পৃথিবীতে যুগে যুগে যত স্বাধীনতা স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন হয়েছে, সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই নৌবাহিনীর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। সমুদ্র যার, শাসনদণ্ড তার— এই ধরনের শ্রুতি কথা বহু আগে থেকেই চলে আসছে। সাগরের অর্থাৎ নৌপথের আধিপত্য জাতিকে যেকোনো দুঃসাহসিক কাজ মোকাবিলা করার সাহস জোগায়। ইউরোপের রেনেসাঁসের উদ্ভব ও বিস্তারেও ছিল এই সমুদ্রাধিকার। এছাড়া সকল স্বাধীনতা সংগ্রামে নৌ-বিদ্রোহ স্বাধীনতার বাঁককে ভিন্নভাবে নির্মাণ করে, গতিপথকে সহজ করে দেয়। ভারতবর্ষের ইতিহাসে আমরা দৃষ্টি অবলোকন করলেই আমরা এর প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই।
১৯৪৬-এর নৌ-বিদ্রোহ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কলার ধরে ঝাঁকিয়েছিল স্বাধীন দেশের স্বপ্ন।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অবমূল্যায়িত ঘটনাগুলির মধ্যে একটি ছিল ১৯৪৬ সালের নৌ বিদ্রোহ, যার সম্পর্কে ভারতীয় ইতিহাসবিদ সুমিত সরকার লিখেছেন, ‘যদি এই বিদ্রোহ সফল হতো, তাহলে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ভিন্ন মোড় নিতে পারত।’ সে বছরের ১৮ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বম্বে শহরের রয়াল ইন্ডিয়ান নেভির নৌ প্রশিক্ষণ জাহাজ ‘তলোয়ার’য়ে সিনিয়র সিগন্যালম্যান এম এস খানের নেতৃত্বে সূচনা ঘটে বিদ্রোহের। প্রাথমিকভাবে অনশন এবং ধর্মঘটের মাধ্যমেই শুরু হয় আন্দোলন এবং ধীরে ধীরে আরও ২২টি জাহাজে ছড়িয়ে পড়ে। বম্বে থেকে শুরু হলেও পরে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বিদ্রোহের আঁচ। করাচি ও কলকাতা থেকেও আসে সমর্থন। বিদ্রোহ পরিচালনা করার উদ্দেশ্যে ঘটিত হয় ‘কেন্দ্রীয় ধর্মঘট কমিটি’ও। মোট ৭৮টি জাহাজ, ২০টি তীরবর্তী প্রতিষ্ঠান এবং ২০,০০০ নৌবাহিনীর নাবিক যুক্ত হন এতে। এছাড়াও নৌ-কর্মীদের সঙ্গে যোগ দেন সাধারণ মানুষ। কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে বম্বে ও কলকাতা।
বিদ্রোহীরা রাজকীয় নৌবাহিনীর ব্রিটিশ পতাকা ‘ইউনিয়ন জ্যাক’ নামিয়ে দিয়ে ভারতের ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা উত্তোলন করেন, দাবি উঠল, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাদের মুক্তি ও ভারতের স্বাধীনতা। কিন্তু এই ধর্মঘট শেষ হয় আকস্মিকভাবেই। আসাফ আলী ছাড়া, কোনো রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না, যিনি এই লড়াই চালিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন। এমনকি মহাত্মা গান্ধীও নৌসেনাদের অস্ত্র প্রত্যাহারের আহ্বান করেছিলেন।
গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের নীতিগত অবস্থান নিয়ে তখনও সমালোচনা হয়েছিল। যদিও শোনা যায়, জওহরলাল নেহেরু নাবিকদের কাছে গিয়ে তাদের সমর্থন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেসের কমিটির আলোচনার পর নেহেরুকে সে কাজ করতে দেওয়া হয়নি। পরবর্তীকালে গ্রেপ্তার করা হয়, এরপর কোর্ট মার্শাল এবং রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভি থেকে ৪৭৬ জন নাবিককে বরখাস্ত করা হয়। যাদের বরখাস্ত করা হয়, তাদের কাউকেই স্বাধীনতার পর ভারতীয় বা পাকিস্তানী নৌবাহিনীতে পুনর্বহাল করা হয়নি। ব্রিটিশরা আতঙ্কিত হয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করার জন্য একটি ক্যাবিনেট মিশন ঘোষণা করে। ইতিহাসবিদরা বলছেন এটি ক্ষমতা হস্তান্তরকে ত্বরান্বিত করেছে। (প্রমোদ কপুর 1946—The Last War of Independence: Royal Indian Navy Mutiny-এ বিস্তারিত লিখেছেন এ বিষয়ে )। এখানে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে নৌ-বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল সে কথাও তুলে ধরা হয়।
নৌ-বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের এই উপলবদ্ধি হয় যে সশস্ত্র বাহিনীর সাহায্যে তাদের পক্ষে ভারতে সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব আর বেশি দিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। বহুল চর্চিত না হলেও, বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী আন্দোলনের এক অবিস্মরণীয় স্মৃতি হিসাবেই চিরকালীন উজ্জ্বল হয়ে লেখা থাকবে ‘৪৬-এর নৌ বিদ্রোহের নাম, যা ভারতকে স্বাধীনতা লাভের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
একইভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দিকে তাকালে নৌবাহিনীর ভূমিকা আপাতদৃষ্টিতে কম জোরালো মনে হয়। কিন্তু ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই আমরা এর সত্যিকারের ইতিহাস ও অবদান উপলব্ধি করতে সক্ষম হই। মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বাঙালিদের সাহস ও পথ দেখান ফ্রান্সের তুঁলন নৌ বন্দর থেকে পালিয়ে আসা ৮ জন বিপ্লবী যোদ্ধা।
২৯ মার্চ ১৯৭১ সালে ফ্রান্সের তুঁলনে প্রশিক্ষণরত সাবমেরিন থেকে পাকিস্তান নৌবাহিনীর ৮ জন বাঙালি নাবিক বিদ্রোহ করে মৃত্যুদণ্ডের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে পালিয়ে আসেন। এই বিদ্রোহ কেবল লড়াইয়ের গল্প নয়, নানা প্রেক্ষাপট লুকিয়ে রয়েছে সেখানে। রয়েছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। তারা সবাই নৌবিদ্রোহের জ্বলন্ত মশাল ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন। এই ৮ জন সাবমেরিনারের একান্ত আগ্রহেই বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার ভারতীয় নৌবাহিনীর সহযোগিতায় পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ঐতিহাসিক পলাশী প্রান্তরে একটি নৌ কমান্ডো বাহিনী গঠন করে।
নৌবাহিনী কমান্ডো গঠনের পর পলাশীর প্রান্তরে ৩টি ব্যাচে মোট ৫১৫ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এরমধ্যে কয়েকজন কঠিন প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে গেলে নৌকমান্ডোর সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৭২ জনে। মূলত নৌ-কমান্ডোরা প্রশিক্ষণ শেষ করে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর শক্তিকে নিঃশেষ করতে, তাদের রসদ সরবরাহের পথ ধ্বংস এবং প্রয়োজনীয় উপকরণ আনয়নের উপায়কে অচল করে দেয়। এক্ষেত্রে নৌ-কমান্ডো বাহিনীর সবচেয়ে বড় সফলতা হল ‘অপারেশন জ্যাকপট’। ১৯৭১ সালের ১৫ ও ১৬ আগস্ট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নৌ-কমান্ডোরা পূর্ব পাকিস্তানের জলসীমায় তথা প্রধান প্রধান সমুদ্রবন্দর ও নদীবন্দরে যে দুঃসাহসিক ধ্বংসাত্মক আক্রমণ পরিচালনা করে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তার নাম ‘অপারেশন জ্যাকপট’। এ আক্রমণের বিশালতা যেমন ব্যাপক, ক্ষয়ক্ষতিও তেমনি অনেক বেশি এবং এ আক্রমণ রীতিমতো সমগ্র বিশ্বকে হতভম্ব করে দেয়।
অপারেশন জ্যাকপটের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত অবস্থা বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে ও পশ্চিম পাকিস্তানের সহযোগী রাষ্ট্রগুলো ভয় পেয়ে সকল প্রকার সহযোগিতা প্রদানে বিরত থাকে। ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অস্ত্র সাহায্য সহযোগিতার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। নৌ-কমান্ডোদের অব্যাহত আক্রমণে বাংলার সব সমুদ্র ও নদী বন্দর সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হওয়ায় দখলদার বাহিনীর সকল সরবরাহের পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। ফলাফল হিসেবে তাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হতে থাকে। এদিকে মুক্তিযোদ্ধারা তখন পরিপূর্ণভাবে বিজয় অর্জনের প্রতিজ্ঞায় লড়াই চালিয়ে যায়।
এই অপারেশনটি হয়েছিল একদম উপযুক্ত সময়ে, যখন দেশের মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের সফলতা এবং বিজয় নিয়ে সন্দিহান ছিল, ঠিক সেসময় নৌ-কমান্ডোদের এই অপারেশন তাদের হারানো মনোবলকে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। যেকোনো সফলতা বা বিজয় অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো দৃঢ় মনোবল। যথাযথ চেষ্টা বা লড়াইয়ে বিজয় অর্জন করা সম্ভব এই ধারণা যখন প্রতিযোগীর মধ্য সৃষ্টি হয় তখনই মূলত বিজয় অর্জনের পথ সুগম হয়। এভাবে বিজয় অর্জনের দিকে ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করে এই অপারেশন জ্যাকপট যার পেছনের মূল কারিগর এই ৮ জন সাবমেরিনার।
ওই ৮ জন নাবিক যদি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভারতে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে নৌ-কমান্ডো বাহিনী গঠনের অভিপ্রায় ব্যক্ত না করতেন, তবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নৌ-কমান্ডো বাহিনীর মহান অবদান রাখার কোনো সুযোগ সৃষ্টি হতো না। আর বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ যা বলেছিলেন, ‘তোমাদের অভিযানের ওপরই নির্ভর করবে মুক্তিযুদ্ধের স্থায়িত্বকাল।’ তার এই উক্তির যথার্থ পরিস্ফুটন ঘটতো না। পালিয়ে আসা ৮ জন বিপ্লবী যোদ্ধার একান্ত প্রচেষ্টায়, তাদের নেতৃত্বে ও ভারতীয় নৌবাহিনীর নির্ভুল পরিকল্পনা মোতাবেক ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় দক্ষ নৌকমান্ডো বাহিনী গঠিত হয়ে জাতির মাঝে সাহসিকতার সঞ্চার ঘটে। অর্থাৎ দেশের ভূখণ্ডের যে মানচিত্র তা বদলে দিয়েছেন এই ৮ জন বিদ্রোহী সাবমেরিনার। তাদের ছাড়া নৌকমান্ডো বাহিনী গঠন সম্ভব ছিল না। নৌকমান্ডো বাহিনী ছাড়া তখন স্বাধীনতা অর্জনের প্রক্রিয়াটি অনেক বেশি জটিল হতো।
ভিয়েতনামের স্বাধীনতা অর্জনে যেমন দীর্ঘ ২০ বছর লেগেছে, দেশের অগণিত সাধারণ মানুষ রক্তাক্ত হয়েছে; অনুরূপ হয়তো বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনেও দীর্ঘ সময় ও অধিক প্রাণের বলিদান দিতে হতো।
একটা যুদ্ধে শত্রুদের প্রয়োজনীয় উপকরণ বন্ধ করে দিয়ে তাদের কোণঠাসা করে দেওয়া হলো সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। আর এই কাজটি করেছিলেন নৌকমান্ডো বাহিনীর নেতৃত্বে থাকা সেই ৮ জন বীর বাঙালি নাবিক। নৌ-কমান্ডোদের অব্যাহত আক্রমণে বাংলার সকল সমুদ্র ও নদী বন্দর সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হওয়ায় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর সব সরবরাহের পথ বন্ধ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক দেওয়ার পরে দেশের মানচিত্র সৃষ্টিতে যুদ্ধক্ষেত্রে যারা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন, এই ৮ জন তাদের অন্যতম।
লেখক : সাবেক সহকারী নৌ বাহিনী প্রধান ও প্রো -ভিসি বিইউপি