• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ছাত্র আন্দোলন নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে


দীপংকর গৌতম
প্রকাশিত: জুলাই ৩১, ২০২৪, ১২:১২ পিএম
ছাত্র আন্দোলন নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে

গত ১৬ বছরে আমরা অনেক আন্দোলন দেখেছি। এর মধ্যে ছাত্র আন্দোলন অনন্য। এর প্রধান কারণ হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা যেমন সংগঠিত, এক ছাত্র আরেক ছাত্রের প্রতি সহানুভূতিশীল, সর্বোপরি সাধারণ জনগণ যেকোনো ছাত্রের ভেতরে তার সন্তানের মুখ দেখতে পায়। এসব বিষয়গুলো এত আবেগতাড়িত সম্পর্কের যে ছাত্র আন্দোলন তাই যেকোনো আন্দোলনের চেয়ে প্রকট হয়ে ওঠে। ১৯৯০ সালের পরে এবারের ছাত্র বিক্ষোভই কি সরকারকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছে কি না এ প্রশ্ন অনেকের।

ইতিপূর্বের ছাত্র আন্দোলনে তীব্রতা ছিল, অংশগ্রহণ ছিল, কিন্তু এ ধরনের নাশকতার মনোবৃত্তি ছিল না। রাষ্ট্রীয় সম্পদের ওপর এত নাশকতা ইতিপূর্বে দেখা যায়নি। তবে একই সঙ্গে এটাও ঠিক ছাত্রদের ২০১৮ সালের আন্দোলন যেভাবে দমন করা হয়েছিল, যাদের ছাত্রলীগ পিটিয়ে দমন করেছিল এখন তাদের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া। তারা কি সে আক্রোশ পুষেছিল, না অন্য কোনো ঘটনা এর সঙ্গে যুক্ত এটা ভেবে দেখা দরকার।

এবারে বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতার পর কারফিউ জারি ও সেনা মোতায়েনের পর বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের শেষে ক্ষমতায় আসার পর থেকে আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে এবারের ঘটনাই ছিল সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের, যা সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে চিন্তায় ফেলেছিল বলে মনে করেন তারা। চলতি মাসের শুরু থেকে ছাত্র বিক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করলেও গত ১৬ জুলাই ছয়জনের মৃত্যুর পর ১৮ ও ১৯ জুলাই ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক সহিংসতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিবর্ষণ, শতাধিক মৃত্যু, বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন এবং ইন্টারনেট বন্ধের ঘটনা সারা বিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। পরিস্থিতি এমন আকার নেয় যে তার নিয়ন্ত্রণে গত ১৯ জুলাই শুক্রবার মধ্যরাতে সরকার কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েন করে। এরপর পরিস্থিতি ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসছে বলে সরকার থেকে বলা হলেও, প্রশ্ন উঠছে যে এবারের ঘটনাই আওয়ামী লীগের তিন মেয়াদের শাসনকালের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বা সরকারকে উদ্বেগে ফেলেছিল কী-না। এ ব্যাপারে যদিও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলছেন, সরকার উদ্বিগ্ন হয়েছে ‘দেশ আক্রান্ত হয়েছে বলে’, তবে এখানে ভয় পাওয়ার বা চিন্তায় পড়ে যাওয়ার কোনো ব্যাপার নেই।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে মুখোমুখি হয়েছিল বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের। কিন্তু বর্তমান কোটা সংস্কার আন্দোলনের মতো অন্য কোনো আন্দোলন তাদের এত ভাবিয়েছিল বলে মনে হয় না। বর্তমান সরকার প্রথমে যে সংগ্রামের মুখোমুখি হয় দেশের ইতিহাসের ভয়াবহ ঘটনাগুলোর একটি, সেটা বিডিআর বিদ্রোহ। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একযোগে বিডিআর সদস্যরা বিদ্রোহ করেছিলেন। সে ঘটনায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জন নিহত হয়েছিলেন। এদের মধ্যে তৎকালীন বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদকেও হত্যা করা হয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেনাবাহিনী ও আনসার বাহিনীতে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটলেও বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় নৃশংসতা বেশি ছিল বলে মনে করা হয়। এ ঘটনার ২১ মাস পর বিডিআর নাম বাদ দিয়ে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) নাম রাখা হয়। ওই ঘটনার চার বছর পর ২০১৩ সালের নভেম্বরে নিম্ন আদালত হত্যা মামলায় রায় ঘোষণা করে। দেশে এ ধরনের বিদ্রোহের মুখোমুখি সরকার প্রথম হয়েছিল। সারা দেশে এ ঘটনা ছাপ ফেলেছিল। এরপরই বলা যায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনের কথা। ২০১০ সালের মার্চে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে দেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে নানা চাপের মুখে পড়ে আওয়ামী লীগ সরকার। এক পর্যায়ে ২০১২ সালের শেষদিক থেকেই ঢাকাসহ সারা দেশে চোরাগোপ্তা হামলা ও অগ্নিসংযোগ শুরু হয়। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে জামায়াতে ইসলামীর নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশের পর সহিংসতা আরও বেড়ে যায়। এর আগে প্রথমে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় ঘোষণার পর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময়েও দেশের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ওই আন্দোলন চলাকালেই ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডসহ নানা ঘটনায় দেশের পরিস্থিতি টালমাটাল হয়ে পড়ে, যা নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারকে তখন বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।

এরপর বিভিন্ন সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় কয়েকজন জামায়াত নেতার ফাঁসি কার্যকরের সময়েও দেশের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। এ ঘটনার ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালের এপ্রিলে শাহবাগে যখন গণজাগরণ মঞ্চের ব্যানারে অবস্থান কর্মসূচি চলছিল তখন সক্রিয় হয়ে উঠেছিল কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েকজন ব্লগারের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগসহ ১৩ দফা দাবি তুলে সংগঠনটি লংমার্চ ও ঢাকা অবরোধের মতো কর্মসূচি নিয়ে আলোচনায় উঠে এসেছিল। ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামেরর ঢাকা অবরোধ এবং শাপলা চত্বরে অবস্থান নেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ নিয়েছিল পল্টন মোড় থেকে বায়তুল মোকাররম মসজিদের চারপাশের রাস্তা এবং মতিঝিল এলাকা। বিভিন্ন ভবনে অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষ সহিংসতার প্রেক্ষাপটে পুলিশও দফায় দফায় গুলি চালিয়েছিল। পরে মধ্যরাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তিন দিক থেকে ঘিরে ধরে অভিযান চালিয়ে শাপলা চত্বরে অবস্থানকারীদের সরিয়ে দেন। এ সময় ফাঁকা গুলি, কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড আর শত শত রাউন্ড গুলির শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল পুরো এলাকা।

এরপরেই আসে ২০১৪ সালের নির্বাচনকে ঘিরে বিরোধীদের সহিংস আন্দোলনের কথা। ২০১৪ সালের নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপি ও জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলো বর্জন করে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছিল। বিরোধী দলগুলো নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিল। এর জের ধরে নির্বাচনের আগে ও পরে প্রায় তিন মাস ধরে সংঘাত সহিংসতা হয়েছিল বাংলাদেশে। ঢাকায় অসংখ্য বাসে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছিল। নির্বাচনের পর ধীরে ধীরে সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়েছিল। যদিও নির্বাচনের আগে ৩৮টি জেলায় দেড় শর মতো কেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ করা হয়। বিভিন্ন জায়গায় ব্যালট পেপার ও নির্বাচন সরঞ্জাম পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিসংতায় ভোটের দিন অন্তত ১৮ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছিল। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাসে আগুন ও বোমা বিস্ফোরণের অভিযোগে দুই শর বেশি মামলা হয়েছিল। সরকারের অভিযোগ, ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের মামলার বিচার ও ২০১৪ সালের নির্বাচন বানচাল করতে বিএনপিসহ বিরোধী নেতাকর্মীরা ওই সময় ‘যানবাহন ও বিভিন্ন ধরনের স্থাপনায় আগুন দিয়েছিল’। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশজুড়ে চলছিল স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন। ঢাকায় বাস চাপায় দুই শিক্ষার্থী মৃত্যুর জের ধরে ওই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। ছাত্র বিক্ষোভ সামাল দিতে বিক্ষোভের তিন দিনের মাথায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার পর আন্দোলন আরও ছড়িয়ে পড়ে। উল্টো আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক সমালোচনা ও চাপে পড়ে সরকার। ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভকারীরা আন্দোলন আরও জোরদার করলে সংসদে সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ পাস করে সরকার।  

বিডিআর বিদ্রোহ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন, হেফাজতে ইসলামের শাপলা চত্বরে অবস্থান, কোটা সংস্কার আন্দোলন, শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং সবশেষ চলতি মাসের দ্বিতীয় দফার কোটা সংস্কার আন্দোলনের মতো ঘটনাগুলোতে সরকারকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। তবে আগের ঘটনাগুলোতে প্রাণহানির সংখ্যা ও সহিংসতার মাত্রা এবারের চেয়ে অনেক কম ছিল এবং সেগুলো মোকাবিলায় সরকারকে এবারের মতো ‘চিন্তিত’ মনে হয়নি বলে বলছেন বিশ্লেষকদের অনেকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শারমীন আহমেদ বলছেন, বিডিআর বিদ্রোহ থেকে শুরু করে চলমান কোটা আন্দোলন পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনাই রাষ্ট্রযন্ত্রকে নাড়া দিয়ে গেছে। এবারের আন্দোলন প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলছেন, চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের সাথে যে জনগণের অনেক দূরত্ব তৈরি হয়েছে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এবার। সরকারকে হতবিহ্বল এবং রাজনৈতিক মোকাবিলার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত মনে হয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে প্র্যাকটিস হয়ে গেছিলো যে ছাত্রলীগ এগুলো মোকাবিলা করবে। এবার কৌশলটা বুমেরাং হয়েছে। এ কারণে ছাত্রদের তোপের মুখে ছাত্রলীগকে পালাতে হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার উপায় খোঁজার চেষ্টাটা ছিল দৃশ্যমান

আর শারমীন আহমেদ বলছেন, এবারের ঘটনায় টিকতে হলে সরকার ও আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গিতে বেশ পরিবর্তন আনতে হবে। এবারের ঘটনা আগেরগুলোর চেয়ে সার্বিক বিচারে সরকারের জন্য অনেক বেশি আঘাত ছিল। অনেকগুলো ফ্যাক্টর এবার একসাথে কাজ করেছে, যেগুলো নিয়ে করণীয় নির্ধারণে সরকারকে কিছুটা হলেও হিমশিম খেতে হয়েছে বলে মনে হচ্ছিলো।

তবে বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছেন, আক্রমণ, ধ্বংসযজ্ঞ বা হামলা এলে ধৈর্যসহকারে সরকারকে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হয়, এবারের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সরকারের দায়িত্ব জনগণের জানমাল রক্ষা করা এবং সেজন্য যা করণীয় তাই করেছে সরকার। রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করে কখনোই হামলাকারীরা টিকতে পারে না, পারবেও না।

তারপরও সরকার এত বড় ঘটনার কথা ইতিপূর্বে ভেবেছে বলে আমরা জানি না। তবে এ আন্দোলনকে শান্ত করতে সরকার যাদের ওপর নির্ভর করেছিলেন তারা কি তাদের দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে? হত্যা সংখ্যা ১৪৭ বা ২১৪ হলো, এত হত্যা এর আগে কোনো ছাত্র আন্দোলনে কেউ দেখেনি। এত মৃত্যু সরকারকে একদম স্পর্শ করেনি? তবে জনগণ ক্ষুব্ধ হয়েছে কতোটা তা বলে শেষ করার মতো নয়? রংপুরে নিহত আবু সাঈদেও মা বলেছেন, ‘চাকরি না দিবু না দিলি, মোর ছাওয়াক মারি ফেলবু?’ এর কোনো জবাব আছে? এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে জনগণ খুশি হয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ ইতিপূর্বেও বলেছি জনগণ ছাত্রদের সব সময় সমর্থন করে। কারণ ছাত্রর ভেতরে সে সন্তানের মুখ দেখে। ছাত্র আন্দোলন সব সময়ই যেকোনো ক্ষমতাসীনদের নাড়া দেয়। ছাত্রদের ওপর হামলা হলে জনগণের সন্তানের ওপর হামলা হয়। যে কারণে ছাত্র আন্দোলন নিয়ে সরকারকে ভাবতে হয়। এবারেও তার বিকল্প হয়েছে বলে মনে হয় না।

Link copied!