দীর্ঘশ্বাস কারও কাছে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, কারও কাছে গুরুত্বপূর্ণ। যারা ভাবে খুব স্বাভাবিক, তারা গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসানো। এদেরকে কেউ কখনো মনে রাখে না, কেউ কখনো গুরুত্ব দেয় না। অভিজিৎ রায় আমাদের কাছে এক দীর্ঘশ্বাসের নাম। বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ বিনির্মাণে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা আর প্রসার ঘটানো এক নাম অভিজিৎ রায়। অজ্ঞতার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো সমাজ-মানসে পরিবর্তনপ্রত্যাশী আলোকের এক বহ্নিশিখা। তিনি নেই আজ আট বছর। ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের চাপাতির কোপে প্রাণ দিতে হয়েছে তাকে। জ্ঞানের আধার বইয়ের লৌকিক সাহচর্য আর বইমেলা থেকে ফেরার পথে তার মাথায় আঘাত করেছে অন্ধকারের আততায়ীরা। সে আঘাতে তার দেহ থেকে রক্তের ধারা বয়েছে, সিক্ত করেছে জ্ঞানচর্চার বিদ্যাপীঠের সেই এলাকা। লুটিয়ে পড়েছিলেন তিনি মাটিতে, তার রক্ত ছুঁয়েছিল দেশের মাটি। জন্মমাটিতে লুটিয়ে পড়া অভিজিৎ শেষ পর্যন্ত প্রাণ হারান। সমাপ্ত হয় অক্ষয় এক যুগের, থেমে যায় তার কলম; চিরদিনের জন্য।
অভিজিৎ হত্যার পর তার লেখালেখি নিয়ে আরও বেশি আলোচনা হয়েছে। পশ্চাৎপদ মানসিকতার যারা, তারাও আলোচনা করেছে। এই আলোচনায় গ্রহণের ঔদার্য ছিল না স্বাভাবিকভাবেই। তারা তার হত্যাকাণ্ডকে জায়েজিকরণে মেতেছিল পুরোদস্তুর। তাতে কি! এই সংকীর্ণতা-দৈন্যের প্রভাব পড়েনি সমাজে; এ যে অগ্রসর আর অনগ্রসরের চিরায়ত দ্বন্দ্ব, একই সঙ্গে সাফল্য-ব্যর্থতার নিক্তি-যোগ, যেখানে সফলেরা ঠিকই বেরিয়ে আসে নিজস্ব ভঙ্গিমায়। কুসংস্কার, লৌকিক বিশ্বাস আর বিজ্ঞানের চিরায়ত দ্বন্দ্ব ছিল লেখার জায়গা। তিনি লিখেছেন, জীবদ্দশায় যতটা পেরেছেন লিখেছেন। তার সেই লেখালেখির উদ্দিষ্টজনেরা সমকালে হাজার-হাজার থাকবে এমন তো না, এর নিকেশ নিশ্চয়ই মহাকালের কাছে। মহাকাল নির্ধারণ করে সত্যাসত্য, আর বিষয় যেখানে বিজ্ঞান আর বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা তখন সে তো সমকালের সমকালীন চিন্তা থেকে কয়েক ধাপ ওপরে।
অভিজিৎ রায়ের লেখালেখির বিরুদ্ধবাদীদের নেতিবাচক প্রচারণায় লাভবান হয়েছে বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তার জগৎ। ওই জগতের সীমা আরও প্রসারিত হয়েছে। আলোচনা নানা জায়গায় উঠেছে, আর এতে অগ্রসর সমাজচিন্তার মানুষেরা তাকে খুঁজে পেয়েছে সহজেই। যার প্রভাব পড়বে, পড়তে বাধ্য আসলে। এই প্রভাব কিংবা পরিবর্তন প্রাথমিক পর্যায়ে বিপ্লব-রূপ হবে না ঠিক, তবে কিছু কিংবা অনেক মানুষের চিন্তাজগতে স্বতন্ত্রভাবে আলোড়ন তুলবে। এতে করে এক-এক করে হাজার থেকে লক্ষ কিংবা পর্যায়ক্রমে এমন চিন্তা এবং এর চেয়েও অগ্রসর চিন্তার প্রসার ঘটবে। এই প্রসার-সম্ভাবনা অবশ্যম্ভাবী স্থানিক পর্যায় ভেদ করে বৈশ্বিক পর্যায়েও। আমাদের এখানে সমকালে তরুণদের মধ্যে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অভিজিৎ রায়, আগেও ছিলেন অনেক, ভবিষ্যতে আসবেন আরও অনেকই হয়তো। নাম ভিন্ন, প্রক্রিয়া ভিন্ন, ভিন্ন উপস্থাপনাজগৎ; অথচ অভিন্ন চিন্তাজগৎ সবার, সংস্কার-পরিবর্তন।
অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাশ, ফয়সল আরেফিন দীপনদের হত্যার পর যত লোকের মুখের ওপর থেকে মুখোশ সরে গেছে, তারাও চাপাতিওয়ালাদের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সমর্থক। সব হাতে চাপাতি ওঠে না, তবে চাপাতিওয়ালারা তাদের ব্যক্তিগত দুই হাতের সঙ্গে আরও অনেক হাত খুঁজে, আরও অনেক মন খুঁজে সমর্থনের। তারা পেয়েছে। সর্বোচ্চ স্তর থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন স্তর এবং এর বাইরে নিজেদের প্রগতিশীল দাবিদার অনেকের কাছ থেকেই। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অভিজিৎ রায়-অনন্ত বিজয় দাশদের খুনের পর অনেকের ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে গেছে। ধর্মকে টিকিয়ে রাখতে শক্তিপ্রয়োগ দরকার—এমন বিশ্বাস জোর করে চাপিয়ে দিতে চেয়েছে একদল লোক ব্যক্তিগতভাবে, সাংগঠনিকভাবে।
অভিজিৎ রায় তার দেহ দিয়ে গেছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের কাজে ব্যবহারের জন্য। অভিজিতের বিশ্বাসপ্রেমীর মতো অভিজিতের বিশ্বাসবিদ্বেষীদেরও সুযোগ নেই তাকে অগ্রাহ্য করার। মরে গিয়ে অভিজিৎ থাকছেন, বেঁচে থাকতে যতটা ছিলেন না। হত্যাকাণ্ডের আট বছরে অভিজিৎ রায়ের হত্যা মামলার রায় হয়েছে। রায় হয়েছে অভিজিতের বই প্রকাশের কারণে একই কায়দায় হত্যার শিকার হওয়া জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনদ হত্যাকাণ্ডের। এক মামলায় ছয়জনের দণ্ড আর আরেক মামলায় হয়েছে আটজনের দণ্ডের রায়। এদের মধ্যে অভিজিৎ হত্যার প্রকাশ্য উসকানিদাতা ফারাবীর হয়েছে যাবজ্জীবন দণ্ড। শুরুতে মনে হয়েছিল খুনিরা পার পেয়ে যাবে, বিচার হবে না; কিন্তু সব শঙ্কাকে দূরে ঠেলে দিয়ে এ দুই মামলার বিচারিক আদালতের রায় হয়েছে। দণ্ডপ্রাপ্ত একাধিক অপরাধী পলাতক যদিও, তবু এই রায়গুলো উল্লেখযোগ্য, এই রায়গুলো বিচারিক দীর্ঘসূত্রতার পথে সামান্য হলেও অন্তত বাদ সেধেছে। এই রায়গুলোর পর আমরা একই কায়দায় হত্যার শিকার হওয়া অন্য মামলাগুলোর রায়ের অপেক্ষায় আছি। অপেক্ষায় আছি পলাতক খুনিদের গ্রেপ্তার-পরবর্তী তাদেরসহ দণ্ডপ্রাপ্ত সবার রায় কার্যকরের।
অভিজিৎ রায়, আপনি বিশ্বাসী আর বিশ্বাস—এ দুইয়ের মধ্যে বিশ্বাসকে লেখার উপজীব্য করে বিশ্বাসীদের কট্টরভ্রান্তি নিরূপণের জন্য যৌক্তিক লেখনীতে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। বিশ্বাসী নয়, বিশ্বাসকে তাই আলোচ্য করেছিলেন যৌক্তিকতার নিক্তিতে। আপনার এ লেখনীধারা অনেকেই নিয়েছে গ্রহণভঙ্গিতে, অনেকেই নিয়েছে উল্টোভাবে। যারা উল্টোভাবে নিয়ে উল্টোপথে হেঁটেছে তারা আপনাকে বিশ্লেষণ করতে পারেনি। এটা তাদের ব্যর্থতা।
লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক