প্রথমেই আমি একজনকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাতে চাই। তিনি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। তার দিক-নির্দেশনা, দূরদর্শী ও বিচক্ষণ পরিকল্পনা এবং আন্তরিক প্রয়াস আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সুদৃঢ় করেছে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পর্দাপণ করেছে। বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। সেই সাথে আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট, উন্নত বাংলাদেশে উন্নীত হওয়ার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
বর্তমানে জাতীয় অর্থনীতি একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়ালেও করোনা পরবর্তী দীর্ঘমেয়াদী বিরূপ প্রভাব এবং চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্য সংকটের মধ্যেও এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতির উন্নয়নের গতিধারাকে এগিয়ে নিতে হচ্ছে। এজন্য দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সহায়ক পরিবেশকে আরও সুদৃঢ় ও জোরদার করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ অর্থনীতি সঠিক গতিতে চললেই সরকার তার কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আহরণ করতে পারবে।
বর্তমান সরকার পর পর চতুর্থবারের মতো দায়িত্ব গ্রহণ করায় আগামী বাজেটকে ঘিরে জনগণের ব্যাপক প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। সামগ্রিক বিষয়গুলি বিবেচনায় নিয়ে এবারও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে একটি জনমুখী ব্যবসাবান্ধব বাজেট প্রণীত হবে বলে আমরা আশা করি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বাজার মনিটরিং, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রেমিট্যান্স প্রবাহ, রপ্তানি বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণ/বহুমুখীকরণ/নতুন বাজার সংযোজন, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, সুদের হার এবং আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন কার্যক্রম জোরদারকরণ, ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও বৃদ্ধিকরণ, রাজস্ব নীতির সংস্কার এবং মুদ্রা ও রাজস্ব নীতির মধ্যে সমন্বয়, সর্বস্তরে সুশাসন এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাই জাতীয় অর্থনীতিতে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা, অষ্টম পঞ্চম বার্ষিকী পরিকল্পনা, এসডিজি অর্জন, নির্বাচনী ইশতেহার, স্মার্ট বাংলাদেশ ও সর্বোপরি ভিশন ২০৪১ কে সামনে রেখে আমাদের অর্থনৈতিক পলিসি সমন্বয় করা জরুরি। বিদ্যমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জসমূহ বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় লক্ষ্যমাত্রাসমূহের আলোকে সুষ্ঠু অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সমুন্নত রাখতে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় পর্যায়ক্রমে সুদৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করার লক্ষ্যে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকবে বলে এফবিসিসিআই মনে করে।
বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানকে দৃঢ় করতে ব্যবসায়িক খরচ (কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস) কমিয়ে আনা, বিনিয়োগ সুরক্ষা, বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, সুষম বিনিয়োগ সহায়ক মুদ্রা ও শুল্ক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, শিপিং খরচসহ সকল ধরনের পরিবহন খরচ হ্রাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসহ প্রভূতিক্ষেত্রে স্থায়ী পরিকাঠামো উন্নয়নে স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিত করার পাশাপাশি কর আদায়ের ক্ষেত্রে হয়রানি ও জটিলতা দূরীকরণের মাধ্যমে ব্যবসাবান্ধব কর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে আগামী বাজেটে বিশেষ অগ্রাধিকার দেয়ার জন্য আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।
বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার গত ১৫ বছরে ৯০ বিলিয়ন ডলার থেকে ৪৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নিত হয়েছে। সামনের দিকে আরও বড় হবে অর্থাৎ এক ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত হতে বেশি সময় লাগবে না। তবে সেই অনুপাতে আমাদের সক্ষমতা হয়নি। আমরা জানতে পারছি, আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার হতে পারে ৮ লাখ কোটি টাকা। এই জন্য রাজস্ব সংক্রান্ত আইন কাণুন প্রণয়ন, আধুনিকায়ন করা এবং দেশের অর্থনীতির স্বার্থে তা সঠিকভাবে বাস্তবায়নে সরকার এবং বেসরকারি খাতের এক সাথে কাজ করার বিকল্প নেই।
তাই আমরা মনে করি, শুধু এনবিআর নয় এবং দেশের সকল বাণিজ্য সংগঠনের সক্ষমতা এবং দক্ষতা বৃদ্ধি করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে- যাতে সরকারকে সঠিক পরামর্শ দিতে পারে। এ লক্ষ্যে দেশের সকল বাণিজ্য সংগঠনের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সরকারকে বিশেষ নজর দেয়ার অনুরোধ জানাই।
আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট প্রণয়নে নিম্নোক্ত বিষয়গুলির ওপর বিশেষ নজর দেয়া জরুরি বলে আমি মনে করি। এর মধ্যে কর্মসংস্থানের স্বার্থে বিনিয়োগ, দেশীয় শিল্প ও সেবা এবং সিএমএসএমই-কে শুল্ক করের যৌক্তিক প্রতিরক্ষণ প্রদান, ক্ষেত্র বিশেষে অব্যাহতি বা বন্ড সুবিধা দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক ভিত্তিতে রপ্তানি বৈচিত্রকরণের প্রয়াস অব্যাহত রাখা, ভোগ্যপণ্যসহ নিত্য ব্যবহার্য্য পণ্যের মূল্য ও সরবরাহ স্থিতিশীল রাখা, করনীতি, কর পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন, অটোমেশন ও ইন্টিগ্রেশনের মাধ্যমে নেট বা কর জাল সম্প্রসারণ করা, স্বেচ্ছায় কর প্রতিপালন হার বৃদ্ধিপূর্বক রাজস্ব আদায় তথা কর জিডিপি’র অনুপাত বৃদ্ধি করা, আয় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও যথাযথ করনীতির মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করা, সমন্বিত শুল্ক-কর এবং মুদ্রা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা জরুরি।
বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো বিবেচনায় নিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নে সম্প্রতি এনবিআর’র সাথে অনুষ্ঠিত পরামর্শক কমিটির বৈঠকে আমরা কিছু সুপারিশ করেছি। এর মধ্যে সামষ্টিক অর্থনীতি বিষয়ে প্রস্তাবনায় আমরা বলছি; ব্যাংকিং ও ফিন্যান্সিয়াল সেক্টরে শৃঙ্খলা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংকিং খাতের সংস্কার বিষয়ে সরকার ইতিমধ্যে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন– যা ‘ইতিবাচক’ ফল নিয়ে আসবে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। পাশাপাশি বিনিয়োগ বাড়াতে এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকার লক্ষ্যে সুদের হার স্থিতিশীল রাখতে হবে। বিনিয়োগের স্বার্থেই সুদের হার কমিয়ে আনতে হবে।
এছাড়াও বৈদেশিক অর্থায়নে এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং অপ্রয়োজনীয় ও অনুৎপাদনশীল প্রকল্প গ্রহণ থেকে বিরত থাকা, অর্থপাচার/মানি লন্ডারিং রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত, রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা, ইকোনমিক ডিপ্লোমেসি তথা বাংলাদেশের বৈদেশিক মিশনগুলিকে দেশের রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখা ও কমার্শিয়াল কাউন্সিলরদের দায়িত্ব পালনের বিষয়ে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা, রাজস্ব বাড়াতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ জোরদারকরণ, ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ, সহায়ক পলিসি সাপোর্ট, কমপ্লায়েন্স নিশ্চিতকরণ এবং করের আওতা বৃদ্ধির মাধ্যমে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি করা, রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে নগদ সহায়তার বিকল্প সুবিধা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিকল্প সহায়তা হিসেবে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও পরিবহনখাতে প্রণোদনা বা বিশেষ সুবিধা প্রদানের প্রস্তাব করেছি আমরা।
এদিকে, রাজস্ব সংস্কার সংক্রান্ত প্রস্তাবনায় আমরা কিছু বিষয় তুলে ধরেছি। এরমধ্যে কর হার কমিয়ে আয়কর এবং মুসকের আওতা সম্প্রসারণ করে রাজস্ব আয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করা, ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি করতে আয়করের আওতা বাড়ানো, সক্ষম করাদাতাদের আয়করের আওতায় আনা এবং এজন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সমন্বিত ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন জরুরি সংস্কারক আবশ্যক। এছাড়াও আমদানি পণ্যের যথাযথ শুল্কায়ন, পণ্য খালাস এবং সকল প্রকার শুল্ক ও কর পরিশোধ ত্বরান্বিত করার জন্য বিদ্যমান এসাইকুডা সিস্টেমের সার্বিক উন্নয়নসহ বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো সংক্রান্ত কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়ন করার পাশাপাশি বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো বাস্তবায়নের সময়সীমা সুনির্দিষ্ট করা এবং অথরাইজড ইকোনমিক অপারেটর (AEO) এর সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া।
এছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব আহরণ এবং রাজস্ব পলিসি কার্যক্রম পৃথক করা এবং ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন বিভাগ নামে একটি বিভাগ গঠন করা, ট্যাক্স, ভ্যাট ও কাস্টমস প্রশাসনকে সমন্বয়করণ ও অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য ও গবেষণা অনুবিভাগকে শক্তিশালী করার জন্য একজন সদস্যকে পৃথকভাবে দায়িত্ব প্রদান করা দরকার। এছাড়া সকল ধরনের সুযোগ সুবিধাসহ বাজেট সমন্বয় নামে স্থায়ীভাবে পৃথক একটি অনুবিভাগ গঠন করার সময় এসেছে বলে আমি মনে করি।
এছাড়াও আমদানিকৃত কাঁচামাল, মধ্যবর্তী কাঁচামালসহ যাবতীয় শিল্প উপকরণের ওপর আরোপিত অগ্রিম আয়কর (এআইটি) এবং ভ্যাট আইনের আওতায় আগাম কর (এটি) প্রত্যাহার করা, ঢাকায় একটি পৃথক বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) এবং চট্টগ্রামে একটি বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) স্থাপনসহ দেশের সকল উপজেলায় আয়কর অফিস চালু করে সক্ষম করদাতাদের আয়করের আওতায় নিয়ে আসা, ন্যাশনাল ট্যারিফ পলিসি বাস্তবায়নের দায়িত্ব (স্থানীয় শিল্পের স্বার্থে) জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনকে দেয়া, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, নিরীক্ষা ও পরির্দশন সংক্রান্ত কার্যক্রম বিধিগত পদ্ধতি যথাযথভাবে অনুসরণের মাধ্যমে পরিচালনা করার প্রস্তাব করেছি আমরা।
অন্যদিকে, আয়কর, মুসক ও আমদানি শুল্ক সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনাও আমরা এনবিআরের সামনে তুলে ধরেছি। এরমধ্যে বর্তমান মূল্যস্ফীতি এবং নিম্ন আয়ের মানুষের প্রকৃত আয় বিবেচনায় নিয়ে ব্যক্তি শ্রেণীর করমুক্ত আয়ের সীমা ১ লক্ষ টাকা বৃদ্ধি করে ৪ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা, সিনিয়র সিটিজেন ও মহিলাদের জন্য ৫ লক্ষ টাকায় নির্ধারণ করার সুপারিশ করেছি। দেশে বর্তমানে প্রায় এক কোটি টিআইএনধারী রয়েছে। এর মধ্যে আনুমানকি ৩৫ লক্ষ আয়কর রিটার্ন দাখলি করে। যাদের আয় করমুক্ত সীমার উপরে আছে, তাদের আয়কর রিটার্ন দাখিলের আওতায় আনা দরকার বলে আমি মনে করি।
এছাড়াও শিল্প পরিচালনার ব্যয় কমানোর জন্য আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম আয়করের (এআইটি) হার ধাপে ধাপে কমিয়ে আনার প্রস্তাব করেছি। পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারীসহ সকল দেশীয় শিল্পে উৎপাদিত মোড়ক (প্যাকেজিং) পণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে অগ্রিম আয়কর ৭% থেকে হ্রাস করে ২% করা, বর্তমান আইনে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্য সামগ্রীসহ সকল কৃষিজাত নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্যকে উৎসে কর কর্তনের আওতা বহির্ভূত রাখা, রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পসহ সকল রপ্তানির বিপরীতে প্রযোজ্য উৎসে কর হার ১.০০% হতে হ্রাস করে পূর্বের ন্যায় ০.৫০% নির্ধারণ করা এবং তা আগামী ৫ বছর পর্যন্ত কার্যকর রাখা। পাশাপাশি নগদ সহায়তার উপর আয়কর কর্তনের হার ১০% হতে হ্রাস করে ৫% নির্ধারণ করা, মিনিমাম ট্যাক্স ও উইথহোল্ডিং ট্যাক্স-কে যৌক্তিকীকরণ করা, আপিলাত ট্রাইবুনাল নিরপেক্ষ করার জন্য কর বিভাগের বাইর থেকে অর্থাৎ অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ অথবা প্রফেশনাল সদস্য আবশ্যকভাবে নিয়োগ প্রদান, আয়কর আইনে উৎসে কর কর্তনের হার নির্ধারনের জন্য প্রয়োজনীয় সমীক্ষার দ্রুত ব্যবস্থা করার প্রস্তাব করেছি আমরা।
মুসক সংক্রান্ত প্রস্তাবের ক্ষেত্রে আমরা এফবিসিসিআই থেকে বলেছি, মুসক আইন-৩১(২) ধারার আলোকে পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে আমদানিকৃত উপকরণের ক্ষেত্রে ৩ শতাংশ ও ৫ শতাংশ আগাম কর (AT) প্রত্যাহার করা, উৎসে কর্তন বা VDS এ সম্প্রসারণ না করে ক্রমান্বয়ে কর্তনের হার কমিয়ে আনার প্রস্তাব করেছি আমরা। কারণ আমি মনে করি আদর্শ ভ্যাট পদ্ধতির সাথে এই পদ্ধতি বৈষম্যমূলক।
এছাড়াও অধিক ভ্যাট আদায়ের উদ্দেশ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ সকল সিটি কর্পোরেশন এলাকায় সকল শপিং মলে EFD মেশিন সরবরাহ করে ভ্যাট আদায় নিশ্চিত করেছি। বিশেষ করে, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জুয়েলারি খাত, রেস্টুরেন্ট এবং বিভিন্ন শপিং মলের দোকানে অতি দ্রুত ইএফডি মেশিন সরবরাহ করে ভ্যাট থেকে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি করার বিষয়ে আমাদের বক্তব্য তুলে ধরেছি।
এছাড়াও কমিশনারের নিকট আপিল দায়েরের ক্ষেত্রে দাবিকৃত করের ২০ শতাংশ বাধ্যতামূলকভাবে জমা করার বিধান হ্রাস করে ১০ শতাংশ করা, নিবন্ধিত বা তালিকাভুক্ত ব্যক্তি কর্তৃক উপকরণ-উৎপাদ সহগ (Input-output Co-efficient) ঘোষণার বিধান বাতিল অথবা মূল্য ঘোষণার কলাম বাদ দিয়ে মুসক ফরম ৪.৩ সংশোধন করার প্রস্তাব করেছি। এর বাইরেও আমরা আমদানি শুল্ক সংক্রান্ত কিছু প্রস্তাব করেছি।
আমরা আশা করছি এনবিআর ও অর্থ মন্ত্রণালয় বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে। আমদানি শুল্ক সংক্রান্ত প্রস্তাবের মধ্যে প্রথম স্তরে আমরা কোনো পরিবর্তন ছাড়াই সরাসরি ব্যবহৃত হয় এমন তৈরি পণ্যের সর্বোচ্চ স্তর ২৫% ক্রমান্বয়ে ২০৩০ এর মধ্যে যতদূর সম্ভব কমিয়ে আনার প্রস্তাব করেছি। দ্বিতীয় স্তরে মুসক নিবন্ধিত দেশে উৎপাদিত যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ এবং মধ্যবর্তী কাঁচামালের ক্ষেত্রে শুল্ক ৫%-৭% নির্ধারণের প্রস্তাব করেছি, তৃতীয় স্তরে যন্ত্রপাতি, তালিকাভুক্ত অত্যাবশ্যকীয় পণ্য, মৌলিক এবং দেশে উৎপাদিত হয় না এমন কাঁচামাল ক্ষেত্রে শুল্ক ১%-৩% নির্ধারণের প্রস্তাব করেছি আমরা। এছাড়া চতুর্থ স্তরে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে তালিকাভুক্ত পণ্যের ওপর পরিমাণভিত্তিক মিশ্র শুল্ক (তালিকাভূক্ত পণ্য যেমন-খাদ্যশস্য, যানবাহন, লৌহ ও ইস্পাত, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, স্বর্ণ ইত্যাদি) আরোপের প্রস্তাব করেছি আমরা।
এর বাইরে সম্পূরক শুল্ক কেবলমাত্র বিলাস দ্রব্য, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য তালিকাভুক্ত পণ্য এবং অনভিপ্রেত দ্রব্য ব্যবহার সীমিত করার উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করা, আন্তর্জাতিক লেনদেনের ভারসাম্য বজায় রাখার লক্ষ্যে আমদানি সীমাবদ্ধ করার জন্য তালিকাভুক্ত পণ্য বা সেবার ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করা, রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং বাজার বহুমুখীকরণের উদ্দেশ্যে ছোট, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে কাঁচামালের উপকরণ প্রাপ্তি সহজীকরণ করার উদ্দেশ্যে আংশিক বন্ড চালু করা এবং সেন্ট্রাল বন্ডেড ওয়্যার হাউজ চালু করা, উৎপাদনকারী, আমদানিকারক এবং ট্রেডার্সদের উদ্ভুত সমস্যা নিরসনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আয়কর, মুসক ও শুল্ক বিভাগে প্রতি ৩ মাস পর পর আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা, মূলধনী যন্ত্রের খুচরা যন্ত্রাংশ শিল্প আইআরসি’র আওতায় পৃথকভাবে আমদানি করা হলে উচ্চ শুল্কে শুল্কায়ন করা হয়- যা বিনিয়োগ ও শিল্পের পরিপন্থী বলে আমি মনে করি। এজন্য মূলধনী যন্ত্রের প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রে রেয়াতি হারে অর্থাৎ ১ শতাংশ শুল্কায়ন করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধনীর প্রস্তাব করেছি।
সার্বিকভাবে, বিশ্বায়ন পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার লক্ষ্যে দেশের বেসরকারি খাতকে দৃঢ় অবস্থানে স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টির জন্য একটি সুদুর প্রসারী, বাস্তব ও যুগোপযোগী পরিকল্পনার প্রতিফলন বাজেটে থাকবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। সেই সাথে একটি সুখী ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাজেটে সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা থাকবে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
চলমান বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার লক্ষ্যে দেশের বিনিয়োগ ও উৎপাদনশীল খাতকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে একটি শিল্প ও বিনিয়োগ বান্ধব বাজেট প্রণয়নে সরকার আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
লেখক: সভাপতি, ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)