• ঢাকা
  • সোমবার, ০২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

দুর্নীতি ও সুশাসনের ঘাটতি মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়াচ্ছে


ড. মো. আইনুল ইসলাম
প্রকাশিত: মে ২৯, ২০২৩, ১২:১৭ পিএম
দুর্নীতি ও সুশাসনের ঘাটতি মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়াচ্ছে

দিনকয়েক আগে আমার এক পরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হতেই বলছিলেন, “স্যার, আমাদের মন্ত্রী-মিনিস্টার-এমপি-আমলারা কি ক্ষমতায় থাকলে এলিয়েন হয়ে যান?” আমি বললাম, কেন আবার কী হয়েছে? তিনি তার ব্যাগ থেকে বেশ কিছুদিন আগের একটি সংবাদের প্রিন্টকপি দেখিয়ে বললেন, “পড়ুন।” খাদ্যমন্ত্রীর উদ্ধৃতি নিয়ে সংবাদটির কিছু অংশ ছিল এ রকম, “বাজারে সব কিছু যদি বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়, যেমন, ডলারের দাম, উৎপাদন খরচ সবকিছু বিবেচনা করলে আমি মনে করি বৈশ্বিক এই সংকটে চালের দাম স্থিতিশীল আছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর যে হাহাকার নেই, এটাই আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া।” বাজারে নিত্যপণ্যের চড়া দামের কারণে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। এ বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, “সাধারণ মানুষের জন্য তো ওএমএস, কাবিখা আছে, আর অসাধারণের জন্য অ্যারোমাটিক, প্যাকেট, সিলকি আছে।” ভদ্রলোকটিকে আমি বললাম, আপনার ক্ষোভ সম্ভবত ‘অনেক বড় পাওয়া’ ‘হাহাকার নেই’ ‘ওএমএস’, ‘কাবিখা’ নিয়ে; অ্যারোমাটিক, প্যাকেট, সিলকি নিয়ে নয়। তিনি বললেন, “ঠিক ধরেছেন। আপনি বিষয়টি বুঝবেন বলেই নিউজ ক্লিপিংটি সংগ্রহে রেখেছি।” তার আশা, সাধারণ মানুষের কষ্টকর দিনযাপন নিয়ে যেন দু-চার কথা লিখি। আমি তাকে বললাম, চেষ্টা করব। আর মনে মনে ভাবলাম, এসব নিয়ে লিখে কী হবে? কে শোনে কার কথা। প্রধানমন্ত্রীর জনহিতকর অনেক নির্দেশনাই তো কেউ মানে না! তবু ভদ্রলোককে বললাম, “আসলে আমাদের নীতিনির্ধারকরা (যারা প্রায়ই সরকারি বা জনগণের টাকায় বিদেশ সফর করেন) মূল্যস্ফীতির চাপে ধনী দেশের মানুষদের বেকায়দায় থাকতে দেখে স্বল্পোন্নত বাংলাদেশের মানুষের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করেন, তাই তাদের কথাবার্তায় এমন এলিয়েন ভাব ফুটে ওঠে; মনে কষ্ট নেবেন না।” ভদ্রলোক ফোঁস করে বললেন, “স্যার, ক্ষমতায় না থাকলে এই এলিয়েন নীতিনির্ধারকদের চেহারায় আর জেল্লা-তেলতেলে ভাব দেখবেন না; যদিও তাদের প্রচুর ধনসম্পদ থাকবে। নিজের দল ক্ষমতায় না থাকলে এরা প্রথম সুযোগেই দেশ ছেড়ে পালাবেন। নিরাপদ মনে হলে তবেই দেশে ফিরবেন।” বুঝলাম, মূল্যস্ফীতির চাপে ভদ্রলোকের মনে তীব্র ক্ষোভ জমে আছে।

ভদ্রলোকটি চলে যাওয়ার পর মনে মনে ভাবছিলাম চাল ছাড়াও দৈনন্দিন জীবনে অপরিহার্য আটা, ডাল, বেকারি পণ্য, চিনি, মাছ, ডিম, দেশি ও ফার্মের মুরগি, গরুর মাংস, শাকসবজি, ভোজ্যতেল, মসলা, আমদানি ও দেশি ফল, চা, কফি, স্থানীয় ও আমদানি করা দুধ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সামগ্রী, স্বাস্থ্যসামগ্রী, পরিবহন খরচ সবকিছুর উচ্চ মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের ক্ষুব্ধ হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া কখন হয়? নিজেই নিজেকে উত্তর দিলাম। ক্রুদ্ধ হয় তখন, যখন দেখে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপানসহ ৭৫টি দেশকে পেছনে ফেলে দিয়ে অতিধনী বা ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির হারে সবার চেয়ে এগিয়ে থেকে প্রথম হয় বাংলাদেশ। ক্রুদ্ধ হয় তখন, যখন দেখে খ্যাতনামা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নিবিড় গবেষণার মূল্যস্ফীতির হার ৯-১০ শতাংশ তথ্যের বিপরীতে সরকারি সংস্থা বিবিএস বলে মূল্যস্ফীতি ৬-৭ শতাংশ। ক্রুদ্ধ হয় তখন, যখন দেখে হাড়ি-পাতিল ফেরি করে বেড়ানো পিতার প্রতারক সন্তানটি দু-তিন বছরের মধ্যেই দুবাইয়ে স্বর্ণের ব্যবসা খুলে গিনিজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম ওঠানোর প্রতিযোগিতায় নামে, আর সামান্য পানদোকানি ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে চুটিয়ে আমেরিকা-কানাডায় অ্যাপার্টমেন্ট ব্যবসা করে। এসব অনিয়মের কারণে মূল্যস্ফীতির প্রকৃত কারণ অনুধাবনে সাধারণ মানুষের আগ্রহ হয় না। তারা জানতে চায় না যে বাস-গাড়ি ও যন্ত্রনির্ভর শিল্প, কৃষিফসল উৎপাদনে ব্যবহার ছাড়াও মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য অন্তত ৭২টি পণ্যের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান বা কাঁচামালই হচ্ছে জ্বালানি তেল, যার মধ্যে রয়েছে—পারফিউম, হেয়ার ড্রায়ার, লিপস্টিক, মেকআপ, ফাউন্ডেশন, আইশ্যাডো, মাস্কারা, আইলাইনার, হ্যান্ড লোশন, টুথপেস্ট, সাবান, শেভিং ক্রিম, ডিওডোরেন্ট, চিরুনি, শ্যাম্পু, চশমা, কন্টাক্ট লেন্স প্রভৃতি। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে এগুলোর দাম কি আর বসে থাকবে। এমনিতেই আমদানি নির্ভর দেশ হওয়ায় ডলার সংকটে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে, তার ওপর ভবিষ্যতে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি মানুষের আর্থিক সক্ষমতা, ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে তাদের জীবনকে আর দুর্ভোগপূর্ণ করে তুলবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনাসংবলিত একটি পুরোনো সংবাদের সূত্রে ভদ্রলোককে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা মনে পড়ে গেল। খোলাবাজারে চাল, আটার মতো জরুরি খাদ্যপণ্য বিক্রির ওএমএস কার্যক্রমে ব্যবস্থাপনার ঘাটতি নজরে পড়ায় কার্ডের মাধ্যমে এই কার্যক্রম পরিচালনা করার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ভালো লাগল এই ভেবে যে, দুর্ভোগে পতিত মানুষের চাল-ডাল-আটা নিয়ে নয়ছয়ের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরেও পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী কার্ডের ব্যবস্থা করতে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনামাফিক রেশনিংয়ের কার্ডের ব্যবস্থা সরকার তো আগেই শুরু করেছে। ওই কার্ড দিয়ে কি প্রকৃত ও উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটির ভাগ্যে প্রতিশ্রুত পণ্য মেলে? আমার পরিচিত অনেকে আছেন, যারা কিছুটা সাশ্রয়ী মূল্যে সরকারি আটা, তেল ও ডাল পাওয়ার আশায় স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনারের কার্যালয় থেকে অনেক কষ্টে রেশন কার্ড সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু এ নিয়ে অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা হওয়ায়, সেসব কার্ড তারা ড্রয়ারেই ফেলে রেখেছেন। তাদের কথা হলো, রেশনিংয়ের পণ্য এখন ‘নয়টার ট্রেন কয়টায় ছাড়ে’ আর ‘কাজির গরু কাগজে আছে, গোয়ালে নেই’ প্রবাদের মতো হয়ে গেছে। তাদের অভিযোগ ওয়ার্ড কার্যালয় থেকে দেওয়া রেশনিংয়ের সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখ-সময় নেই; পণ্য আসে ১০০০ জনের, কার্ডধারী ৫০০০ জন; এই মাসে রেশনিং এই ডিলার দিল তো পরের মাসে ওয়ার্ড কার্যালয়ে, আবার দুয়েক মাস পর সেটা নারী কাউন্সিলের কার্যালয়ে। এভাবে দ্বারে দ্বারে ঘুরে আর নাকানিচুবানি খেয়ে উদ্দিষ্ট ব্যক্তি যখন রেশন কার্ডটি ড্রয়ারে ফেলে রাখেন, তখন তার প্রাপ্য আটা-ডাল-তেল-চিনি চলে যায় কাউন্সিলরদের পরিচিত স্থানীয় প্রভাবশালী ও বিত্তবান বাড়ির মালিকদের হাতে। আবার খোলা ট্রাক থেকে ২৫ টাকা কেজিদরে কেনা ১২৫ টাকার ৫ কেজি আটা ৫০ টাকা দরে ২৫০ টাকায় স্থানীয় মুদি দোকানে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। জনগণের করের পয়সায় ভর্তুকিমূল্যের সরকারি ওই চাল-ডাল-আটাই ১০-২০ টাকা লাভে ব্যবসায়ী বিক্রি করছেন কোনো নিম্নবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্তের কাছে, যিনি আবার অনেক দেনদরবার করে পাওয়া রেশন কার্ডটি বাধ্য হয়ে ড্রয়ারবন্দী করে রেখেছেন। ভুক্তভোগী মানুষটি তার বঞ্চিত হওয়ার যাবতীয় প্রক্রিয়ার সবই আয়োজনই দেখছেন। কিন্তু মনে মনে ক্রুদ্ধ হওয়া ছাড়া তার আর কিছু করার নেই। মূল্যস্ফীতির চাপে তীব্র কষ্টে থাকা মানুষদের কিছুটা স্বস্তি দিতে সরকারের এমন অনেক মহৎ উদ্যোগ আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অব্যবস্থাপনা আর মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে মাঠে মারা যাচ্ছে।

দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ঘোষণার পর থেকেই দেশে হুহু করে বেড়েছে দ্রব্যমূল্য। কিছুদিন আগে বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের নামে প্রতি মাসে বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। মানুষের চরম বিরক্তির কথা উপলব্ধি করে এখন এই বিদ্যুতের দাম ত্রৈমাসিক প্রক্রিয়ায় নেওয়া হচ্ছে। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কারণে অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরাও এখন নিয়ম করে পণ্যের মূল্য বাড়াচ্ছেন। দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের আমিষের জোগানের বড় উৎস আসে ডিম আর অনেকটা জোর করে দ্রুত বড় করা ব্রয়লার মুরগি থেকে, যার দাম অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। খাসি ও গরুর মাংসের দাম অনেক আগেই হাতের নাগালের বাইরে চলে গেছে দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষদের। এর মধ্যে ব্রয়লার মুরগির দাম বাড়ায় সীমিত আয়ের অনেক মানুষ মুরগির কাটা মাংস অথবা ধনীদের ফেলে দেওয়া গলা, গিলা পা কিনছেন। অতিরিক্ত দামে যারা মুরগি কিনতে পারছে না, এখন তারা গলা, গিলা আর পা দিয়েই আমিষের চাহিদা পূরণ করছেন। এক হিসেবে দেখা গেছে, ২০১৪ সালে ১ কেজি গরুর মাংসের গড় দাম ছিল ৩০০ টাকা, যা ২০২৩ সালের মার্চ মাসে এসে ৭৫০ টাকায় ঠেকেছে। খাসির মাংস প্রায় ১২০০ টাকা। গরু ও খাসির মাংস অনেক আগেই ধনী ও উচ্চবিত্তদের পাতে চলে গেছে, ব্রয়লার মুরগিও সেদিকে যাচ্ছে। অথচ দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই অতিদরিদ্র, দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণিভুক্ত। কোভিড-১৯ মহামারি আগে ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘পভার্টি অ্যান্ড শেয়ার প্রসপারিটি বা দারিদ্র্য ও সমৃদ্ধির অংশীদার-২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিশ্বের সবচেয়ে হতদরিদ্র ১০ দেশের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল পঞ্চম। এতে বলা হয়, যাদের দৈনিক আয় ১ ডলার ৯০ সেন্টের কম, তারা হতদরিদ্র (আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যরেখা), বাংলাদেশে তাদের সংখ্যা ২ কোটি ৪১ লাখ। বিশ্বব্যাংক ওই প্রতিবেদন মতে, “এভাবে হিসাব করলে বাংলাদেশে অতিগরিব মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৮ কোটি ৬২ লাখ। আর দারিদ্র্যের হার হবে ৫২ দশমিক ৯ শতাংশ। এর মানে হলো, টেকসইভাবে গরিবি হটাতে বাংলাদেশের প্রায় ৬ কোটি ২১ লাখ মানুষকে দ্রুত দৈনিক ৩ দশমিক ২ ডলার আয়ের সংস্থান করতে হবে।” অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা নিয়ে করোনা ভাইরাসের আগের ওই হিসাব করোনা ভাইরাস ও রাশিয়া-ইউক্রেন চলমান যুদ্ধের পরে বিন্দুমাত্র ভালো হওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। ২০২০ সালের ১০-২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ হাজার ৩৭০টি খানা বা পরিবারের ওপর ব্র্যাক, ইউএন উইমেন বাংলাদেশ ও নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির সংখ্যাবাচক ও পরিমাণবাচক উভয় পদ্ধতিতে পরিচালিত যৌথ এক গবেষণায় দেখা গেছে, পরিবারগুলোতে মাসিক গড় আয় কমেছে ৩৪ শতাংশ, সঞ্চয় কমেছে ৬২ শতাংশ এবং পরিবারে ৬১ শতাংশ কেউ না কেউ চাকরি অথবা আয়ের সক্ষমতা হারিয়েছেন। অথচ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈশ্বিক সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ-এক্স ২০১৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপানসহ ৭৫টি দেশকে পেছনে ফেলে দিয়ে অতি ধনী বা ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির হারে সবার চেয়ে এগিয়ে প্রথম হয়েছে বাংলাদেশ। এমনকি দ্বিতীয় স্থানে থাকা চীনের বার্ষিক ১৩.৭ শতাংশ হারে অতি ধনীর বৃদ্ধির বিপরীতে বাংলাদেশে অতিধনী বৃদ্ধির হার ছিল ১৭.৩ শতাংশ। ওয়েলথ-এক্স ২০২২ প্রতিবেদন বলছে, ১১.৪ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে বাংলাদেশ অতিধনি বৃদ্ধির হারে এখন তৃতীয় অবস্থানে।

দেশ-বিদেশের বিশ্বের বাঘা বাঘা অর্থনীবিদ, গবেষক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও বৈষম্যসংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত আমাদের নীতিনির্ধারকেরা গ্রহণযোগ্য বলে কখনোই স্বীকার করেন না। অথচ সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০১৮ সালের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী দেশের মোট আয়ের দুই-তৃতীয়াংশের মালিকই ওপরের দিকে থাকা ৩০ শতাংশ মানুষ। ভয়েস অব আমেরিকার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে সার্বিক দারিদ্র্যের হার যখন ৪২ শতাংশ, তখন সরকারি হিসাব বলেছে ২০.৫ শতাংশ। ধরে নিই, ২০১৯ সালের সরকারের ২০.৫ শতাংশ হারই সঠিক। করোনার পর তা নিশ্চয়ই বেড়েছে। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, সরকারের মতে কোভিড ও ইউক্রেন যুদ্ধ সত্ত্বেও দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে। দারিদ্র্যের হার এখন ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২-এ এই তথ্য উঠে এসেছে। ৬ বছর আগে ২০১৬ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। একই সঙ্গে, দেশে অতি দারিদ্র্যেরে হারও কমে এখন ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। এসব সংখ্যা যা-ই হোক, বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষ যে দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতিতে চরম দুর্দশার মধ্যে আছেন, তা তো অস্বীকার করার সুযোগ নেই। সাধারণ মানুষের এই দুর্দশা লাঘবের জন্য বাজার নজরদারিতে সরকারের যে ধরনের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, তা দেখা যায় না।

গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় বসবাসকারী ৪ ব্যক্তির পরিবার, ১০,০০০-১১,০০০ টাকায় একটি বাসা ভাড়া নিতে এবং জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহে কমপক্ষে ৪৭ হাজার টাকার প্রয়োজন হয়। এই পরিমাণ আয় কতটি পরিবারের আছে? কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ক্যাবের ২০২১ সালের হিসাবে দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৯২ শতাংশ এবং পণ্যমূল্য ও সেবা-সার্ভিসের মূল্য বেড়েছে ৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ। অন্যদিকে যেকোনো ভালো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির হার (ইনক্রিমেন্ট) বড়জোর ৫ শতাংশ, যা সরকারি প্রতিষ্ঠানে ৬ শতাংশ। জীবনযাত্রার ব্যয়সংক্রান্ত তথ্যসংগ্রহকারী বিশ্বের সর্ববৃহৎ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নামবিওর (এনইউএমবিইও) হিসাবে রাজধানী ঢাকায় ৪ সদস্যের একটি পরিবারের বাড়ি ভাড়া ছাড়াই আনুমানিক মাসিক খরচ ১ লক্ষ ৪১ হাজার ১৩৭, যা একক ব্যক্তির ক্ষেত্রে ৪০ হাজার ৬৮৩ টাকা। এই পরিমাণ অর্থ তো দূরের কথা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ পাঁচ ভাগের এক ভাগ খরচ করতে পারে না কি না, সে নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে। রাজধানী ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ১১টি বাজার থেকে ১৪১ ধরনের খাদ্যজাত, ৪৯ ধরনের খাদ্যবহির্ভূত এবং ২৫ ধরনের পরিষেবার দাম বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপস্থাপিত এক প্রতিবেদনে ক্যাব বলেছে, ২০২২ সালে সব মিলিয়ে ঢাকায় গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১১.০৮ শতাংশ। ২০২৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বিবিএস প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে দেশে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ।” সরকারি-বেসরকারি পরিসংখ্যানের এই মারপ্যাঁচ আর কামড়াকামড়িতে সাধারণের মানুষের দর্শক-শ্রোতা হওয়া ছাড়া কিছুই করার নেই। দুর্বৃত্ত আর মুনাফাতাড়িত বাংলাদেশের অর্থনেতিক ব্যবস্থায় এটাই স্বাভাবিক।

করোনা ভাইরাসের অভিঘাত, বিপর্যস্ত বিশ্ব সরবরাহ ব্যবস্থা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের সব দেশের অর্থনীতি সংকটের মধ্যে আছে। তবে সব দোষ ভাইরাস আর রাশিয়া-ইউক্রেনের ওপর চাপিয়ে দিলে অর্থনৈতিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব না। দেশে সর্বব্যাপী দুর্নীতি ও সুশাসনের ঘাটতি আমাদের উন্নয়ন সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দিচ্ছে। আমার সন্তান যেন থাকে ‘দুধে-ভাতে’র দিন ফুরিয়েছে অনেক আগেই। ‘দুধে-ভাতে’ থেকে ‘মাছে-ভাতে’ এবং এরপর শুরু হলো বাঙালির ‘ডিমে-ভাতে’ দিন। বোঝা যাচ্ছে এই ডিমে-ভাতের দিনও ফুরাতে চলেছে। সামনে হয়তো আসবে ‘আলু-ভাতে’। আলু-ভাতের দিনও হয়তো ফুরাবে। তারপর কী হবে, নীতিনির্ধারকেরা নিশ্চয়ই ভেবে দেখবেন।

লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশে অর্থনীতি সমিতি।

Link copied!