এক দিনের হরতালের পর ৩১ অক্টোবর থেকে তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচি শুরু হয়েছে। ২৮ তারিখের সমাবেশে পুলিশ-বিএনপি কর্মীদের সংঘর্ষে এক পুলিশ সদস্য ও এক যুবদল নেতা মারা যান। এর পরপর শুরু হয় ধরপাকড়, বিএনপির শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতার বাসায় পুলিশ হানা দেয় এবং দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদিকে অবরোধকে কেন্দ্র করে সারা দেশে ধরপাকড় ও বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে।
গত কয়েক দিনের ঘটনায় জনমনে এই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যে আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশ নতুন করে সংঘাতের দিকে চলে যাচ্ছে না তো?
প্রথমত, মূল্যস্ফীতির কারণে এমনিতেই শ্রমজীবী মানুষসহ সীমিত আয়ের মানুষের অবস্থা শোচনীয়। কোনোভাবেই তারা বাজার পরিস্থিতির সঙ্গে পেরে উঠতে পারছেন না। এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সহিংসতা, অবরোধ-হরতালের মতো ঘটনা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলবে। দেশের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা হুমকির মধ্যে পড়ে যাবে।
এদিকে সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ইস্যুতে আমেরিকাসহ পশ্চিমারা ভিসা নীতি প্রয়োগসহ নানাভাবে অব্যাহত চাপের মধ্যে রেখেছে সরকারকে।
সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি এখন দেশে গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। ফলে নির্বাচন ও মানবাধিকার বিষয়ে আমেরিকার অবস্থান গণ-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মিলে গেছে। তার মানে এই নয় যে আমেরিকা মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
অতীতের কথা বাদ দিলেও চলমান ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল ইস্যুতে মানবাধিকার নিয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট। দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের ভূরাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য নির্বাচন ইস্যুটা তাদের জন্য অস্ত্র হয়ে ওঠে। ফলে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হলে বা তা দীর্ঘায়িত হলে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর সুযোগই কেবল বৃদ্ধি পাবে না, দেশের অর্থনীতিও হুমকির মুখে পড়ে যাবে, যা কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না।
দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির জন্য গণতন্ত্র ও সুশাসনের কোনো বিকল্প নেই। আর গণতন্ত্রের প্রথম ধাপই হচ্ছে নাগরিকদের ভোটাধিকার প্রয়োগের স্বাধীনতাি। গত পনেরো বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিশেষত যোগাযোগ ও অবকাঠামো ক্ষেত্রে বড় ধরনের উন্নয়ন হলেও দুর্নীতি এবং দুর্নীতির মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাঠানো, ডলার সংকট, ব্যাংক খাতে নৈরাজ্য, মূল্যস্ফীতি, রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাস, রিজার্ভ তলানিতে নেমে যাওয়া, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে কণ্ঠরোধ—প্রভৃতি ঘটনায় দিন শেষে উন্নয়নের সাফল্য চাপা পড়ে গেছে বা যাচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে বাইরের কারও চাপ বা অন্য কোনো কারণে নয়, আমাদের নিজেদের স্বার্থে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন জরুরি। কীভাবে উদ্ভূত সমস্যা নিরসন করা যাবে, সে ফর্মুলা নিজেদেরই বের করতে হবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দেশের রাজনীতিতে প্রধান দুই শক্তি, জনগণ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে—এই বাস্তবতাকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। এই বাস্তবতায় বিএনপি কোনো কারণে নির্বাচনে অংশ না নিলে বা নেওয়ার মতো পরিস্থিতি না থাকলে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য করানো যাবে না। বিএনপির মতো দলকে নির্বাচন কাঠামো থেকে দূরে রাখার ঝুঁকি অনেক অনেক বেশি, যা দীর্ঘ মেয়াদে স্থিতিশীলতার জন্য সহায়ক হবে না।
এই পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ সরকারকেই তৈরি করতে হবে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ফর্মুলা সরকারকেই বের করতে হবে। এবং তা করতে হবে অতি অল্প সময়ের মধ্যে।
লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা