আজ ১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৩ বছর আগে ১৯৭১ সালের এই দিনে আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা।
বিজয়ের একেবারে অন্তিম সীমায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে যারা এঁদের তুলে নিয়ে এসেছিল, তারা কিন্তু ভিনদেশি সৈনিক নয়, এ দেশেরই মানুষ—কিংবা মানুষরূপী পশু। তাদের হাত কাঁপেনি এই সব সোনার মানুষদের চোখ বেঁধে দিতে, ঠোঁট কাঁপেনি সেই মিথ্যা আশ্বাস দিতে, ‘আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাব’, বুক কাঁপেনি এই সব নরম মনের মানুষদের আঘাত করতে। না, তাঁরা ফেরেননি, সেই দিনও না, কোনো দিন না আজতক। বধ্যভূমিই হয়েছে তাঁদের শেষসজ্জা।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমার তিন দল মানুষের কথা বড় মনে হয়। যাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তাঁদের কথা, বড় বেদনার সঙ্গে। সেই সব শহীদের সন্তানদের, যাঁদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাঁদের কথা—বড় মমতার সঙ্গে, এবং সেই সব হন্তার কথা, যারা এমন পাশবিক কাজ করে আদও বহাল তবিয়তে আছে—তীব্র ঘৃণার সঙ্গে।
আমার প্রায়ই মনে হয়, ১৪ ডিসেম্বর আমি নির্মমভাবে বঞ্চিত হয়ে পড়েছি। ভাবতেই পারি না যে আমার প্রাণপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হিরণ্ময় কিছু মানুষকে আর দেখতে পাইনি কিংবা পাব না, বহু প্রিয় লেখকের নতুন লেখা আর পড়তে পাব না, অনেক সংগীতশিল্পীর কণ্ঠ আর সামনাসামনি শুনতে পাব না। আমরা অনেকেই এই সব স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষকে ঠিক চিনকে পারিনি, পাকিস্তানিরা কিন্তু ঠিকই পেরেছিল। বাংলাদেশের সৃষ্টশীলতা আর সৃজনশীলতার ভিত্তি গুঁড়িয়ে দিতে, আমাদের দেশের শিক্ষা ও শিল্প-সাহিত্যকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যই তারা বেছে নিয়েছিল এই সব অনন্যসাধারণ মানুষদের। মানুষ চিনতে ওরা ভুল করেনি।
অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, লাখ লাখ নিহত মানুষের মধ্যে কেন বারবার শুধু শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা উঠে আসে। আমার মনে হয়, এর উত্তর দুটো। একটি প্রত্যক্ষ আর অন্যটি পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ কারণটি হচ্ছে, এ মানুষগুলো আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির জগতের অনন্য কিছু মানুষ ছিলেন, যাঁদের স্বপ্নদৃষ্টি, দিক্দর্শন, চিন্তাভাবনা, শিক্ষা ও পরামর্শ আমাদের অনুপ্রাণিত করছেন প্রতিনিয়ত। তাই আমাদের হৃদয়ে তাঁদের জন্য বিশেষ স্থান আছে। পরোক্ষ কারণটি হচ্ছে, আমদের মতো সাধারণ মানুষেরা বহু শহীদের স্মৃতি একসঙ্গে হৃদয়ে বহন করতে পারে না। তখন আমরা প্রতীক খুঁজে নিই। ১৪ ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা আমাদের সেই প্রতীক। এই প্রতীকের মাঝখান দিয়েই আমরা পৌঁছে যাই অন্য সব জানা-অজানা শহীদদের কাছে।
একাত্তর-উত্তর সময়ে শিক্ষক হিসেবে আমার সুবর্ণ সুযোগ ঘটেছিল উপর্যুক্ত শহীদদের অনেকেরই সন্তানদের সঙ্গে—বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়াতে গিয়ে দেখি যে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী হিসেবে বসে আছে মিতি (শহীদ চিকিৎসক ডা. মর্তুজার কন্যা), শোভন ও সুমন (শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জেল হায়দার চৌধুরীর পুত্র), তৌহীদ (শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের পুত্র)।
শিক্ষার্থী হিসেবে নয়, কিন্তু অন্যভাবেও কাছে পেয়েছি অন্য শহীদ-সন্তানদের। বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়তার বৃহত্তর অঙ্গনে কাছাকাছি এসেছি ভাষণ, প্রয়াত মিশুক আর তন্ময়ের সঙ্গে—শহীদ মুনীর চৌধুরীর সন্তানদের সঙ্গে। অবয়ব পত্রের মাধ্যমে পরিচিত হয়েছি মাহমুদার সঙ্গে (শহীদ অধ্যাপক সিরাজুল হক খানের সন্তান)। অতি সম্প্রতি পরিচিত হয়েছি মাহমুদের সঙ্গে—শহীদ অধ্যাপক রাশীদুল হাসানের পুত্র সে।
সেই সঙ্গে এটাও মনে হয়েছে, সেদিনের যে শিশু, কিশোর-কিশোরীরা পশুশক্তির কাছে তাদের বাবাকে হারিয়েছে, তারা আজ পরিণত বয়সের মানুষ। তাদের মনে পিতৃ-হারানোর বেদনা আমরা কেউ বুঝব না— কারণ সব দুঃখই তো মানুষের ব্যক্তিগত, সব বেদনাই তো তার নিজস্ব। কিন্তু এটা তো বুঝি যে তাদের পিতার হন্তাদের ‘বিচারের দাবি তাদের মনে নিভৃতে কাঁদে’ অহর্নিশ।
যারা আমাদের সূর্যসন্তানদের হত্যা করেছিল ১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বর, সেই সব খুনি আজও বহাল তবিয়তে আছে পৃথিবীর নানান জায়গায়, ঘুরে বেড়াচ্ছে স্বাধীন মানুষ হিসেবে। এ লজ্জা, এ ক্ষোভ কোথায় রাখি? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মানির ছয় লাখ ইহুদি হন্তা পলাতক আইকম্যানকে যদি প্রায় সাত দশক আগে আর্জেন্টিনা থেকে ধরে ইসরায়েলে নিয়ে গিয়ে তার বিচার করা যায়, তাহলে আজকের আধুনিক জগতে আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবী খুনিদের কেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ধরে এনে বাংলাদেশের মাটিতে বিচার করা যাবে না।
শহীদ বুদ্বিজীবীদের হত্যাকারীদের বিচার ভিন্ন কোনো পথ নেই—শুধু ন্যায্যতার কারণে নয়, শুধু মানবিকতার কারণেও নয়, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার শান্তির জন্য, শহীদ-সন্তানদের অন্তরের বিচারের দাবি মেটানোর জন্য এবং জাতি হিসেবে আমাদের দায়মুক্তির জন্য। সে দায় রাষ্ট্রের, সমাজের ও ব্যক্তিমানুষের।