বিশ্ব এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে একটা চ্যালেঞ্জিং সময়ে আসছে নতুন বাজেট। তাই খুব সাবধানে তৈরি করতে হবে। ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে, জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে জাহাজের খরচ বেড়েছে, ফলে যে কোনো পণ্য আদান-প্রদান ও পরিবহনের খরচ বেড়েছে। যারা আমদানি ও রপ্তানি করে তাদের উভয়ের জন্য সমস্যা তৈরি করছে।
উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতেও মূল্যস্ফীতি বিপদসীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রত্যেকটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের পলিসি রেট বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে সুদের হার বেড়েছে। মুদ্রানীতি অনেকখানি সঙ্কোচনমুখী হয়েছে। ফলে ঐ সব দেশের ট্রেজারি বন্ডগুলোর রিটার্ন বেড়ে গেছে। ঐসব দেশের বিনিয়াগকারীরা, যারা আমাদের মতো বা উন্নয়নশীল দেশের শেয়ারবাজারে কিংবা এফডিআই হিসেবে বিনিয়োগ করেছিল, তারা ঐ বিনিয়োগগুলো উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে ফিরিয়ে নিতে সচেষ্ট হচ্ছে। এই কারণে ডলার শক্তিশালী হয়েছে, অন্যদিকে আমাদের টাকাসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর মুদ্রার দাম কমে গেছে।
ফলে যে টাকা দিয়ে আমরা জ্বালানি বা ভোজ্যতেল, গম, গুঁড়ো দুধ কিনি, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় এসব জিনিসের দামও বেড়ে গেছে। যে কারণে আমাদের টাকার বিনিময় হার গত দুই বছরে প্রায় ৩০ শতাংশের মতো কমে গেছে। তার মানে যদি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনো জিনিসের দাম নাও বাড়ে, ডলারের মূল্য একই থাকে, তবুও কিন্তু ৩০ শতাংশ দাম বেড়ে গেছে। অথচ ডলারের দাম আরও বেড়েছে। সব মিলিয়ে একটা আমদানি করা মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশে ঢুকে গেছে। কোভিড- উত্তর অর্থনীতির যে জটিলতা এবং ইউক্রেনে যুদ্ধ এবং সর্বশেষ মধ্যপ্রাচ্যের যে ভূ-রাজনৈতিক টেনশন এবং হুতিদের কারণে যে দস্যুতা হরমুজ প্রণালীতে হচ্ছে, তার কারণে জাহাজ পাল্টে অন্য রুটে যেতে হচ্ছে- সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। অন্যদিকে, আমদানি করা পণ্যের দামও বেড়ে গেছে। এর প্রভাব আমাদের দেশের অর্থনীতিতে পড়ছে নানাভাবে।
একদিকে সরাসরি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে, যে যন্ত্রপাতি কিনি সেটার দাম বেড়ে গেছে। এগুলো দিয়ে যখন আমরা উৎপাদন করি সে উৎপাদন খরচও বেড়ে গেছে, আর জ্বালানি তেল দিয়ে আমরা বিদ্যুৎ তৈরি করি সে বিদ্যুতের দামও বেড়ে গেছে। আমাদের তিন চার দফা দাম অ্যাডজাস্ট করতে হয়েছে বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায়। একই সঙ্গে দেশের ভেতরেও ব্যক্তি খাত থেকে বিদ্যুৎ ও এলএনজি কিনছি ডলারে। এগুলোর দামও বেড়ে গেছে। ডলারের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে এই পেমেন্ট আটকে গেছে। এ কারণেও সামষ্টিক অর্থনীতি চাপে পড়েছে। ডিজেলের খরচ বেড়ে যাওয়ার মানে, আমাদের পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। এ ছাড়া বিদেশে কোনো পণ্যের দাম যদি বেড়ে যায়, সেই পণ্য দেশে উৎপাদন করা হলেও দাম বাড়ার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
মূল্যস্ফীতি একদিকে সরবরাহ সঙ্কটের কারণে বেড়েছে। অন্যদিকে আরেকটি বড় কারণ হয়েছিল চাহিদা বেড়ে যাওয়া। কোভিডকালে আমরা প্রচুর প্রণোদনা দিয়েছি। বাংলাদেশ ব্যাংক বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে আমরা সাধারণ উদ্যোক্তাদের দিয়েছি। যেমন ২ শতাংশ সুদ হারে টাকা দিয়েছি উদ্যোক্তাদের, সরকারের পক্ষ থেকে সরাসরি গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতন দেওয়া হয়েছে। সামাজিক সুরক্ষার জন্য নানা রকমের কার্ড তৈরি করা হয়েছে। এসব মিলিয়ে বাড়তি টাকা ঢুকে গেছে বাজারে। অথচ বাড়তি উৎপাদন হচ্ছে না। তাহলে যা হয়, বাজারে যখন অনেক বেশি টাকা থাকে আর পণ্য যদি সেভাবে উৎপাদিত না হয় তাহলে তো মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবেই। তার মানে দেশি-বিদেশি দুটো কারণেই কিন্তু মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।
এক্ষেত্রে পশ্চিমের দেশগুলো সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি শুরু করেছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুই বছর আগে থেকে টাকা বাজার থেকে তুলে নিচ্ছে, সুদের হার বাড়াচ্ছে। কিন্তু আমাদের এখানে সুদের হারের ওপরে একটা সিলিং দিয়েছিলাম। এতে যে ঘটনাটি ঘটেছে ৯ শতাংশের বেশি কোনো ব্যাংক চার্জ করতে পারবে না ব্যবসায়ীদের কাছে, অথচ এখানে মূল্যস্ফীতিও নয় শতাংশ। তাহলে একজন ব্যবসায়ী কার্যত শূন্য সুদে ঋণ পেল। এ রকম হলে তারা ঋণ নেবে না কেন? এবং সেই ঋণ সবসময় শিল্পেই কাজে লাগাবে এমন তো না। তারা গাড়ি কিনবে, বাড়ি কিনবে, বিদেশে নিয়ে যাবে। এসব কারণে তখন বাজারে প্রচুর ঋণের ছড়াছড়ি লক্ষ করা গেছে।
এটা তুলে আনার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। দুই বছর আগের থেকে করলে হয়তো বাজার অনেক টাইট হতো, জিনিসপত্রের দাম এত বেশি হতো না। আমরা একটু দেরি করার কারণে জিনিসপত্রের দামটা বেড়ে গেছে। তবে দেরিতে হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুদের হার নমনীয় করে দিয়েছে। বাজারের সঙ্গে মিলিয়ে দেবার একটা চেষ্টা করছে। এবং অন্যদিকে ডলারের সঙ্গে টাকার যে বিনিময় হার সেটাও খানিকটা ছেড়ে দিয়েছে। এখন ‘ক্রলিং পেগে’র মাধ্যমে বাজারের কাছাকাছি যাওয়ার একটা চেষ্টা চলছে।
কিন্তু দেরি হয়ে যাওয়ার কারণে মানুষের মনের মধ্যে একটা বিষয় ঢুকে গেছে যে হয়তো বিনিময় হার আরও বাড়বে অথবা রেট অব ইন্টারেস্ট আরও বাড়বে। সব মিলিয়ে আর্থিক বাজারে একটা জটিলতা তৈরি হয়েছে, যার কারণে মূল্যস্ফীতি যেভাবে কমে যাওয়ার কথা সেভাবে কমছে না। মূল্যস্ফীতিটা একটা স্থায়ী রূপ নিয়েছে। গত ২২ মাস ধরে তা ৯ শতাংশের বেশিই রয়ে গেছে। যে পলিসি আমরা গ্রহণ করেছি এখন এটা নিশ্চয় কমবে, কিন্তু সময় লাগবে। কেউ যদি আশা করে যে কালকেই বা এক মাসের মধ্যে কমে যাবে সেটা কিন্তু না। একটু সময় লাগবে। এজন্য নীতি সংস্কারে সুদৃঢ় থাকতে হবে।
মূল্যস্ফীতি বাড়ার আরেকটি কারণ রাজস্ব নীতি। বিদেশি পণ্য যেগুলো আসছে, আগেই বলেছি যে সেগুলোর দাম ৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে। তার মানে সরকারেরও কিন্তু ৩০ শতাংশ শুল্কের হার বেড়ে গেল। এখন যেহেতু টাকার অঙ্কে এটা বেড়ে গেছে, উচিত ছিল এই টাকাটা পুরোটা সরকার না নিয়ে খানিকটা ভোক্তার সঙ্গে শেয়ার করা।
ধরা যাক, আমি যদি ৩০ টাকা বেশি শুল্ক পেয়ে থাকি ভোজ্য তেলে তাহলে সেটা আমি কমিয়ে দেব। অনেক ক্ষেত্রে অবশ্য কমানো হয়েছে। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। যে কারণে জিনিসপত্রের দাম বেশিই রয়ে গেছে। আবার হয়তো শুল্কমুক্ত করেছে এনবিআর, যিনি আমদানি করেন তিনি আর এটা মার্কেটের সঙ্গে তা অ্যাডজাস্ট করেননি। তাই বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটি দূর করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
অন্যদিক থেকে যতটা রাজস্ব আমাদের আদায় করার কথা, আমরা কিন্তু সেই পরিমাণ আদায় করি না বা করতে পারি না। কর দেবার মতো এক কোটি মানুষ টিন নাম্বার সংগ্রহ করেছেন, কিন্তু মাত্র ৩০ লক্ষের মতো মানুষ সত্যি সত্যি রিটার্ন দেন, কিন্তু বাকিরা কই? তারা হয়তো দাবি করেন তাদের অত আয়-রোজগার নেই। আসলেই কি তাই? এটা খুঁজবার জন্য দুইটা উপায় আছে- একটা হলো, রাজস্ব বিভাগের যদি জনশক্তি বাড়ানো যেত, যদি উপজেলা পর্যন্ত তাদের ব্রাঞ্চ খোলা যেত, তারা হয়তো সেখানে একটা খবর নিয়ে কাজ করতে পারত। দ্বিতীয় যেটা করতে পারত, সেটা হলো অফিস না খুলেই ডিজিটাল যুগে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে কিন্তু জানা সম্ভব যে এ উপজেলাতে কতজন কর দেওয়ার মতো মানুষ আছে।
আমরা যদি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে বলি যে অমুক উপজেলায় কতজন মানুষ আছে, যারা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বেশি ফোনে খরচ করে, এটা তো সহজেই আমরা বের করে ফেলতে পারব, এনআইডি যেহেতু আমাদের কাছে আছে। কয়টা বাড়ি আছে, উপজেলা লেভেলেও বাড়ি করলে কোথাও না কোথাও তো রেকর্ড করতে হয়, যেমন পৌরসভা। এখান থেকেও রেকর্ড বের করা যায় অথবা যে ভদ্রলোকের কথা বলা হচ্ছে তার ছেলেমেয়েরা কোথায় পড়াশোনা করে, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়লে তো তার আয় লাগবে। তিনি বিদেশে কতবার গেছেন, সেখান থেকেও বেরিয়ে আসবে যে মানুষটির ট্যাক্স দেওয়ার উপযোগী অথচ তিনি ট্যাক্স দেন না, তখন তাকে যদি একটা চিঠি লিখি যে, আমার রেকর্ডে বলছে আপনি এতবার বিদেশে গেছেন, আপনার মেয়েরা-ছেলেরা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে আপনার একটা গাড়ি আছে। আপনি মাসে এত টাকা মোবাইল ফোনে খরচ করেন, আপনার টেলিফোন বিল এত, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কিন্তু এটা বের করে দেবে। তিনি কেন কর দেবেন না- এ প্রশ্ন যদি তাকে করা হয় আমার দৃঢ়বিশ্বাস তিনি কর দেবেন। আর না দিলে পরে এনবিআরের রুলসের মধ্যে তিনি পড়ে যাবেন।
এভাবে কিন্তু নতুন করদাতা আইডেন্টিফাই করা খুবই সহজ। এটার জন্য খুব বড় কর্মকর্তা লাগবে না, প্রযুক্তি সক্ষম জুনিয়র কর্মকর্তারাই করে দিতে পারবে। আর একটি উপায় হলো, এমন কিছু খাত আছে যেখানে নতুন করে কর বসানোর সুযোগ এখনো আছে। যেমন, আমাদের ছেলেমেয়েদের অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে তামাক পণ্য গ্রহণ করার কারণে। আমরা চাই তামাকমুক্ত বাংলাদেশ। তাহলে সিগারেটের দাম আমরা বাড়াই না কেন, এক শলাকা সিগারেট বিক্রি করার সুযোগই আমি রাখব না, আর যদি কেউ সেটা কিনতে চায়, তাহলে তার দাম অনেক বেশি বাড়িয়ে দিতে হবে। দাম যদি বাড়িয়ে দেই, তার ওপর আমরা যদি স্পেশাল ডিউটিও বাড়াই, তাহলে একটা হিসাব করে দেখেছি যে সাড়ে দশ হাজার কোটি টাকা বাড়তি কর আমরা পেতে পারি। এভাবে নতুন নতুন ক্ষেত্রগুলোকে আমরা যদি সঙ্গে নেই তাহলে কিন্তু করা সহজ।
আরেকটা হলো, সকল নাগরিক যেন কর দেন তার একটা প্রচারাভিযান হওয়া দরকার। এমনকি একজন রিকশাওয়ালাও তো কোনো না কোনোভাবে ট্যাক্স দিচ্ছেন। কিন্তু তাদেরও যদি অন্য অনুরোধ করি, একটা ডাইরেক্ট ট্যাক্স দেন, তাহলে সবাই দেবে। দেশের প্রয়োজনে দেবে। আর কর ফাঁকি যেসব জায়গাতে হয় এগুলোর দিকে নজর দেওয়া। যেমন, কন্ট্রাক্টররা অনেক ক্ষেত্রে তাদের যে ৩৫ শতাংশ পরিমাণ ভ্যাট দেবার কথা, কিন্তু তারা দেখায় যে এটা ১৫ শতাংশ বা ৫ শতাংশ। অথবা ভ্যাটের যে অঙ্ক, যে পরিমাণ খরচ করেছে সেটা কমিয়ে দেখিয়ে ওটার ওপরে ভ্যাট কমিয়ে ফেলে। এটা বড় বড় কোম্পানিরাও করে। এ জায়গাগুলোতে যদি মনিটর করি তাহলে অনেকটা বাড়ানো যাবে।
আরেকটা হলো, এক লক্ষ কোটি টাকার মতো মামলা জট বেড়ে গেছে। আমার মনে হয় ভালো ভালো উকিল দিয়ে যদি এই মামলার জটটা খোলার চেষ্টা করা যায় এবং দরকার হলে কয়েকটা কোর্ট বাড়িয়ে দিয়ে অথবা এই মামলাগুলো দ্রুত সমাধান করলে আমার ধারণা অন্তত কয়েক হাজার কোটি টাকা উদ্ধার করতে পারব। এরকম নতুন নতুন অনেক পথ বের করার জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং সক্ষমতা। অর্থাৎ যারা রাজস্ব আদায় করেন তাদের সক্ষমতা।
এতক্ষণ ধরে আমরা বাজেটের সীমাবদ্ধতাগুলোর কথা বললাম, চ্যালেঞ্জগুলোর কথা বললাম। রাজস্বের সম্ভাবনাগুলোর কথা বললাম। তাহলে আগামী বছরের বাজেটটা কেমন হওয়া উচিত এই প্রেক্ষাপটে আমরা কিছু প্রস্তাবের মধ্যে যাই।
এক.
এই বাজেট হতে হবে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার বাজেট অর্থাৎ আমি মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনব, বিনিময় হার স্থিতিশীল করব, রিজার্ভ বাড়াব। এগুলো তো ম্যাক্রো-ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস। এই ইন্ডিকেটরগুলোকে স্থিতিশীল করতে হবে, এটাই হলো আমাদের প্রধান লক্ষ্য। এটা করার জন্য মুদ্রানীতি এবং রাজস্ব নীতিতে যা যা করা দরকার সেরকম ব্যবস্থা নিতে হবে। আমার কাছে এ বছর প্রবৃদ্ধি মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়, যদি প্রবৃদ্ধি খানিকটা কমেও তার বিনিময়ে যদি সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা আসে, আমরা বাজেটটাকে সেদিকে নিয়ে যাব।
দুই.
রাজস্ব বাড়ানোর জন্য এতক্ষণ ধরে যে আলাপটা করলাম, তার আলোকে আমরা প্রস্তাব করছি যে নতুন করে করজালে নতুন করদাতাদের আবদ্ধ করতে হবে। এনবিআরকে সক্ষম করবার জন্য তাদের যে ধরনের সুযোগ দেওয়া দরকার সেটা তাদের দিতে এবং বাজেট বক্তৃতাতে সে বিষয়গুলো বলতে হবে। রাজস্ব বিভাগকে শক্তিশালী করবার জন্য, তার সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য জনবল বাড়াতে হবে, এবং একই সঙ্গে ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহারের সক্ষমতা দেবার জন্য যে ধরনের বিনিয়োগ করা দরকার সেটা বিনিয়োগ করবে।
তিন.
আমাদের এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে যেহেতু কেন্দ্রে রাখা হয়েছে, তাহলে এর শিকার যে সাধারণ মানুষ, যাদের আয় রোজগার কম, তাদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা বাড়াতে হবে। যারা বয়স্ক ভাতা পায়, বিধবা ভাতা পায় এমনকি টিসিবির ট্রাক থেকে যেখানে মা বোনেরা কম দামে কিনতে পারে, এই যে সুযোগগুলো আছে এর পরিমাণ এবং সংখ্যাও বাড়াতে হবে। অন্তত ৪-৫ লাখ বাড়তে হবে। সম্প্রতি যে দুর্যোগ ঘটে গেল রিমালের কারণে সেখানে পুরো উপকূল ছাড়াও দেশের নানা জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের পুনর্বাসনের জন্য এবং বাঁধ ভেঙে গেছে এগুলোর জন্য একটা বরাদ্দ এই বাজেটে থাকতে হবে। কারণ এই মানুষগুলোকে তো আবার দাঁড় করাতে হবে।
চার.
হালের দুর্যোগের কারণে সুন্দরবনেরও বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। সে ক্ষতিটা যেমন বনের গাছ পড়ে গেছে, তেমনি বনে যারা বেঁচে আছে, মানুষ জীবন যাপন করছে, তাদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ করতে হবে। তাদের সামাজিক সুরক্ষার দিকে নিয়ে যেতে হবে।
পাঁচ.
কৃষি হবে আমাদের রক্ষাকবচ। এই যে এত সংকট সত্ত্বেও আমরা টিকে আছি, তার বড় কারণ আমরা কৃষিতে ভালো করছি, সুতরাং কৃষির জন্য যত রকমের সুযোগ-সুবিধা ছিল এগুলো আমরা বজায় রাখব এবং আরও ভর্তুকি দেব। যেমন, আমরা সারের জন্য, নতুন বীজের জন্য ভর্তুকি দিই। এগুলো বাবদ যত বিনিয়োগ আছে (সরকার এটাকে বিনিয়োগ বলে), এটা আগের চেয়ে আরও বাড়াতে হবে।
ছয়.
যারা রপ্তানি করেন, রেমিট্যান্স আনেন তাদের জন্য যে প্রণোদনা প্যাকেজ, সেটা দরকার পড়লে আরও বাড়াতে হবে, এটা কমানোর কোনো সুযোগ নেই। যেমন, রেমিট্যান্স যারা আনে তারা আড়াই শতাংশ নগদ প্রণোদনা পায়। আমরা প্রস্তাব করছি যে এটা আরও বাড়াতে হবে। এটা অন্তত ৩ শতাংশ করা হোক। আর যারা রপ্তানি করেন তারা নতুন রেটে রপ্তানি করেন। রপ্তানি আয়ের একটি অংশ তারা অনেক সময় বিদেশে আটকে রাখেন। এখন যেহেতু রেট বেড়ে গেছে, আমাদের এখন মনিটর করতে হবে যে তাদের যে আয় সেটা যেন তারা দেখে তাড়াতাড়ি দেশে নিয়ে আসেন।
আমাদের ম্যাক্রো ইকোনমিক স্থিতিশীলতার জন্য এফডিআই বাড়াতে হবে। ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট বাড়বে যখন ঐ বিনিয়োগকারীরা দেখবেন যে, তারা যে ডলার নিয়ে আসছেন সেটা বিনিয়োগ করাটা খুব সহজ। আর এখানে বিনিয়োগ করে যে আয় রোজগার করবে তারা যেন সেটা সহজে তাদের দেশে নিয়ে যেতে পারেন সে ব্যবস্থা থাকতে হবে। না হলে তারা আসবে না। আমাদের অবকাঠামোর যে ঘাটতি আছে সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু এখন যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে আমরা বড় প্রজেক্ট নিতে পারব না। কিন্তু যে প্রজেক্টগুলো এখন সমাপ্তির পথে এগুলোর জন্য বরাদ্দ দিতে হবে। কিন্তু নতুন বরাদ্দের ঝুঁকিটা আমরা নেব না, এটাও বাজেটে বলতে হবে।
এরপর বলতে হবে ছেলেমেয়েরা যে বিদেশে যাচ্ছে, তাদের যদি সামান্য একটু স্কিল দেওয়া যেত। যেমন, জার্মানিতে এখন ইলেকট্রিশিয়ান এবং প্লাম্বার যারা তাদের দারুণ ডিমান্ড। প্লাম্বারদের এক জায়গায় জড়ো করে একটু আধুনিক যেমন কম্পিউটার চালানো কিংবা কিছু স্কিল ট্রেনিং দিয়ে তারপর পাঠালে তারা অনেক পয়সা পাঠাতে পারবে। পাশাপাশি যারা রেমিট্যান্স পাঠাবে তাদের জন্য একটা প্রণোদনা প্যাকেজ তৈরি করতে হবে, তারা যদি ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠায় সেটার জন্য তাদের একটা স্মার্ট কার্ড দেওয়া উচিত। যারা বিদেশে যাচ্ছে তাদের একটা স্মার্ট কার্ড থাকা উচিত, সেই কার্ড দেখিয়ে তাদের পরিবারের সদস্যরা বাড়তি সুবিধা পাবে।
বিমানবন্দরে গেলে তাদের ওয়েলকাম করা হবে, তারা যদি পাবলিক হসপিটালে যায় সবার আগে চিকিৎসা পাবে, তারা যদি ১৫ লক্ষ টাকা গত বছর এনে থাকে, যদি বাড়ি বানানোর জন্য একটা ঋণের প্রয়োজন হয় তারা কম সুদে ঋণ পাবে, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে সুবিধা পাবে- এরকম কতগুলো সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। অন্যদিকে, অফশোর ব্যাংকিং চালু হয়েছে (প্রায় ৮ দশমিক ৪ শতাংশ সুদহারে)। প্রবাসীদের কাছে এই তথ্যটা খুব জোরালোভাবে দেওয়া উচিত যে আপনারা ইচ্ছা করলে অফশোর ব্যাংকে টাকা পাঠাতে পারেন। এটা ট্যাক্স ফ্রি। এ তথ্যগুলো তাদের দিতে হবে এবং বাজেট বক্তৃতাতে এটা বললে তথ্যটা দ্রুত ছড়িয়ে যাবে।
মনে রাখা চাই, বাজেট শুধু অঙ্কের মারপ্যাঁচ নয়। বাজেট বক্তৃতার মনস্তাত্ত্বিক মূল্যও অনেক। সরকার আগামীতে জনস্বার্থে কী কী উদ্যোগ নেবে তার ইঙ্গিত করার সুযোগও আছে এই বক্তৃতায়। অযথা বিরাট বক্তৃতা করে জনগণকে ভারাক্রান্ত না করে খুবই স্মার্টলি আঁটসাঁট বাজেট বক্তৃতা প্রাঞ্জল ভাষায় দেওয়ার সুযোগ নিশ্চয় রয়েছে। সমকালীন সামষ্টিক অর্থনীতির টানাপড়েন স্বীকার করে নিয়েই উপায়ের পথগুলোও নির্দেশ করা সম্ভব বাজেট বক্তৃতায়। আশা করি বর্তমান সময়োপযোগী একটি প্রাসঙ্গিক বাজেট পাবে বাংলাদেশের পোড়খাওয়া মানুষ।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক।