২০২৪ সালে বিশ্ব অর্থনীতি এখনো ২০২০ সালের করোনা মহামারি ও এর অভিঘাত জটিলতার প্রভাব মোকাবিলা করছে, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি। এ অবস্থায় বৈশ্বিক মন্দা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় যখন উন্নত দেশগুলো আর্থিক নীতিমালা সহজ করছে, তখন উন্নয়নশীল দেশগুলো ঋণনির্ভর বিনিয়োগে জোর দিচ্ছে। এ রকম এক প্রেক্ষাপটে সংকটজনক এক অর্থনীতি হাতে পাওয়া বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি, বাজার তদারকির মাধ্যমে উচ্চ মূল্যস্ফীতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে, ব্যাংক খাতে তারল্য সহায়তা দিয়ে খাতটির অসুস্থ দশা কাটানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু অর্থনীতির অনেক সূচকে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন আসেনি। গতিহীন-স্থবির এই অর্থনীতিকে পুরোপুরি বিপর্যয়গ্রস্ত বলা না গেলেও বড় ধরনের সংকট ও অনিশ্চয়তা বিরাজ রয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার অত্যাধিক ব্যয়ের ধারা মানুষকে উদ্বিগ্ন করছে। রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ই কেবল দেশের অর্থনীতিকে ধসের হাত থেকে রক্ষার চেষ্টা করছে। আর সব খাতই মোটামুটি নির্জীব-অনিশ্চিত হয়ে পড়ে আছে। বছরের ঠিক মাঝামাঝি সময়ে এসে দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া একের পর এক মানবসৃষ্ট সামাজিক-রাজনৈতিক ঝড় অর্থাৎ গণ-অভ্যুত্থান ও এর অভিঘাত এবং প্রকৃতি ও প্রতিবেশী দেশসৃষ্ট একাধিক বন্যা-বিপর্যয়ে অর্থনীতির এমনতর হাল হওয়া অস্বাভাবিক না হলেও অর্থনীতিতে বিদ্যমান নেতিবাচক প্রবণতা ও অনিশ্চয়তা কাটাতে সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে সামষ্টিক অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোতে মনোযোগ দিতে হবে। বার্ষিক অর্থনীতির সংক্ষিপ্ত এই খেরোখাতা নিয়েই বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০২৫ সালে পদার্পণ করছে।
বাংলাদেশের ২০২৪ সালের অর্থনীতি কেমন গেছে, ২০২৫ সালের অর্থনীতি কেমন হতে পারে তা নিয়ে আলোচনার আগে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করা জরুরি। কেননা, এতে করে বছরজুড়ে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির কাঠামোগত অবস্থা বোঝা সহজতর হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা বোঝাতে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি সম্পর্কে সাধারণত সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়-বিভাগ-সংস্থার পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি কথা বলে, নানা তথ্য দেয়। মূলধারার অর্থনীতিবিদরা এদের দেওয়া প্রবৃদ্ধির তথ্যকে নির্ভরযোগ্য ধরে নিয়ে নানা বিশ্লেষণ-পর্যালোচনা উপস্থাপন করেন। ২০২৪ সালের শেষপর্যায়ে এসে এখন অনেকের মনে হচ্ছে, গত ১৫-১৬ বছর ধরে প্রবৃদ্ধি ও অর্থনীতির নানা সূচকের ভুল-ভাল তথ্য ও পরিসংখ্যান সবকিছুই পণ্ডশ্রম করে দিয়েছে। কেননা বাংলাদেশের সরকার ও পরিসংখ্যান বিভাগ দেড় যুগ ধরে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তথ্য হাজির করেছে। দুষ্ট-স্বার্থপর রাজনীতি ও সরকার ব্যবস্থার বাংলাদেশে এটি অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু উন্নত দেশে সৃষ্ট বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি সরকারের তথ্য কারচুপির বিষয়টি জেনেবুঝেও নীরব থেকেছে এই অজুহাতে যে, পরিসংখ্যানের জন্য তারা কর্মরত দেশের তথ্যের ওপর নির্ভর করে। প্রকৃত সত্য হলো, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়া এসব আর্থিক সংস্থা চলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ইশারায়, যাদের জল-স্থল-আকাশ-বাতাস সম্পর্কিত কোনো তথ্যই অজানা নয়। অথচ এরাই উন্নয়নশীল বিশ্বের দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তথ্য-পরিসংখ্যানকে ঢাল হিসেবে জেনেবুঝেই ব্যবহার করে। কারণ, এতে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ঋণের ফাঁদে আবদ্ধ করা সহজ হয়।
উদাহরণস্বরূপ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের জিডিপি ৬ দশমিক ৬ থেকে ৫ দশমিক ১ শতাংশে অবনমন করে এবং বিশ্বব্যাংক অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২৫) বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশ, অর্থনীতি ঠিকমতো না চললে ৩ দশমিক ২ শতাংশ এবং খুব ভালো চললে সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ২ শতাংশের আভাস দিয়েছে (গত এপ্রিলে বিশ্বব্যাংক ৫ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিল)। এরপর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) অক্টোবরের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়াতে পারে প্রক্ষেপণ করে, পাশাপাশি উচ্চ মূল্যস্ফীতি বহাল থাকবে বলে জানায়। কিন্তু এর আগে চলতি বছরের এপ্রিলে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল এই আইএমএফ-ই। এই আইএমএফ-ই ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৪ শতাংশ হতে পারে বলে প্রক্ষেপণ করেছিল, এখন চলতি অর্থবছরের জন্য যা ৪ দশমিক ৫ শতাংশের দাঁড়াতে পারে বলছে। আবার এ কথাও সংস্থাটি বলছে, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে দাঁড়াবে। এর পরের দুই অর্থবছরেও যথাক্রমে ৬ দশমিক ৭ ও ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হবে। গতিহীন, স্থবির ও ম্রিয়মাণ অর্থনীতি ও নানামুখী সংকটে কীভাবে এতটা ভালো প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে, যখন সামষ্টিক অর্থনীতির সব সূচকই খারাপ চলছে।
দেশের সংকটজনক অর্থনীতি হাতে পাওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নানামুখী চাপে অর্থনীতির হাল ফেরাতে পারছে না, স্বভাবতই প্রবৃদ্ধি কমতে পারে। কিন্তু ২০২০-২১ অর্থবছরে করোনার আঘাতে বিপর্যস্ত অর্থনীতি নিয়ে যখন অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত তাঁর গবেষণায় বলছিলেন, “আমাদের হিসেবে আগামী অর্থবছরে‒ অর্থাৎ জুলাই ২০২০-জুন ২০২১‒ সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধি ১.৫০ শতাংশের বেশি হবে না; আর ২০২২ সালে ২.০০ শতাংশ হতে পারে” তখন তৎকালীন সরকার বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিয়ে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির দাবি করেছিল। অথচ অতি প্রভাবশালী বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি এই দাবি নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। তথ্যে অসংগতি এরও একদশক আগে থেকে চললেও এসব সংস্থা মুক্তহস্তে ঋণকার্যক্রম চালিয়ে গেছে। এমনকি ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারিতে আইএমএফের নির্বাহী বোর্ড বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। ২০২৬ সাল পর্যন্ত এই ঋণ কর্মসূচিতে বাংলাদেশকে বিভিন্ন ধরনের শর্ত পরিপালন ও সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। সর্বশেষ গত জুনে তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের পর সব মিলিয়ে ঋণের এই ঋণের ২২৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার এসেছে।
সবমিলিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের মাথাপিছু বিদেশি ঋণ ১৩৫ শতাংশ বেড়ে ৬০৫ ডলারে দাঁড়িয়েছে, অর্থাৎ সদ্যই জন্ম নেওয়া শিশুটির মাথার ওপরও ৭২,৬০০ টাকার বিদেশি ঋণ। অথচ এসব অর্থের বেশির ভাগই উন্নয়নকাজের নামে লুটপাট হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর আইএমএফের কাছে চলমান কর্মসূচির অতিরিক্ত আরো কয়েক বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়ে আবেদন করেছে, যা নিশ্চিতভাবেই পাওয়া যাবে। এর সঙ্গে আবার বিশ্বব্যাংক-এডিবির ঋণও যোগ হচ্ছে, হবে। এতে তো বাংলাদেশের কাঁধে ঋণের বোঝা কেবলই বাড়ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অনেকটা ঠেকায় পড়ে ঋণ নিচ্ছে। প্রাপ্ত ঋণ কীভাবে ব্যয় হচ্ছে, তা পরে জানা যাবে। কিন্তু বিগত দেড় যুগ ধরে সামষ্টিক অর্থনীতির এত এত দুর্বলতার পরও বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-এডিবি মুক্তহস্তে যে ঋণ দিয়ে গেছে এবং সেসব অর্থ যে লুটপাট ও পাচার হচ্ছে, তা কি এসব সংস্থা বুঝতে পারেনি। অবশ্যই পেরেছে। তারপরও দিয়েছে। কারণ, এর মাধ্যমে দরিদ্র ও সংকটগ্রস্ত দেশগুলোকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নিয়ন্ত্রণ করা সহজতর হয়েছে।
দেড় দশকে সরকারি কেনাকাটা থেকে আড়াই লাখ কোটি টাকা যে ঘুষ খেয়েছেন রাজনীতিবিদ ও আমলারা, উন্নয়ন প্রকল্প থেকে যে লুটপাট হয়েছে পৌনে ৩ লাখ কোটি টাকা আর শেয়ারবাজার থেকে আত্মসাৎ যে ১ লাখ কোটি টাকা বেহাত হয়েছে, এসবের ভাগ ও সুবিধা বিদেশি আর্থিক সংস্থাগুলোও পেয়েছে। তারপরও অর্থনৈতিক সংকটে অন্তবর্তীকালীন সরকার যখন উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেও টাকা ছাপিয়ে দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকে তারল্য জোগাচ্ছে, তখন বিদেশি ঋণের সুদ আসলসহ ঠিকই পরিশোধ করতে হচ্ছে। এ যেন হীরক রাজার দেশের ‘ভরপেট না-ও খাই রাজকর দেওয়া চাই’। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসের বিদেশি ঋণ পরিস্থিতি হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলেছে, অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে সুদ ও আসল মিলিয়ে ১১২ কোটি ৬৫ লাখ ডলার পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে, এ সময় বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশের কাছ থেকে ৮৪ কোটি ৬১ লাখ ঋণ ছাড় করানো সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ বিপর্যস্ত তিন মাসে ঋণ ছাড়ের চেয়ে ঋণ পরিশোধ প্রায় ২৮ কোটি ডলার বেশি ছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে উন্নয়ন সহযোগী নামে এসব সংস্থা কয়েক শ কোটি ডলার বাজেট সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু অর্থছাড় দূরের কথা, ঋণ পরিশোধ হার ক্রমশ বাড়ছে। চারদিকে যখন সংস্কারের ডাক উঠেছে, এসব সংস্থার আচরণ ও এদের সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রেও যেন কিছুটা সংস্কার আসে। কারণ দিনশেষে ঋণের অর্থ পইপই করে পরিশোধ করে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মেহনতি মানুষ, যারা এখন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির জেরে চারদিকে অন্ধকার দেখছে।
২০২৪ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি সামগ্রিকভাবে মাঝারিমানে স্থিতিশীল থাকলেও বৈশ্বিক ও আভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের প্রভাব স্পষ্ট ছিল। এ সময় বৈশ্বিক মন্দা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে ৫.৭৮ শতাংশে থাকার প্রবণতা দেখালেও পরে অনেক কমে এসেছে। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়ে বছরজুরে গড়ে ৯ শতাংশ চলমান থেকে বছরের শেষ সময়ে এসে দুই অংকের ঘরে প্রবেশ করেছে, যা খাদ্য-জ্বালানি ও জীবনযাত্রার মানে গুরুতর প্রভাব ফেলেছে। বৈদেশিক রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের ধারা অব্যাহত থাকায় অর্থনীতি কিছুটা স্থিতিশীল আছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রাজস্ব ও মুদ্রানীতি সংস্কার, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলো অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় ভূমিকা রাখছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে উন্নয়ন খাত অগ্রাধিকারে ছিল, যার লক্ষ্য ছিল বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি। কিন্তু এ দুটি খাতের অবস্থা আরও সঙ্গিন হয়েছে। এ অবস্থায় বলা চলে, বাংলাদেশের অর্থনীতি ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখালেও মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যাংক খাতে বড় ধরনের সংস্কার শুরু হয়েছে, যেখানে অসুস্থতার মাত্রা, খেলাপি ঋণ ও মার্কিন ডলারের সংকট মেটানো অন্যতম লক্ষ্য ছিল। এতে এই খাতের ওপর আস্থা ফিরে আসার লক্ষণ দেখা গেছে, রিজার্ভের পতনও আটকানো গেছে। কিন্তু আর্থিক খাতে আমলাদের দৌরাত্ম্যে সংস্কারপ্রক্রিয়ার গতি ও লক্ষ্য অর্জনে বাধাগ্রস্ত হওয়ার লক্ষণ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সামগ্রিকভাবে ২০২৪ সালে প্রথাসিদ্ধ অর্থনীতি শাস্ত্রে সামষ্টিক অর্থনীতি বলতে যা বোঝানো যেমন মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), মাথাপিছু জিডিপি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি হার, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ, মূল্যস্ফীতি, রাজস্ব খাত (রাজস্ব আহরণ, সরকারি ব্যয়, বাজেট ভারসাম্য ও অর্থায়ন), মুদ্রা ও আর্থিক খাত (মুদ্রানীতি ও মুদ্রা ব্যবস্থাপনা, মুদ্রা পরিস্থিতি, অভ্যন্তরীণ ঋণ, সুদের হার, পুঁজিবাজার), বৈদেশিক খাতের রপ্তানি ও আমদানি, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও রেমিটেন্স, বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ইত্যাদিও কোনোটিই ভালো যায়নি। বিনিয়োগ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত থমকে আছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, বছরের শেষ প্রাপ্তিকে এসে সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর কাজ চলছে, যা সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতার প্রবণতা সৃষ্টি করেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং আমলা-রাজনীতিবিদ-ব্যবসায়ীদের ত্রিমাত্রিক দুর্বৃত্তপনা রোধ করা গেলে অর্থনীতির আরোগ্য লাভ দ্রুততর হবে।
২০২৫ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি ফেরাতে হলে প্রধান রপ্তানি পণ্য পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে চামড়া, ওষুধ, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে রপ্তানি বাড়াতে হবে; নতুন বাজার অনুসন্ধান ও ভ্যালু অ্যাডেড পণ্যের উৎপাদনে মনোযোগ দিতে হবে; বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর উন্নয়ন ও সহজ ব্যবসা পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে; আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি করতে হবে; কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে জোর দিয়ে প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে তরুণদের দক্ষ করে তুলতে হবে ফ্রিল্যান্সিং ও স্টার্টআপ সংস্কৃতি জোরদারের মাধ্যমে; কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ, কৃষকদের সহায়তা বৃদ্ধি ও খাদ্যসরবরাহ শৃঙ্খলকে উন্নত করতে হবে; মুদ্রাস্ফীতি-মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর নীতি গ্রহণ, রেমিট্যান্স বৃদ্ধির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনরুদ্ধার করতে হবে এবং সর্বোপরি পরজীবী-ফাউখাওয়া রাজনীতিবিদ-আমলা-ব্যবসায়ীদের কঠোর হাতে দমন করতে হবে। সুপরিকল্পিত ও সৎ মানসিকতায় এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশে ২০২৫ সালে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধি অর্জন করা খুবই সম্ভব। ঘটনাবহুল ও কষ্টকর পুরোনো বছরটি পেছনে ফেলে সাফল্য ও সম্ভাবনার সুবাতাস নিয়ে নতুন বছরটি শুরু হোক, সে প্রত্যাশাই রইল।
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি