নগরায়ণের ফলে মানুষ সভ্য হওয়ার তকমাধারী হলেও মানসিকতার দিক থেকে খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। বরং মানুষের মধ্যে মানবিকতা, মূল্যবোধ আগের চেয়ে কমেছে বললেও ভুল বলা হবে না। একজন মানুষ অন্য ব্যক্তির জন্য কতটা ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে, তা পত্র-পত্রিকার দিকে তাকালেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
যুগের চাহিদায় মানুষের ব্যস্ততা বেড়েছে। এই ব্যস্ত জীবনকে সহজ করে নিতে অধিকাংশ বাসা-বাড়িতে কাজের সুবিধার্থে গৃহপরিচারিকা রাখা হয়। কিন্তু বেশিরভাগ গৃহপরিচারিকাই অমানবিক জীবনযাপন করেন। টাকা দিয়ে সাহায্যকারী রাখার কারণে অনেকেই মনে করেন, ব্যক্তিটিকেই তিনি মূল্য দিয়ে কিনে নিয়েছেন। অন্যায়-অত্যাচার, যৌননির্যাতনের মতো ঘটনা প্রায়শই দেখা যায়। যেহেতু এই শ্রেণি এমনিতেই অসহায়, সেহেতু তাদের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য নেই কোনো সঠিক উদ্যোগ। তাদের প্রতি সমাজে অন্যায় ঘটলেও তাই বেশিরভাগই মুখ বন্ধ রাখেন। তারা নিজের অধিকার নিয়ে কথা বলেন না। বড় জোর সুযোগ পেলে কর্মস্থল পরিবর্তন করেন।
গৃহকর্মীর সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে। মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, শ্রদ্ধা এই সমস্যার সমাধান করতে পারে। তবে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে উঠেছে যে, এখানে শ্রেণিশোষণ বৈধতা পেয়ে গেছে যেন। উচ্চশ্রেণি সবসময় তার চেয়ে অসহায় ব্যক্তিটির প্রতি অত্যাচার-নির্যাতন করে পাশবিক আনন্দ পায়।
আমরা জানি, দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু আধুনিক যুগের দাসপ্রথা আরও শেকড় গজিয়েছে। নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে একজন ব্যক্তির ইচ্ছা, স্বাধীনতা হরণে আমাদের সমাজ বৈধতা দিয়েছে। সেই বৈধতার জেরে অন্যায় হলেও মানুষ চুপ থাকছে। মানিয়ে নিতে শিখে গেছে। তবে কতকাল এরূপ অমানবিকতার সঙ্গী হবে সমাজ? কতদিন শ্রেণি শোষণের জালে আটকে পরিচারিকারাও নিগৃহীত হবে? যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ, হত্যা, পাশবিক অত্যাচারের শিকার হবে?
শহরায়ণের ফলে একক পরিবার গড়ে উঠেছে। একইসঙ্গে নারী-পুরুষ উভয়ই নিজেদের স্বাধীনতা, জীবনযাপন সম্পর্কে অগ্রগামী ভূমিকা রাখছেন। সেক্ষেত্রে পরিবার টিকিয়ে রাখতে একে অন্যের স্বাধীনতা রক্ষা করাই বড় হয়ে উঠেছে। এই স্বাধীন জীবনযাপনের ফাঁকে মানুষ অনেক সময় অন্যায় করে বসছেন অন্য কোনো অসহায় ব্যক্তির ওপর। অতি আধুনিক পরিবারগুলো পুরুষ সদস্যদের নিপীড়নের কথা জানলেও তা গায়ে মাখছে না। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে স্বামী-স্ত্রী একই প্রবৃত্তি ধারণের কারণে পরিচারিকার ওপর যৌননির্যাতন নিয়ে কথা বলছে না। এমনকি অর্থ দিয়ে চুপ করিয়ে দিচ্ছেন। লোকচক্ষুর অগোচরে এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে।
যারা বাসাবাড়িতে কাজ করেন, তাদের অধিকাংশই স্বামী পরিত্যক্তা বা দরিদ্র পিতা-মাতার সন্তান। ফলে ভাত জোগাড়ের জন্যই তাকে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে হয়। কিন্তু এই নারীরা অধিকাংশ সময় গৃহকর্তা বা ওই গৃহের পুরুষ সদস্যের হাতে ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। এমনকি যে বা যাদের হাত ধরে কাজের সন্ধানে আসছেন, সেখানেও দালাল শ্রেণির কাছে নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। তবে এই শ্রেণি যেহেতু অসহায়, তাই সমস্যার সম্মুখীন হলেও মুখ বুজে সহ্য করেন। শুধু গৃহকর্তার যৌননির্যাতনের শিকারই নয়, এই নারীরা বাড়ির গৃহকর্ত্রী কর্তৃকও নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। পুড়িয়ে দেওয়া, ঠিক মতো খেতে না দেওয়া, মারধর করা, গোপানাঙ্গে আঘাতের মতো পাশবিক অত্যাচার চলে।
গৃহপরিচারিকাকে এমন হয়রানি করার ফলে তাদের মধ্যে পশুত্ব জেগে উঠছে। আর দিনে দিনে তা আরও হিংস্ররূপ ধারণ করছে। এর কারণ আইনের অসম প্রয়োগ। রাঘব বোয়ালেরা পার পেয়ে যাচ্ছেন নানা কৌশলে। আমাদের সমাজকে এই প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। গৃহপরিচারিকারাও যে মানুষ, সেই বিশ্বাস মনে ঠাঁই দিতে হবে। মানুষ যদি না হয় মানুষ তবে পশুবৃত্তি দেখা দেবেই। মানুষের প্রতি সদয় হতে হবে। পেটের দায়ে কাজ করতে এলেই তার ওপর পাশবিকতা দেখানোর কোনোই অর্থ নেই।
নির্যাতন, অত্যাচারের শিকার হলে এই শ্রেণির পাশে দাঁড়াতে হবে। আইনের আশ্রয় তাদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে। আইন, প্রশাসন, মানুষের সদয় দৃষ্টিই গৃহপরিচারিকাদের জীবনকে স্বাভাবিক করতে পারে। তাই আসুন মনুষ্যত্বের চর্চা করি। মানুষকে মূল্যায়ন করতে শিখি। যে যেই অবস্থানে আছে, তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি। গৃহপরিচারিকাকে পাশবিক অত্যাচার করা থেকে বিরত থাকুন। মনের প্রসারতা বৃদ্ধি করুন। মানুষকে মানুষের মর্যাদা দিতে শিখুন। মনে রাখবেন, প্রকৃত মানুষ সেই, যে অন্য মানুষকে শ্রদ্ধা এবং সম্মান করার মানসিকতা রাখে। ফলে মানুষকে সম্মান, শ্রদ্ধা নিবেদনের উপযোগী মানসিকতা গড়ে তুলুন। নিজে ভালো থাকুন, অন্যকে প্রফুল্ল জীবনযাপনে সহায়তা করুন। তবেই সব অন্যায়ের পরিত্রাণ ঘটবে।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক।