ল্যাটিন আমেরিকা উনিশ শতকে বড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। উনিশ শতকে ওই অঞ্চলের অধিকাংশ উপনিবেশই স্বাধীন হয়ে যায়। ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি ল্যাটিন আমেরিকার জন্য একটি সংকট হিসেবে দেখা দেয়। আধ সামন্তবাদী ল্যাটিন আমেরিকায় জাতিগত বৈচিত্র্য এবং সামাজিক অবস্থা এমন ছিল যে স্বাধীনতা শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো অর্থ বহন করেনি। কিন্তু ল্যাটিন আমেরিকায় কিছু চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক বুঝতে পেরেছিলেন জাতীয় চেতনা বা ঐতিহ্যের প্রতি সচেতনতা গড়ে তোলার কাজটি তাদের করতে হবে। অগাস্টাস সারমিয়েন্তো লিখলেন ফকান্দো। ফকান্দো থেকেই ল্যাটিন সাহিত্যের পরিকল্পনা শুরু। জাতিগত সত্তার ধারণার ক্ষেত্রে ল্যাটিন আমেরিকা একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ল্যাটিন আমেরিকার উদাহরণ টানার উদ্দেশ্য আমাদের ঐতিহ্যের সংরক্ষণের ব্যর্থতার বিষয়টি স্পষ্ট করা।
বাংলাদেশের বিখ্যাত টাঙ্গাইল শাড়ির ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই স্বত্ব) পেয়েছে ভারতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। ১ ফেব্রুয়ারি ভারত সরকারের মিনিস্ট্রি অব কালচারের অফিশিয়াল ফেসবুক পেইজ থেকে এ ঘোষণাটি আসে। এরপর থেকেই আলোচনার ঝড় ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্যের জিআই স্বত্ব ভারত পাওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বাংলাদেশিরা। তাদের ফেসবুক পেজে বলা হয়েছে, টাঙ্গাইল শাড়ি পশ্চিমবঙ্গেই তৈরি করা হয়। সম্পূর্ণ হাতে গড়া এই শাড়ির সূক্ষ্ম গঠনবিন্যাস, প্রাণবন্ত রং এবং জামদানি কাজের জন্য বিখ্যাত। টাঙ্গাইল শাড়ি তাদের মতে, ওই অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। জিআই স্বত্ব তারা পেয়েছে এবং এভাবে তাদের জন্য এই পণ্য ব্র্যান্ডিং করা অনেক সহজ হবে। কোনো একটি দেশের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মাটি, পানি, আবহাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানকার জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাহলে সেটিকে সেই দেশের জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আর জিআই পণ্য সমজাতীয় পণ্য থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক এগিয়ে আছে। ঐতিহ্যেরও একটি অর্থনৈতিক দিক রয়েছে। কালচারাল স্টাডিজের মতে কালচারাল ইকোনমিও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ভারত কীভাবে এই স্বত্ব পেল?
শাড়ি এমন একটি পোশাক যা নিয়ে তর্ক বিতর্ক অনেক রয়েছে। তবে এই একখণ্ড কাপড় বর্ণবাদে বহুধাবিভক্ত উপমহাদেশে নারীর অন্যতম বড় আশ্রয় হিসেবেই টিকে ছিল। এখনও আছে। তবে শাড়ির ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক দিকও বিবেচনা করা দরকার। টাঙ্গাইল শাড়ি, জামদানি শাড়ি, মসলিন এসব শাড়ি আলাদা বা পৃথক হয়েই থাকে। আর আঞ্চলিক হিসেবে টাঙ্গাইল আমাদেরই অংশ। ল্যাটিন আমেরিকাতেও আঞ্চলিক সচেতনতার ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিকদের আলাদা প্রভাব ছিল। এই উদাহরণ এজন্যই টানা কারণ ঐতিহ্য সংরক্ষণ করার দায়িত্ব জাতি বা রাষ্ট্রকেই নিতে হয়। কিছু ঐতিহ্য চলমান থাকে না। ঐতিহাসিক বলে স্বীকৃত হয়। আর কিছু ঐতিহ্য থাকে যা অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত। দেশে তাঁতশিল্প নিয়ে আমাদের গর্বের অন্ত নেই। কিন্তু অনেক তাঁতশ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন। অর্থনীতির প্রতিযোগিতায় ঐতিহ্য ক্ষয়িষ্ণু হয়। এজন্যই রাষ্ট্রকে এই শিল্পের দিকে বাড়তি মনোযোগ দিতে হয়। দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট এবং সামাজিক অস্থিরতা এক বড় সমস্যা। বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা। তরুণ প্রজন্ম সচেতনই নয় তাদের জাতিগত ঐতিহ্য সম্পর্কে। এক্ষেত্রে তাদের দোষই বা কি? চোখ তাকিয়ে আছে পশ্চিমে। কিন্তু ভারত যখন টাঙ্গাইল শাড়িতে নিজেদের পণ্য দাবি করে তখন আমাদের টনক নড়ে। টাঙ্গাইল নামটি আমাদের পরিচিত। এই বোধটা টাঙ্গাইল শব্দ থেকেই। ওই শিল্পটির দিকে আমাদের চোখ ফেরেনি। অনেক তাঁতশিল্পী দেশত্যাগ করে ভারতে কাজের সন্ধানে চলে যান। সেখানে অন্তত সাংস্কৃতিক অর্থনীতির গতি রয়েছে। আমাদের নজর সেদিকে নেই। অথচ কুটিরশিল্পকে অনেক উন্নত করা যেত।
টাঙ্গাইল শাড়ির তাঁতিরা ঐতিহ্যবাহী মসলিন তাঁতশিল্পীদের বংশধর। তাদের আদি নিবাস ছিল ঢাকা জেলার ধামরাই ও চৌহাট্টায়। তারা দেলদুয়ার, সন্তোষ ও ঘ্রিন্দা এলাকার জমিদারদের আমন্ত্রণে টাঙ্গাইলে যান এবং পরবর্তী সময়ে সেখানে বসবাস শুরু করেন। যাহোক, দেশান্তরী তাঁতিদের উৎপাদন নিয়ে আজ ভারত এই বিশ্বখ্যাত শাড়িটি নিজেদের বলে মনে করছে। নিজেদের বলে দাবিও করেছে। কারণ সাংস্কৃতিক অর্থনীতির পৃষ্ঠপোষকতা তারা করতে পেরেছে। শুধু এই দিকটি থেকে তাদের দাবি সঠিক বলেই প্রতীয়মান। আমরা ক্ষুব্ধ তাদের দাবিতে। কিন্তু এখনও আমাদের অনেক সাংস্কৃতিক পণ্য রয়েছে। ক্ষয়িষ্ণুও হচ্ছে। এসব সংরক্ষণ এবং গতিশীলতা করার পৃষ্ঠপোষকতায় কি মনোযোগ ফেরানো দরকার না? নাকি আমাদের বিশ্ববাজারে পরিচয় নির্মাণের ক্ষেত্রে ক্ষুব্ধ হওয়াই পরিণতি হয়ে থাকবে? প্রশ্ন অনেক। আমাদের প্রত্যাশা, আমাদের দাবি আমরা আদায় করতে পারব। টাঙ্গাইল শাড়ি একান্তই আমাদের। বিশ্ব দরবারে টাঙ্গাইল শাড়ি শুধু বাংলাদেশের হয়েই থাকুক। সেই পৃষ্ঠপোষকতার প্রস্তুতিও শুরু করা জরুরি।
লেখক : সংবাদকর্মী