সদ্য প্রয়াত ড. আকবর আলি খানের পরিচয় এককথায় বা কিছু শব্দে প্রকাশ করা কঠিন। যেমনটি দৈনিক প্রথম আলোয় উল্লেখ করা হয়েছে, সে রকমভাবে তাঁকে যদি এককথায় প্রকাশ করতে হয়, তাহলে বলতেই হবে যে তিনি ছিলেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক নাগরিক। আমার মতো একজন নগণ্য মানুষের পক্ষে তাঁকে নিয়ে যেকোনো ধরনের আলোচনা ধৃষ্টতা প্রকাশের শামিল বলে আমি মনে করি। তারপরও কথা থেকে যায়। কোনো একজন লেখকের একটি বই যখন অনেকগুলো মানুষের ভাবনার জগৎটাকে বদলে দেয়, সে ক্ষেত্রে সেসব মানুষের তরফে শ্রদ্ধা নিবেদনে দুকথা লেখার দুঃসাহস করা যেতেই পারে। সে ভাবনা থেকেই এই লেখার অবতারণা।
ড. আকবর আলি খানের লেখার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৯৭ সালে, তাঁর সদ্য প্রকাশিত বই ডিসকভারি অব বাংলাদেশ : এক্সপ্লোরেশন্স ইন টু ডায়নামিক অব আ হিডেন নেশন -এর সূত্রে। আমি তখন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্র্যাজুয়েট-টিউটর বা জুনিয়র লেকচারার হিসেবে সদ্য যোগ দিয়েছি এবং প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ইতিহাসবিদ এ এফ সালাউদ্দিন আহমদ স্যারের তত্ত্বাবধানে বিশ্ববিদ্যালয়টির ফাউন্ডেশন কোর্সের অধীন ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল কালচার অ্যান্ড হেরিটেজ’ শীর্ষক এক কোর্সের পাঠ্যক্রম বা সিলেবাস ও কোর্স আউটলাইন প্রণয়নে সহায়তা প্রদান করছি। এ সময় সালাউদ্দিন আহমদ স্যার একদিন উল্লিখিত বইটি আমাদের দিয়ে বললেন, পড়ে দেখো, এই বই ইতিহাসচর্চায় এক বাঁকবদল ঘটাবে। পাশাপাশি তিনি আমাদের উপদেশ দিয়ে বললেন, বইটির অধ্যায়গুলো অনুসরণ করে আমাদের আলোচ্য কোর্সটির আউটলাইন প্রণয়ন করতে। প্রকৃতপক্ষেই, এই একটিমাত্র বই দিয়েই তিনি এ দেশের ইতিহাসচর্চায় এক নতুন মাত্রা যোগ করতে পেরেছেন এবং এই একটিমাত্র বই ড. আকবর আলি খানকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে যথেষ্ট বলে আমি বিশ্বাস করি!
এই বইয়ে তিনি পদ্ধতিগতভাবে থিওরি বা তত্ত্ব ব্যবহার করে, একটি ফ্রেমওয়ার্কের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক বিবর্তন বর্ণনার পাশাপাশি এ দেশের সামাজিক অবকাঠামোর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যপ্রণালি তুলে ধরেছেন। এই বইয়ে তিনি গ্রামীণ অবকাঠামোর ব্যবচ্ছেদ করে এর অন্তর্নিহিত চালিকাশক্তিগুলো চিহ্নিত করেছেন। তিনি এ দেশে ইসলাম ধর্ম প্রসারে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতার কথাও এখানে উল্লেখ করেছেন।
তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম সরাসরি কথা বলার সুযোগ ঘটে ২০০৭ সালের দিকে; যখন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা। আমার বড় ভাবির গুরুস্থানীয় আত্মীয় হিসেবে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে এই অমায়িক, প্রজ্ঞাবান ও সজ্জন মানুষটির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সুযোগ ঘটে। সেই সঙ্গে আরও জানতে পারি, বৃহত্তর পারিবারিক মণ্ডলেও এই অনন্য মানুষটির দায়িত্ববোধের কথা।
এ ছাড়া তাঁর মতো আমিও উচ্চমাধ্যমিকে ঢাকা কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ছিলাম –এ কারণেও বিশেষ গর্ব বোধ করি বৈকি।’
আমি ড. আকবর আলি খানের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।
তিনি আমাদের মাঝে নেই; কিন্তু তাঁর জনস্বার্থ ও কল্যাণমুখী চেতনা আমাদের উত্তর-প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়বে—এই প্রত্যাশা।