয়ার চেয়ে এখন কোনো পার্ক কিংবা দর্শনীয় স্থানই বেশি টানে। কিশোর, তরুণরা দলবেঁধে ঘুরতে বের হয়। বেপরোয়া গাড়ি চালাতে গিয়ে অকাতরে প্রাণ হারায়। অনেকেই আবার উড়ে যান বিদেশে। পাড়ায় পাড়ায় নাটক মঞ্চায়ন কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বদলে এখন সাউন্ডবক্স লাগিয়ে শব্দদূষণ ঘটিয়ে মিউজিক বা গান বাজানো হয়। মায়ের হাতের পায়েসের চেয়ে এখন কোমল পানীয় বেশি প্রিয়।
শহরের ঈদে আগে ছিল ভিন্ন এক মাত্রা। মানুষে মানুষে টান, মানবতা, মহানুভবতা, বন্ধুত্ব ছিল ধর্মীয় উৎসব ঘিরে। আর এখন ঈদ উৎসব হয়ে পড়েছে কৃত্রিমতায় ভরপুর। শহরের ঈদ উদযাপনের আবেগ অনেকটা গৃহবন্দী। কখনও তা বেরিয়ে পড়ে তারকা হোটেলে, কখনও বিদেশের কোনো ঝলমল শহরে, বিলাসবহুল দ্বীপে। লাখ লাখ টাকা খরচ হয় কৃত্রিম আনন্দের পেছনে।
অথচ বিশাল অট্টালিকাগুলোতে দরজার পাশেই যে অনেকে থাকেন, তারা কেমন আছেন, কীভাবে আছেন, দুঃখ-কষ্টে আছেন নাকি আনন্দে আছেন, জানতে চায় না কেউই। ঈদে সম্প্রীতির যে আহ্বান তা নগর, মহানগরের বড় বড় ঈদগায় ফ্রেমবন্দি কোলাকুলি আর সম্প্রচার মাধ্যমের ক্যামেরাতেই বেশি ধরা পড়ে।
আমাদের মহানগরীগুলো দিন দিন মেট্রো থেকে কসমোপলিটন সিটিতে বদলে যাচ্ছে। দ্রুত বদলে যাচ্ছে আমাদের সামষ্টিক আচরণ, রীতিনীতি, সংস্কৃতি। আগে গ্রাম আর শহরের ঈদ উদযাপনে দৃশ্যমান ফারাক ছিল। শহরে ছিল কৃত্রিমতা, আনুষ্ঠানিকতার বাড়াবাড়ি। তবে গত কয়েক দশকে ব্যাপকহারে শহরায়নের ফলে এখন গ্রাম আর শহরের সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কৃতির ব্যবধান মুছে গেছে। গ্রামের জীবনে ঢুকে পড়েছে শহুরে হাওয়া। ফলে ঈদ উদযাপনে দৃশ্যমান কোনো পার্থক্য চোখে পড়ে না।
আজ যাদের বয়স বাংলাদেশের সমান কিংবা কাছাকাছি তাদের কাছে ছেলেবেলার ঈদের দিনগুলো সোনালি ফ্রেমে বাঁধা। আধুনিকতার সঙ্গে তা মেলাতে পারেন না। অনেক সময় সমকালকে তারা বুঝেও উঠতে পারছেন না। ফলে অতীতের মোহ প্রবলভাবে উসকে দেয় স্মৃতিকে। সেই মোহের বাস্তব রূপ দিয়ে লেখা শাহ আব্দুল করিমের গান ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাতাম... তাই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ভাবনায় আমরা সমকাল থেকে পালিয়ে বেড়াই।
মূলত, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি আর যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিস্ময়কর বিপ্লবের ফলে ক্রমেই হাতের মুঠোয় বন্দী হয়ে পড়েছে আমাদের পৃথিবী। সীমানাহীন এক বিশ্বের নাগরিক হয়ে উঠেছি। বৈশ্বিক সংস্কৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে পড়ছে বিভিন্ন জাতি আর সম্প্রদায়ের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি। যার প্রভাব পড়ছে ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি, উৎসব পালন ও উদযাপনে।
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের চেহারায় আমূল বদল এসেছে। জীবন-জীবিকার টানে গ্রাম থেকে দলে দলে মানুষ ছুটে এসেছে নগর-মহানগরগুলোতে। শহরে কর্মসংস্থানের চাপ বেড়েছে বহুগুণ। জীবনযাত্রায় ব্যয় বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে ব্যক্তি আর সামাজিক জীবনে। আয়-সম্পদের পাহাড়সম বৈষম্যের পাশাপাশি জীবন-জীবিকা নিয়ে প্রবল চাপে থাকা মানুষের ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতেও এসেছে বদল। তাছাড়া শহুরে জীবনের প্রবল গতিময়তা সংস্কৃতিতে বাঁক বদল ঘটিয়েছে।
ঈদ উৎসব ঘিরে প্রতিবছর দেখা যায় লাখ লাখ মানুষ শহর ছেড়ে ফিরছেন গ্রামে। পথে পথে নানা ভোগান্তি আর বিড়ম্বনাকে সঙ্গী করেই তারা অদম্যগতিতে গ্রামে ছুটে যান। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য গ্রামমুখী এই জনস্রোতের পেছনে শুধু যে প্রিয়জন বা শেকড়ের টানই থাকে, তা নয়। গ্রাম্য অর্থনীতিতে জ্বালানি সরবরাহের সঙ্গে দুঃসহ, দমবন্ধ নাগরির জীবন থেকে উন্মুক্ত হাওয়ায় নিজেকে ফিরে পাওয়ার লোভ, আকুতিও থাকে।
আয় আর সম্পদ বৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের সামাজিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতেও বদল ঘটে। যা তার গভীর বোধকে অগভীর করে ফেলে। সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব বা রীতিনীতি পালনে আনুষ্ঠানিকতা বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। যে কারণে ধর্মীয় চর্চা বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে দেশে যে ব্যাপক বিনিয়োগ হচ্ছে তার সুফল মিলছে না। বরং উল্টো মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। পদে পদে দুর্নীতি, অনিয়ম, রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ, পাচার ব্যাপকহারে বেড়েছে।
ধর্মীয় উৎসবের সর্বজনীন অনুভূতির সুযোগ নিচ্ছেন এখন অনেক রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীও। রাজনৈতিক নেতা বা শিল্পপতিদের অনেকে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মোহাচ্ছন্নতার মধ্যে নিজেদের মেলে ধরেন। অনেকে গ্রামে ফিরে ঈদগাহে যান, সবার সঙ্গে কোলাকুলি করেন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক ব্যাপক দানধ্যান করেন। মসজিদ, মাদ্রাসা, ঈদগাহ নির্মাণে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেন। যাতে তার সামাজিক মর্যাদা বহুগুণ বেড়ে যায়। এসবের মধ্য দিয়ে হয়তো অনেক রাজনীতিক, ব্যবসায়ী বা শিল্পপতি তাদের ব্যক্তিগত দুর্নীতি, অনিয়মের দায়মুক্তি ঘটানোর পথরেখা আবিষ্কার করে ফেলেন।
এভাবে সামাজিক মূল্যবোধের অবনমন থেকেই মূলত আমাদের ব্যক্তি ও সামষ্টিক জীবনে ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবের রঙে বদল ঘটেছে। ধর্মীয় রীতিনীতির যে ফ্রেম সেটা ঠিকই থাকছে, শুধু বদলে যাচ্ছে অনুভূতির গভীরতা, অন্যের সঙ্গে দুঃখ, আনন্দ ভাগাভাগির বদলে আমরা হয়ে উঠছি এককেন্দ্রিক। বিদ্বেষ, ব্যক্তি স্বার্থপরতা, হিংসা থেকে আমাদের বিরত করতে পারছে না ধর্মীয় বিধি-বিধান, প্রথা, রীতিনীতি।
ফলে শুধু আনুষ্ঠানিকতাই বাড়ছে, গভীর অনুভূতিতে কোনো রেখাপাত করছে না। যে কারণে অতীত বার বার ফিরে আসছে আমাদের সামনে। বদলে যাওয়া আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় আধুনিক মূল্যবোধ বিনির্মাণে যে পথরেখা প্রয়োজন তা থেকে অনবরত পিছিয়ে পড়ছি আমরা।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, সংবাদ প্রকাশ