যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের আর বাকি চার দিন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণার শেষ দিকে ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী কমলা হ্যারিস ও রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ভোটারদের উদ্দেশে তাদের সমাপনী বক্তব্য প্রদান করেছেন। তাদের সমাপনী বক্তব্যেও একে অপরকে অপমান-খোঁচা দেওয়ার প্রবণতাই দেখা গেছে। রাজনৈতিক বক্তৃতা কিংবা প্রচারের সময় বলা উক্তি একটি দেশের সামাজিক অবস্থানকে বুঝতে সাহায্য করে। কিন্তু চলতি বছর ট্রাম্পের আগ্রাসী সুর আর কমলার সতর্ক গতিতেও ছিল ব্যক্তিগত দোষারোপের ছড়াছড়ি। সংগত কারণেই প্রার্থীদের অসংলগ্ন কথা ও তাদের আদর্শ নিয়ে দেখা দিয়েছে বড় প্রশ্ন। যেকোনো আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য এমনটি নিঃসন্দেহে সুখকর কিছু নয়।
সমাপনী বক্তব্যেও কমলা হ্যারিস ছিলেন ট্রাম্পকে খোঁচা দেওয়ার তালে। প্রায় চার বছর আগে ক্যাপিটল দাঙ্গার যেখানে ট্রাম্প ভাষণ দিয়েছিলেন সেখানেই নিজের সমাপনী বক্তব্য দিলেন তিনি। কী বোঝাতে চাইলেন? যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে এমন অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিস্টকে সরিয়ে দেওয়ার বার্তা? পরোক্ষভাবে ট্রাম্পকে খোঁচাও দেওয়া হয়ে গেল।
বক্তব্যের শুরুতেই কমলা হ্যারিস বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার নারীদের গর্ভধারণ করতে বাধ্য করবেন…আপনারা প্রজেক্ট ২০২৫ গুগল করুন। যদিও ট্রাম্প এ ধরনের কিছু করার পরিকল্পনা করছেন, সে রকম কোনো প্রমাণ এখনো মেলেনি। অর্থাৎ দোষ দেওয়ার ব্যাপারে কমলাও পিছিয়ে নেই। কমলা হ্যারিস ভোটারদের নির্বাচনের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে বলেন, এই নির্বাচন সম্ভবত আপনার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভোট এবং এর মানে স্বাধীনতা ও বিশৃঙ্খলার মধ্য থেকে একটিকে বেছে নেওয়া। এর মাধ্যমে মার্কিন ভোটাররা সবচেয়ে অসাধারণ কাহিনির পরবর্তী অধ্যায় লিখতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রেও মূল্যস্ফীতি এখন বড় একটি সমস্যা। এ বিষয়ে তার বক্তব্য হলো, এখন আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো খরচ কমানো, যা মহামারির আগেও বাড়ছিল এবং এখনো অনেক বেশি। জীবনের ব্যয় সংকট নিয়ে তিনি বলেন, আমি বুঝতে পারি। তিনি তার এই সমাপনী বক্তব্যে গর্ভপাতের অধিকার রক্ষারও প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন, মানুষ তাদের নিজের শরীরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মৌলিক স্বাধীনতা রাখে।
এর বিপরীতে জনগণের কাছে ট্রাম্পের জিজ্ঞাসা- চার বছর আগের তুলনায় আপনি কি এখন ভালো অবস্থায় আছেন? পেনসিলভানিয়ার অ্যালেন্টাউনে প্রচারণা সমাবেশ করেছেন। এরপর একে একে তিনি তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো পুনরাবৃত্তি করেন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে মূল্যস্ফীতি কমানো এবং যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীদের অনুপ্রবেশ বন্ধ করা। তিনি কমলা হ্যারিসের নিন্দা করে বলেন, কমলা আমাদের লজ্জিত করেছে। তার মধ্যে নেতৃত্বের যোগ্যতা নেই। ডোনাল্ড ট্রাম্প জনগণকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান এবং কোনো প্রমাণ ছাড়াই দাবি করেন যে তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা নির্বাচনে কারচুপি করবে। ইতিমধ্যে তেমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এরপর তিনি পেনসিলভানিয়ার ল্যাঙ্কাস্টার কাউন্টির একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। সেখানকার কর্মকর্তারা এই সপ্তাহের শুরুতে বলেছিলেন যে তারা ভোটার নিবন্ধন ফরম তদন্ত করছেন, যা জাল হতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। ট্রাম্পের এমন দাবিও অবশ্য অযৌক্তিক।
ট্রাম্পের ক্ষেত্রে আগের প্রজন্মই এখন বড় সমর্থক। তারা গণতন্ত্র বলতে ট্রাম্পের দেওয়া ভাবনাকেই প্রাধান্য দেন। অন্যদিকে কমলা হ্যারিস নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি তার নির্বাচনি প্রচারে বারবার স্বাধীনতা রক্ষার কথা বলছেন। আবার ভোটারের মনে প্রশ্ন, অর্থনীতি নিয়ে ভাবনা কী। কমলা হ্যারিস ডেমোক্রেটিক পার্টির কনভেনশনে ‘স্বাধীনতা’র কথা বারবার বলছিলেন, যা তার প্রচারের অনানুষ্ঠানিক সুর হয়ে উঠেছে। তিনি ‘নিয়ন্ত্রণ থেকে স্বাধীনতা’ এবং ‘চরমপন্থা ও ভয় থেকে স্বাধীনতা’ রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শব্দের খেলাই যেন এখন তাদের ভাষণের বিষয়।
যুক্তরাষ্ট্রে যে বিষয়টি আলোচনা চলে এসেছে, তা হলো প্রগতিশীল-উদারপন্থী এবং বামপন্থীদের মধ্যে দৃঢ় ধারণা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও স্বাধীনতা উভয়ই ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে রিপাবলিকান প্রশাসনের হাতে নিরাপদ নয়। এটি নির্বাচনী আচরণের মধ্যে পড়ে না। এই আলোচনাটি অন্য বিষয়গুলোকেও প্রসারিত করেছে, যা জনগণের স্বাধীনতাকে সীমিত বা বৃদ্ধি করতে পারে, যেমন সাশ্রয়ী মূল্যের স্বাস্থ্যসেবা বা বন্দুকের গোলাগুলি বাড়তে পারে। আমেরিকানরা গণতন্ত্রে তাদের অধিকার এবং স্বাধীনতাকে সবচেয়ে বেশি লালন করে, যা মূল্যবোধের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। সমাজে অধিকার ও স্বাধীনতা এখনো পরিপূর্ণ হয়নি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, যা প্রথম সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অধিকার কখনো কখনো অস্ত্র বহনের স্বাধীনতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যা সবচেয়ে বিতর্কিত হয়ে উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্র কয়েক দশক ধরে কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে, যা সমাজকে বিভক্ত করে ফেলছে। সেটি হলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং এর বিল অব রাইটস, যেটি প্রায় ২৫০ বছরের পুরোনো। যা ২১ শতকের পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও মূল্যবোধের জন্য সব সময় উপযুক্ত নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার দুর্বলতাকেও উন্মোচিত করেছিলেন। তার সেই স্বাধীনতা অনুমোদিত কি না, তা সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য অন্য রাষ্ট্রের কাছে বল ছুড়ে দেন। মৃত্যুদণ্ডের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও একজনের স্বাধীনতা নির্ভর করে তাদের সিদ্ধান্তের ওপর।
এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্যক্তিগত আক্রোশ ও অপমানের মধ্য দিয়ে চলছে। দেশের উন্নয়নে গঠনমূলক কথাবার্তা হওয়া উচিত। কাউকেই প্রান্তে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত নয়। নাগরিক ও রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক মানেই অধিকার ও স্বাধীনতাকে বোঝায়। নির্বাচনের মূল স্তম্ভ হওয়া উচিত গণতন্ত্র। কিন্তু দুই প্রার্থীর সমাপনী বক্তব্যে কি তা পাওয়া গেছে? অন্তত না। বরং দুটো আলাদা প্রজন্মের এক সামাজিক সংঘর্ষ এখন দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।
কিন্তু এই সংঘর্ষ আসলে কিসের? সংঘর্ষ দুই প্রার্থীর প্রচারের ক্ষেত্রে। কমলা হ্যারিস একজন নারী। তার আগে হিলারি ক্লিনটন বাদে আর কোনো প্রমিনেন্ট প্রার্থী যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ছিল না। ডেমোক্র্যাটদের ব্যাটন হয়তো কমলার কাছে গেছে কিন্তু ট্রাম্প এখনোও সুইং স্টেটের জরিপে এগিয়ে। সুইং স্টেটের একটি অর্থাৎ মিশিগানে কমলা এগিয়ে। আর উইসকনসিনে দুজনই সমানে সমান। একটা বড় গেমমেকার এখানে যারা এখনো নির্ধারণ করতে পারছেন না কাকে ভোট দেবেন। সে চ্যালেঞ্জটি তো আছেই। আরও বড় চ্যালেঞ্জও আছে।
ট্রাম্প এবার কৃষ্ণাঙ্গ, ল্যাটিনো, আরব-আমেরিকান, রক্ষণশীল এবং অভিবাসীদের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণকারীদের সমর্থন পাচ্ছেন। তা ছাড়া একটি অংশ বাইডেনের অর্থনীতি নিয়েও দুশ্চিন্তায় থাকায় তাকে ভোট দিচ্ছেন। এমন নয় বাইডেন ব্যর্থ ছিলেন। কিন্তু হোয়াইট হাউজে থাকাকালে জনগণের কাছে নিজের বার্তা পৌছানোর কাজটিতে ব্যর্থ তিনি। কমলাকে সে ভার বহন করতে হচ্ছে। অন্যদিকে কমলা বরাবরই নারীদের অধিকার নিয়ে কথা বলছেন। গর্ভপাতের বিষয়ে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তার যে অভিযোগ, তার পুরোটা ট্রাম্প অবশ্য পান না। কারণ, জাতীয় স্তরে ট্রাম্প গর্ভপাতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নীতি নেননি। তবে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ‘মিডিওক্রেসি’ তৈরি করেছেন। আর এখানেই কমলার চ্যালেঞ্জ। ফলত আরব-আমেরিকানদের সমর্থন না পাওয়া এমনকি কৃষ্ণাঙ্গদের সমর্থন হারানোও তার জন্য একটি বড় সমস্যা। আবার এলজিবিটিকিউ প্লাস আন্দোলনে তার সমর্থন অনেক ক্ষেত্রে নারী ভোটারদের জন্যও অনীহার বিষয় হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্রীড়াক্ষেত্রে এর আগেও ট্রান্সজেন্ডার প্রার্থীর উপস্থিতি নিয়ে কম তর্ক হয়নি। নারীরা এসব বিষয় যেমন দেখছেন আবার রক্ষণশীল পূর্ববর্তী প্রজন্ম ট্রাম্পের কথাকেই বেশি খুশির মনে করছেন।
চলতি সপ্তাহে টেক্সাসেই এক সম্মেলনে ট্রাম্প বলেছেন, তিনি সাধারণ মানুষের ভাষায় কথা বলছেন। তার এই কথার মধ্যে অত্যুক্তি আছে কি? তার আগ্রাসী ভাষণ এখন অনেকটাই সেদিকে মোড় নিচ্ছে। কমলার সেদিকে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ সামনে। তার জন্য সতর্ক হয়ে চলাটাই মুখ্য। এখন সময় অনেক অল্প। এই অল্প সময়ে বিজ্ঞাপনী প্রচার আর সাক্ষাৎকার ছাড়া তাদের কিছুই করার নেই। কিন্তু এবারের নির্বাচনে যেন দুটো আলাদা প্রজন্মের লড়াই প্রকাশ্য হলো সমাপনী বক্তব্যে। একেবারেই ভিন্ন এবং সম্পর্কযুক্ত নয়। আর এই আগ্রাসনই ভোটারদের মধ্যে শঙ্কা আর উদ্বেগ বাড়িয়েছে। স্বয়ং বাইডেনও নির্বাচনের দিন স্থিতিশীল থাকবে কি না, তার নিশ্চয়তা দিতে পারেননি। এবারের নির্বাচনে অনেকগুলো বিষয় সামনে ছিল। পরিবেশ, নারী অধিকার, গণতন্ত্র, বৈশ্বিক সংঘাত, অর্থনীতি। এগুলোর কোনোটিরই সুস্পষ্ট ভাষ্য বয়ানে পাওয়া যায়নি। ট্রাম্প-কমলা দুজনই একে অপরকে দুষে গেছেন। আর দোষারোপের মাঝেই খুঁজতে হয়েছে দুজনের স্থিতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি।
লেখক ।। সংবাদকর্মী