তিন ভাই ও এক বোনের সংসারে জমির আলী দ্বিতীয়। বাবা ছিলেন ভূমিহীন কৃষক। ফলে অভাব আর কষ্ট ঘর ছাড়ত না। জমিররা প্রথম ছিলেন সিলেটের বিশ্বনাথে। কাজের খোঁজে বাবা মোস্তফা আলী পরিবারসহ চলে আসেন সুনামগঞ্জে। আধি জমি বর্গা নিতেন। ফসল উঠলেই অর্ধেকটা দিয়ে দিতে হতো জমির মালিককে।
বাবার সঙ্গে কাজে যেতেন জমিরও। বর্ষা এলে তার আনন্দ যেত বেড়ে। বন্ধু তাহের আলী, শওকত, গফুর, কিরনের সঙ্গে ব্যস্ত থাকতেন কপটি (কাবাডি) খেলায়। দলবেঁধে মাছ মারতেন দেখার হাওরে। বড় বড় বোয়াল, আইড়, বাইম, আর চিংড়ি মিলত তখন। হাওরে পোষ-মাঘে পানি যেত কমে। মাছ ধরাতে তখন উৎসব লাগত। শিং, কৈ, পুঁটি, মাগুর, ঢেলা, শোল ধরতেন হাতে হাতে।
এভাবে আনন্দ-হাসিতে কেটে যাচ্ছিল জমির আলীর জীবন। কিন্তু সবকিছুর ছন্দপতন ঘটে যখন তার বাবা মারা যান।
ডায়রিয়ার তখন প্রতিষেধক ছিল না। মানুষ মরে গ্রামের পর গ্রাম শূন্য হয়ে যেত। দুদিনের মাথায় জমিরের বাবাও মারা গেলেন। তখন পরিবারের হাল ধরেন তার মা জুবেদা খাতুন। কাজে নামেন তিনিও। গ্রামের মোদরিশ আলী আর মকবুল আলীর বাড়িতে গৃহস্থীর কাজ করে যা পেতেন, তাই দিয়েই চলত তাদের পরিবার।
যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ জমির আলীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল তার বাড়িতে বসেই। বাড়ি সুনামগঞ্জের দোয়ারা বাজার উপজেলার চণ্ডীপুর গ্রামে।
জমিররা ছিলেন শ্রমজীবী মানুষ। দেশ নিয়ে তেমন কোনো ভাবনা ছিল না তার। চাচা ফজলুর রহমান ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য। তিনি খবরের কাগজ পড়তেন। তার মুখে শুনতেন দেশ নিয়ে নানা বৈষম্যের কথা। তখন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সামাদ আজাদ আর বরুণ রায় সমাবেশে বক্তৃতা দিতেন। সে থেকে জমির আলীও জেনে যেতেন পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতি শোষণের নানা খবরগুলো।
তার ভাষায়–‘আমগো দেশে সবকিছু ফলত। ওইগুলা চইলা যাইত পশ্চিম পাকিস্তানে। ওরা সিল মাইরা পূর্ব পাকিস্তানে পাঠাইলে আমগো ওইটা বেশি দামে কিনতে হইত। সাড়ে সাত কোটি তহন বাঙালি। ওরা তহন আরও কম।’
“ছয় দফার পর ওরা শেখ সাহেবরে জেলে নিল। বাঙালি তহন আন্দোলন কইরা তারে বাইর কইরা আনল। তহনই বুঝছি শেখ সাহেবরে ক্ষমতায় আনতে হইব। সত্তরের নির্বাচনে নৌকায় ভোট দিলাম। তহন কথা কইতাম নৌকার পক্ষে। কিন্তু গ্রামের মাহমুদ আলী আর হাতিম মোল্লারা ছিল মুসলিম লীগার। বাড়ি বাড়ি গিয়া ওরা কইত, ‘নৌকায় ভোট দিও না। ভোট দিলে অসুবিধা আছে।’ তবু ওরা নৌকারে ঠেকাইতে পারে নাই। আমগো ওইখানে এমএনএ হন হক সাহেব।”
সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা দিতে টালবাহানা করে। সারা দেশে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকে। ৭ মার্চ ১৯৭১। রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ রেডিওতে শোনা ওই ভাষণই উদীপ্ত করে জমির আলীর মতো খেটে খাওয়া মানুষকে।
২৫ মার্চ ১৯৭১। ঢাকায় গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি সেনারা। সারা দেশের শহরগুলো তারা দখলে নিতে থাকে। আপনাদের ওখানে কী ঘটল?
জমির আলী বলেন:
“চৈত্র মাসের লাস্টে আর্মি আসে সুনামগঞ্জ, টেংরাটিলা আর ছাতকে। ওরা আইসাই অত্যাচার শুরু করে। ওগো সাহায্য করে শান্তি কমিটির লোকেরা। মাওলানারা অধিকাংশই শান্তি কমিটিতে কাজ করছে। ওরা চাইত পাকিস্তান থাকুক। আমাগো ওইখানে শান্তি কমিটির নেতা ছিল আসকর আলী মাস্টার, মাওলানা আবদুস সাত্তার ও রউস মৌলভী। ওরা পাঞ্জাবি আইলেই ওগো খেদমত করত। পরে তো রেজাকারে (রাজাকার) লোকজন ভর্তি হইতে থাকে। রেজাকাররা অত্যাচার করছে বেশি। আর্মি আসত মাঝে মাঝে। রেজাকাররা ওগো বাড়ি চিনাইত। যুবতী মেয়ে আর খাসি সাপ্লাই দিত। হিন্দু বাড়িতে আক্রমণ কইরা ওরা লুটতরাজ করছে বেশি।”
“আমগো ওইখানে বুধাই ছিল নামকরা রেজাকার। আর দালাল ফকির চেয়ারম্যান ছিল তার চেয়েও ভয়ংকর। সুরমা নদীর উত্তরের ঘটনা। একবার ট্রেনিংয়ের লাইগা ১৩ জন ছাত্র বর্ডার পার হইতেছে। এ খবর ফকির চেয়ারম্যান পাঞ্জাবিগো দিয়া আসে। ওরা আইসা তহন সবাইরে গুলি কইরা মারে।”
আপনারা তখন কী করলেন?
“আমার তহন আপনার মতো বডি। বয়স তেইশ-চব্বিশ। রেজাকারগো অত্যাচার সহ্য হইতেছে না। কী করমু, কই যামু? হঠাৎ আমার এক বড় বাপ বাড়িত আইল। ওনার নাম ওয়ারেশ আলী পীর সাহেব। উনি উৎসাহ দিয়া কইলেন, ‘যা দেশ স্বাধীন কর গিয়া…বইয়া থাকিস না…অবশ্যই দেশ একদিন স্বাধীন হইব।’ চাচা শওকত আলী তহন ক্লাস নাইনে। ও আর আমি গোপনে দেহা করি পীর সাহেবের লগে। উনি মুক্তিবাহিনীতে যাওয়ার রাস্তা দেহাইয়া আমগো দোয়া কইরা দেন।”
ট্রেনিং নিলেন কোথায়?
“আষাঢ় মাসের প্রথম সপ্তাহ। গ্রামের উত্তরে সুরমা নদী পার হইয়া হরিণাবাটি ও বেটিরগাঁও হয়ে চইলা যাই ভারতের বাঁশতলায়। ক্যাম্পে গিয়া প্রথম নাম লেখাই। ওইখানেই দেখা পাই এমএনএ হক সাহেবের। তিন দিন থাকার পর ট্রেনিংয়ের জন্য আমগো পাঠানো হয় মেঘালয়ে, ইকো ওয়ান ক্যাম্পে। এগারো নম্বর ব্যাচে ট্রেনিং করি আটাশ দিন। এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নম্বর ছিল ৪৫।”
মুক্তিযোদ্ধা জমির আলীরা ছিলেন গেরিলা। ব্রিজ উড়িয়ে দিতেন ডিনামাইট বসিয়ে। গ্রেনেড ছুড়েই দ্রুত সরে পড়তেন। শক্রর মনে ভীতি তৈরি করাই ছিল কাজ। একটি অপারেশনের কথা জানালেন জামির আলী।
তার ভাষায়, “এক পাকিস্তানি দালালরে ধইরা আনতে হইব। নির্দেশ পাইয়া আমরা বাঁশতলা থিকা গ্রুপ নিয়া রাতে চর বারকুয়া গ্রামে যাই। ওইটা ছিল ছাতকে। গ্রামের চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুল হক ছিল পাকিস্তানিগো বড় দালাল। মৌলভী কইলেই সবাই চিনে। ওর বাড়ির চাইর পাশে রেজাকাররা পাহাড়া দিত। রাতে ওগো ফায়ার করতেই সবাই পালাইয়া যায়। মৌলভীরে ধরতেই ফজরের আযান পইড়া যায়। তহন তাড়াতাড়ি ওই গ্রাম ছাইড়া শ্রীপুর গ্রামে আসি। ছোট্ট গ্রাম। চারপাশে হাওর। ওই গ্রামের আশোক আলী ছিল মুক্তিযোদ্ধাগো পক্ষের লোক। তার বাড়িত আমাগো আশ্রয় দেন তিনি। খাসি জবাই করে খাওয়ারও ব্যবস্থা করেন। গোটা দিনটাই আমরা ওইখানে রইছি।
কৈতকে ছিল পাকিস্তানিগো একটা ক্যাম্প। শ্রীপুর গ্রামের মসজিদের ইমাম ছিল কুমিল্লার এক মওলানা। সে গিয়া ওই ক্যাম্পে পাক আর্মিগো খবর দিয়া আসে। কিন্তু ওরা আসার আগেই আমরা বর্ডারে চইলা যাই। আমগো না পাইয়া পাঞ্জাবিরা ওই দিন গোটা গ্রামটাই জ্বালায়া দিছিল। রেজাকাররা না থাকলে পাকিস্তানিরা এত গণহত্যা চালাইতে পারত না। ক্যাম্প থাইকা ভেতরে ঢুইকা এভাবেই আমরা অপারেশন কইরা ফিরা আইতাম। এহনও মনে আছে মোহাম্মদপুরের ফাইট, আলগোরা, কবিরখালি, বালুরগাঁ, বালিউড়া ও টেবলাইয়ের যুদ্ধের কথা।”
এক অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের আর্টিলারির স্প্লিন্টারে রক্তাক্ত হন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয় তার নাকে। বিস্ফোরণের শব্দে তার ডান কানের পর্দাও ফেটে যায়। ফলে ওই কানে শুনতে পান না তিনি। আয়নার সামনে দাঁড়ালে নাকের ক্ষতটি আজও তাকে মনে করিয়ে দেয় একাত্তরের ইতিহাস।
কী ঘটেছিল রক্তাক্ত ওই দিনটিতে?
তিনি বলেন, ‘আমরা তখন সম্মুখ-সমরে। পাকিস্তানিরা কিছুটা ব্যাক করছে। আমরাও আগাই। ৩৫ জনের দল আমাদের। ফতেবুল কমান্ড করছে। উত্তর ও দক্ষিণে অন্য দলগুলোও আছে। বুরকি নামক স্থানটি ছিল ছাতকে। ওরা সেখান থেকে পিছু হটছে। চলে যাবে সিলেটের দিকে। আমরা তখন সামনে এগিয়ে বুরকিতেই পজিশন নিই। একটা খালের পাড়ে ডিফেন্স গড়ি। পাকিস্তানি সেনারা এক কিলোমিটার দূরে, গোবিন্দগঞ্জে। মধ্যে বিস্তীর্ণ ধানখেত।১০ নভেম্বর ১৯৭১। সকাল তখন ১০টার মতো। হঠাৎ ওরা বম্বিং শুরু করে। তুমুল গোলাগুলি চলছে। আমার পজিশন একটা বাঁশঝাড়ের নিচে, শোয়া অবস্থায়। দৃষ্টি সামনের দিকে। পাশেই মুক্তিযোদ্ধা শওকত আলী। প্রচণ্ড শব্দে টিকতে পারছিলাম না। সে সময় একটা আর্টিলারি এসে পড়ে ডান পাশে, খুব কাছেই। ধুম করে একটা শব্দ হতেই ডান কানটা বন্ধ হয়ে যায়। দেখলাম গোটা বাঁশঝাড়টা জ্বলে যাচ্ছে। হঠাৎ আমার নাক দিয়ে পিনপিন করে রক্ত পড়তে থাকে। হাত দিয়ে স্পর্শ করতে দেখলাম ডান কানটাও রক্তে ভেজা। তখনো বুঝিনি কী হয়েছে।
আমাদের কাছে গামছা থাকত। শওকত আলীর পরামর্শে গামছায় বেঁধে দিই নাকটা। পরে আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কৈতক ক্যাম্পে। সেখানেই চিকিৎসা চলে। আর্টিলারির একটি স্প্লিন্টার নাক কেটে বেরিয়ে গিয়েছিল। চিকিৎসা শেষে তিন দিন পর আবার চলে আসি রণক্ষেত্রে, বুরকি ক্যাম্পে।”
দেশ যখন স্বাধীন হয় জমির আলী তখন ছাতক ক্যাম্পে। অস্ত্র জমা দিয়ে ফিরে গেলেন পরিবারের কাছে। অতঃপর একবার মুক্তিযোদের নিয়ে মিটিং হলো ঢাকাতে। বঙ্গবন্ধু সকল মুক্তিযোদ্ধাদের বললেন, ‘তোরা যার যার কাজে ফিরে যা।’ বঙ্গবন্ধু বড় নেতা ছিলেন। তাঁর কথা ফেলে দেওয়ার সাধ্যি কার? তবে এ সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না। তাদেরও দেশের কাজে লাগানো উচিত ছিল বলে মত দেন মুক্তিযোদ্ধা জমির আলী।
যে দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সে দেশ কি পেয়েছেন?
মুক্তিযোদ্ধা জমির আলীর সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘জয় তো পেয়েছি। কিন্তু যাঁর জন্য, যাঁর কারণে যুদ্ধে গেলাম তাঁরে সপরিবারে মাইরা ফেলল। ছোট রাসেলকেও ওরা হত্যা করছে। এত বড় হত্যার পর তার হত্যার বিচারও চাওয়া যাইব না বইলা ওরা আইন বানাইল। চার নেতাকেও মারাল। তহন মনে হইছে এ কোন স্বাধীনতা পাইলাম আমরা! দেশ কি স্বাধীন। স্বাধীনের পর পৃথিবীর কোনো দেশে কি এমন হইছে? যে স্বাধীনতা একাত্তরে পাইছিলাম সে স্বাধীনতা পঁচাত্তরে হারাইছি, পনেরো আগস্টে।’
স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালো লাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা। উত্তরে মুক্তিযোদ্ধা জমির আলী বলেন, ‘বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসের সময়টাতে অন্য রকম লাগে। গ্রামের মানুষ যহন দুবেলা খাইতে পারে তহন মন ভইরা যায়। আমার দেশের ছেলেমেয়েরা যহন সারা পৃথিবীতে সফল হয় তহন স্বাধীনতাডা গর্বের হয়।’
দেশে নানা সমস্যা থাকলের পরবর্তী প্রজন্ম দেশের প্রতি আন্তরিক, এমনটাই বিশ্বাস যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা জমির আলীর। পাহাড়সম আশা নিয়ে তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটা জানতে হবে। দেশকেও জানাতে হবে। শিক্ষা হইল মেরুদণ্ড। মনে রাখতে হইব, পণ্ডিত দেশে মূর্খ থাকলে সে-ও শিক্ষিত। আর মূর্খের দেশে পণ্ডিত থাকলে তাকেও মূর্খ ভাবা হয়। তাই শিক্ষার আলোয় দেশটাকে আলোকিত করতে হবে।’
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ গবেষক