ইতিহাসের রক্তস্নাত দিন হিসেবে ১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখটিকে মনে রেখেছে কয়জন? ভালোবাসা দিবস আর ফাল্গুনের হাওয়ায় কি হারিয়ে যেতে বসেছে ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’? ইতিহাসের অনেক কিছুই অস্পষ্ট হয়ে যায় স্মৃতিতে। কিন্তু স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস কি ভুলে যাওয়ার মতো? এর প্রাসঙ্গিকতা কি হারিয়ে গেছে? ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে অপূর্ণতার কারণে আজ প্রজন্মের সামনে ছাত্র সমাজের উজ্জ্বল সেই দিনটির কথা অস্পষ্ট। কী ঘটেছিল সেই দিনটিতে? কেনই বা দিবসটি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?
বলা হয়, ছাত্র সমাজের জন্য এক কলঙ্কময় দিন—১৪ ফেব্রুয়ারি। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস হিসেবে পৃথিবীব্যাপী পরিচিত হলেও আমাদের দেশের ইতিহাসে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ১৯৮৩ সালের এদিন। সেই বছরের এই দিনে ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে ঢাকার রাজপথ। তারা সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল বুকের তাজা রক্ত ঢেলে।
গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয় তাদের, সেদিনের শহীদ দিপালী সাহা, জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, আইয়ূব, কাঞ্চনসহ নাম না জানা অসংখ্য শহীদকে। একে বলে ফাগুনে আগুন। ভালোবাসার প্রাণ এই বাংলা। সেই ভালোবাসার কল্যাণেই এই মাটির ইতিহাস কখনোই ভুলবার নয়।
১৯৮২ সালে বাংলাদেশে তৎকালীন সামরিক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খানের ঘোষিত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। ছাত্রসমাজের দাবি ছিল একটি অবৈতনিক বৈষম্যহীন শিক্ষানীতি। কিন্তু ড. মজিদ খান যে নীতি ঘোষণা করেন, সেখানে বাণিজ্যিকীকরণ আর ধর্মীয় প্রতিফলন ঘটেছে বলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন। তাই শুরু থেকেই ওই নীতির বিরোধিতা করতে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা।
সে বছর ১৭ সেপ্টেম্বর ওই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের বিষয়ে একমত হয় ছাত্র সংগঠনগুলো। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৩ সালের ১১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বটতলায় সমাবেশ ও সচিবালয় অভিমুখে মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করে। সেদিন সকালে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী যখন বটতলায় সমবেত হয়েছে তখন কেন্দ্রীয় নেতারা অনিবার্য কারণবশত কর্মসূচিটি পালন করা যাবে না বলে সিদ্ধান্ত দেন। ছাত্র-ছাত্রীরা সেটি মানলেন না। সেদিনই বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের হাতে বটতলায় নেতারা লাঞ্ছিত হলেন। পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হলো ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটিতে বটতলায় সমবেত হয়েছিল জীবনবাজি রেখে সামরিক স্বৈরাচারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা। অকুতোভয় ও শেকলভাঙা ছাত্রসমাজ কার্জন হলের মুখে সামরিক জান্তার পুলিশের বাধার মুখে পড়ে। কিন্তু জান্তার কী সাধ্য সেই দুর্বার আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য মিছিলকে প্রতিহত করার!
হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ মিছিলটি নিয়ে এগিয়ে যায়। হাইকোর্টের গেটের সামনে ব্যারিকেডের সামনে বসে পড়ে এবং ছাত্রনেতারা তারের ওপর উঠে বক্তৃতা শুরু করে। এ সময় পুলিশ বিনা উসকানিতে তারের একপাশ সরিয়ে রায়ট কার ঢুকিয়ে দিয়ে রঙিন গরম পানি ছিটাতে থাকে, বেধড়ক লাঠিচার্জ, ইট-পাটকেল ও বেপরোয়া গুলি ছুড়তে শুরু করে। গুলিবিদ্ধ হন জয়নাল। এরপর গুলিবিদ্ধ জয়নালকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়।
এ সময় দিপালীও গুলিবিদ্ধ হন এবং পুলিশ তার লাশ গুম করে ফেলে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিহত ও আহতদের অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে নিয়ে আসতে চাইলে ঘটনাস্থলে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। কিছু না ঘটা সত্ত্বেও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করা হয়েছে, এমন অপপ্রচার চালিয়ে সামরিক সরকার উসকে দেয় পুলিশকে।
ওইদিন নিহত হয়েছিল জয়নাল, জাফর, কাঞ্চন, দীপালীসহ আরও অনেকে। সরকারি মতেই গ্রেপ্তার করা হয় ১ হাজার ৩৩১ জন ছাত্র-জনতাকে, বাস্তবে এই সংখ্যা আরও বেশি ছিল। খোঁজ মেলেনি অনেকেরই। এই ঘটনার জোয়ার লাগে চট্টগ্রাম শহরেও। মেডিকেল ও অন্যান্য কলেজের শিক্ষার্থীরা মিছিল শুরু করে। সেখানে পুলিশ লাঠিচার্জ ও গুলি চালালে নিহত হয় কাঞ্চন। ছাত্রদের তিনটি মৌলিক দাবিতে ১৮ ফেব্রুয়ারি শিক্ষানীতি স্থগিত হয়ে যায়।
সেই কারণেই ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির পর এটাই ছিল ইতিহাসে লিখে রাখার মতো ছাত্রবিক্ষোভের এবং নিপীড়নের ঘটনা।
এ কাঙ্ক্ষিত আন্দোলন অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী এরশাদের পতন ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিজয় সূচনা করে। ৬ ডিসেম্বর এরশাদ আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন।
ইতিহাস সূর্যের আলোর মতো। সময়ের দূরবর্তীতে ইতিহাস তার নায়কদের প্রতিস্থাপন করে, আবার আদর্শিক জায়গায় ইতিহাস তার খলনায়কদের সরিয়ে নিতে ‘পিছ পা’ হয় না। প্রজন্ম সেই সাক্ষ্য দেয় এবং দেবে।
আজকের তারুণ্যকে জানতে হবে প্রিয়জনে ফুল ছড়িয়ে দেওয়া ভালোবাসার দিনটির আরেকটি অন্যরকম মহিমা আছে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে তারুণ্য-জাগানিয়া ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ বলে একটি দিন আছে। বিস্মরণের অতলে হারালেই কি ইতিহাসের সত্যকে নিশ্চিহ্ন করা যায়?