পাতাঝরার দিন পেরিয়ে যখন বসন্ত জাগ্রত দ্বারে তখন অভিধান আর গুগল ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম স্বৈরাচার শব্দটির অর্থ নতুন করে বুঝতে। শুধুই কি পয়লা ফাগুন, ভালোবাসা দিবসের সুরও তো ছড়িয়েছে আকাশে, বাতাসে। এমন সুর, ছন্দের প্রেমে বাসন্তি রঙে রাঙিয়ে ওঠার দিনে নতুন করে স্বৈরাচারের অর্থ খোঁজা কিংবা বিপরীত শব্দের সন্ধান করা সত্যিই বেমানান। আর কী করেই বা ফাগুনের আগুনে মিশে থাকা সেই শব্দ আবারও কৌতুহল জাগায়, নিজেকেই নিজে প্রশ্ন ছুড়ি।
বায়ান্নর ফাগুনেই তো বলেছিলাম, আসছে ফাল্গুনে আমরা দ্বিগুণ হবো। রক্তের আগুনে আকাশ-বাতাস রাঙিয়ে দেব। সত্যিই আমরা বার বার দ্বিগুণ হয়েছি, শতগুণ হয়েছি, সহস্রগুণ হয়েছি। কিন্তু আমাদের দ্রোহের আগুন নেভেনি আজও। যে আগুনে দশকের পর দশক ধরে বলি হয়েছে কত প্রাণ। বায়ান্ন থেকে বাষট্টি, তিরাশি থেকে নব্বই, তারপর চব্বিশ- সবই একসূত্রে গাঁথা। ভাষা, সংস্কৃতি, শিক্ষা, গণতন্ত্র, বৈষম্যহীন সমাজের জন্য আমরা বার বার দ্বিগুণ, শতগুণ হয়েছি।
মহাকাল যখন ঘন অন্ধকারে ঢেকে যায়, তখন সমকালের হঠাৎ আলোর ঝলকানিই সম্মিলিত স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখে, পথ দেখায়। বায়ান্ন থেকে প্রায় সাড়ে সাত দশক অবধি স্বৈরশাসনের নিকষ অন্ধকারে নিমজ্জিত আমরা। নিরবিচ্ছিন্ন সেই অন্ধকারের বুকে কখনও কখনও আলোর শুধু ঝলকানিই দেখেছি, চির আলোর মুখ দেখা হয়নি কখনও। একাত্তরের পর ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল প্রথম তীব্র আলোর এক ঝলক। স্বৈরশাসকের গণবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী প্রবল এক আন্দোলন। যৌক্তিক দাবি আদায়ে রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে শিক্ষার্থীদের গর্জে ওঠার প্রথম মাইলফলক।
তবে সেইদিন শুধুই গর্জে ওঠার দিন ছিল না, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমানোর নির্মমতার আরেকটি মাইলফলকও তৈরি হয়েছিল। স্বৈরশাসকরা যে আন্দোলন দমাতে কাঠামোগত নৃশংসতায় কতটা নির্মম হয়ে উঠতে পারে, তার শুরুটাও হয়েছিল তিরাশির পয়লা ফাগুনে। যখন নব পত্রপল্লবে হরেক রঙে-রূপে সেজেছিল প্রকৃতি। শিমুল-পলাশের আগুনে রাঙা ছিল আকাশ। সেইদিন পলাশ আর কৃষ্ণচুড়ার রঙের সঙ্গে একাকার হয়েছিল শিক্ষার্থীদের রক্তের রঙ।
যেমনটা দেখেছিলাম আমরা বায়ান্নর ৮ই ফাল্গুনে। তৎকালীন স্বৈরশাসকরা ৫৪ শতাংশ নাগরিকের মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে বিজাতীয় ভাষা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। রুখে দাঁড়িয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে স্বৈরাচারের বুলেটে ঝরেছিল অনেক প্রাণ। শিক্ষার্থীদের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। সেদিনও ছিল রক্ত পলাশের বসন্ত দিন। সেই যে শুরু স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দিগুণ হওয়ার দিন।
এরপর আসে আটান্ন। ক্ষমতা দখলের দুই মাসের মাথায় স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর গঠন করেছিলেন কুখ্যাত ‘শরীফ শিক্ষা কমিশন’। পরের বছরের ২৬ আগস্টে পেশ করা সেই কমিশনের প্রতিবেদন ছিল শিক্ষা সংকোচনের পক্ষে প্রস্তাবনায় ভরপুর। যেসব প্রস্তাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসনের বদলে সরকারি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর তীক্ষ্ণ নজরদারি, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীদের বেতন বৃদ্ধি, শিক্ষকদের কঠোর পরিশ্রম করাতে ১৫ ঘণ্টা কাজের বিধানও রাখা হয়েছিল। এমনকি বর্ণমালা সংস্কারেরও প্রস্তাব ছিল।
স্বৈরাচার আইয়ুবের কুখ্যাত সেই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে যথারীতি রাজপথে নামে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন। ঢাকা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে।ফাগুনে দ্বিগুণ হওয়ার অঙ্গীকারে পাকিস্তানের শিক্ষা সংকোচন নীতি, স্বৈরশাসন, শোষণের বিরুদ্ধে কয়েক বছর ধরে চলে আন্দোলন। লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শহিদ হন ওয়াজিউল্লাহ, গোলাম মোস্তফা, বাবুলসহ নাম না-জানা অনেকে। সেই শহিদদের স্মরণে ১৭ সেপ্টেম্বর স্বীকৃতি পায় শিক্ষা দিবস হিসেবে।
লাখ লাখ প্রাণ আর রক্তের বিনিময়ে পরাধীনতা থেকে আসে স্বাধীনতা। দিন বদলে শাসক আসে, শাসক যায় অথচ স্বৈরাচার আর যায় না। ১৯৮২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ড. আবদুল মজিদ খানের নেতৃত্বে ‘মজিদ খান শিক্ষানীতির’ যে প্রস্তাব দেওয়া হয় তা ছিল গণবিরোধী। যার বিরুদ্ধে ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসে গর্জে ওঠে ছাত্রসমাজ। মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিল, সব বন্দীকে নিঃশর্ত মুক্তি, সামরিক শাসন প্রত্যাহারের তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা।
ছাত্রসমাজের সেই আন্দোলন দমাতে ধীরে ধীরে নির্মম হতে শুরু করে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক সরকার। গণবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে বিরাশির ১৭ সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন যতই প্রবল ও বিস্তৃত হতে থাকে ততই কঠোর হতে থাকে সরকার। আন্দোলন দমনে বল প্রয়োগ আর গণগ্রেপ্তারের পথ বেছে নেয় স্বৈরশাসক। টানা ছয় মাস ধরে চলা ছাত্র আন্দোলন প্রবল রূপ নেয় তিরাশির ১৪ ফেব্রুয়ারিতে। সেইদিন সচিবালয় ঘেরাওয়ের কর্মসূচি নিয়েছিল সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।
হাজার হাজার শিক্ষার্থী শান্তিপূর্ণ মিছিল নিয়ে সচিবালয়ের দিকে যাওয়ার সময় হাইকোর্ট এলাকায় ব্যারিকেডের মুখে পড়ে। সে সময় ছাত্রনেতারা যখন বক্তব্য শুরু করেছিলেন, তখন পুলিশ বেপরোয়া হয়ে ওঠে। গরম পানি নিক্ষেপ, লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেলে গোটা এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে জয়নাল নামের এক শিক্ষার্থী। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় জয়নালকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে পুলিশ। গুলিবর্ষণের সময় প্রাণ বাঁচাতে ছাত্ররা আশ্রয় নিয়েছিলেন পাশের শিশু একাডেমিতে। যেখানে তখন চলছিল শিশুদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায় অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া শিশু দীপালি। সেখানেই থেমে থাকেনি পুলিশ। নিষ্পাপ শিশু ও অভিভাবকদের ওপরও বেপরোয়া লাঠিচার্জ করে। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আহতদের চিকিৎসার জন্য অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে চাইলেও পুলিশ বাধা দেয়। ছাত্রদের লাশ গুম করে ফেলে পুলিশ।
জয়নালের মৃত্যুর খবরে ফুঁসে উঠেছিলেন ছাত্ররা। তবে তার জানাজায় অংশ নিতে আসা শিক্ষার্থীদের ওপর নির্মম হামলা আর গণহারে গ্রেপ্তার শুরু করেছিল পুলিশ ও তৎকালীন বিডিআরের যৌথবাহিনী। পরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারিতে জগন্নাথ কলেজের সামনে দুই তরুণকে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। তেজগাঁওয়ে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের দুই ছাত্রকে ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করা হয়। সদরঘাটে এক শিশুকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। একই আন্দোলনে চট্টগ্রামে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান একজন।
বিরাশির সেই পয়লা ফাগুন আর বসন্তের দ্বিতীয় দিনে স্বৈরশাসকের নির্মম হত্যাযজ্ঞে প্রাণ হারানোদের মধ্যে শুধু জয়নাল, জাফর, দীপালি, আইয়ুব, ফারুক, কাঞ্চনের নামই জানা যায়। তবে প্রকৃতপক্ষে কতজন প্রাণ হারিয়েছিলেন তা আজও অজানা। কারণ সেসব লাশ গুম করেছিল তৎকালীন স্বৈরশাসক ও তার সরকারি-বেসরকারি বাহিনী। ফাগুনের সেই আগুনঝরা আন্দোলনে ১৮ ফেব্রুয়ারি ‘মজিদ খান শিক্ষানীতি’ স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছিল এরশাদ সরকার। যে কারণে ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটি ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসের’ মর্যাদা পায়।
তিরাশির সেই ১৪ ফেব্রুয়ারির স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসে ফাগুনের আগুন আলোয় আমরা নব্বইয়ের স্বৈরাচার হটানোর আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলাম। গণতন্ত্রের আরেক ফাগুন চেয়েছিলাম। আশায় বুক বেঁধেছিলাম। শহীদদের রক্তের শপথ নিয়ে বাসন্তি সাজে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম। পাতাঝরার দিন পেরিয়ে জাগ্রত দ্বারে সুশাসন আর গণতন্ত্রের বসন্ত দিনের আহ্বানও জানিয়েছিলাম। কিন্তু সেই ফাগুন আর আসেনি। গণতন্ত্রের মোড়কে বার বার শুধু স্বৈরাচারের রক্ত রাঙানো হাতই দেখেছি আমরা।
তিরাশির স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস আর চব্বিশের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানে কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসকদের কাঠামোগত আচরণের অদ্ভুত এক মিল দেখি আমরা। সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ যে কাঠামোয় আন্দোলন দমানোর কৌশল নিয়েছিলেন ঠিক একই চিত্র দেখেছি চব্বিশেও। তিরাশির দাবি ছিল গণবিরোধী শিক্ষানীতির অবসান, নব্বইয়ে ছিল স্বৈরাচারের পতন আর চব্বিশে ছিল সমাজ আর রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে বৈষম্যের অবসান। শিক্ষার্থীদের সব আন্দোলনের গোড়ায় একটিই দাবি গণতন্ত্র, সুশাসন আর গণমুখী শিক্ষা।
স্বাধীনতার পর পরই প্রথম আমাদের হাতে এসেছিল দারুণ এক শিক্ষানীতি। প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থার বদল আর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের উপযোগী সমাজগঠনমূলক সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখার ‘ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট’। ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত সেই প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। সরকার আসে সরকার যায় সর্বজনীন শিক্ষানীতি আর পাওয়া হয়ে ওঠে না। কারণ, শাসক যখন স্বৈরাচার, কর্তৃত্ববাদী হয়, তখন গণমুখী শিক্ষার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। উন্নত রুচি আর মূল্যবোধের সমাজ থেকে যায় অধরা। লড়াইয়ে লড়াইয়ে ক্লান্ত হতে হয়। আত্মবিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে হয়।
আজ যখন দখিন-দুয়ার খোলা, বসন্ত জাগ্রত দ্বারে তখন বাসন্তি সাজে প্রেম আর ভালোবাসার আবহে প্রাণোচ্ছ্বল আমরা। গাইছি, আহা! কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে। অথচ এই পয়লা ফাগুনে ভালোবাসা দিবসে আমাদের ছাত্রসমাজের জন্য কলঙ্কময় একটি দিন। শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত শক্তিতে গর্জে ওঠার যেমন প্রথম মাইলফলক, তেমনি আন্দোলন দমাতে দেশের স্বৈরশাসকদের মানবতাবিরোধী, কাঠামোগত নৃশংসতা শুরুর দিনও। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে রক্তে রঞ্জিত নতুন বাংলাদেশে স্বৈরশাসন যেন আর কোনোদিন ফিরতে না পারে সেটাই হোক পয়লা ফাগুনের আগুন শপথ।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, সংবাদ প্রকাশ