• ঢাকা
  • বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

‘হেলমেট বাহিনী’ কেন আসে, কীভাবে আসে?


কবির য়াহমদ
প্রকাশিত: এপ্রিল ২৬, ২০২২, ০২:৫৪ পিএম
‘হেলমেট বাহিনী’ কেন আসে, কীভাবে আসে?

রাজধানীর নিউমার্কেট-কাণ্ডে দুইজন মারা গেছেন। মারা যাওয়াদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত একাধিক ভিডিও ফুটেজে মার খেয়ে পড়ে যাওয়াদের ওপর চাপাতি অথবা লাঠি দিয়ে আঘাতের দৃশ্যও ধরা পড়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত এই মারামারির ঘটনায় আহত হয়ে পড়ে থাকা কারও ওপর এমন নির্যাতনকে পরিকল্পিত হত্যা বলছি আমরা। এ ঘটনার দায় গিয়ে পড়েছে মারামারিতে অংশ নেওয়া হেলমেটধারীদের ওপর। পুলিশ কয়েকজনকে শনাক্ত করেছে বলেও জানা যাচ্ছে। অপরাধীদের ধরতে পুলিশি তৎপরতার খবরও জানা যাচ্ছে।

যে দুজন মারা গেছেন, তাদের একজন নাহিদ হাসান, অন্যজন মোরসালিন। নাহিদ একটি কম্পিউটার বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের ডেলিভারিবয়, মোরসালিন নিউমার্কেটের একটি দোকানের কর্মচারী। তারাসহ আরও অনেকেই এই সংঘর্ষে জড়িয়েছে। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে যেমন আছে শিক্ষার্থী, তেমনি আছে মার্কেটের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী। পুলিশ যাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে তারা ওই মার্কেটের ব্যবসায়ী কিংবা দোকানমালিক। ব্যবসায়ী পরিচয়ের বাইরে তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ও আছে। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, তারা বিএনপির নেতা-কর্মী। বিএনপির অভিযোগ থানায় তালিকা থাকা নেতাদের নামে মামলা দিয়েছে পুলিশ। এদিকে পুলিশসহ একাধিক মন্ত্রী এ ঘটনায় ‘তৃতীয় পক্ষের’ যোগ খুঁজছেন। বরাবরের মতো এখানেও মূর্ত ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’! আজব এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এমনই যে এক যুগের বেশি সময় ধরে দেশ শাসন করা আওয়ামী লীগ এখনো এই পুরোনো বুলি কপচানোয় মত্ত। এটাই বুঝি ব্যর্থতা ঢাকার অব্যর্থ মহৌষধ!

মামলা কিংবা ঘটনার মোড় নিউমার্কেটের বিএনপি দলীয় ব্যবসায়ী থেকে এখন কিছু ছাত্রের দিকে যাচ্ছে। কারণটা সংগত। মারা যাওয়াদের দুজনই ব্যবসায়ীপক্ষের লোক। এখানে আবার ‘হেলমেট বাহিনীর’ সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে। এই হেলমেটধারীদের কারও কারও যে রাজনৈতিক পরিচয় বের হচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে তারা ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত। যদিও জানা যাচ্ছে, ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই? কিন্তু দলীয় রাজনীতির জন্য কি কমিটি থাকাটা অবশ্যম্ভাবী? কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ ও ঘটনার দায়দায়িত্বের জন্য কমিটি জরুরি ঠিক, কিন্তু অনুশীলিত রাজনীতি বলছে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য এটা সব ক্ষেত্রে জরুরিও নয়। এমনটাই তো দেখে অন্তত আসছি আমরা। এই হিসেবে হেলমেটধারীদের বিষয়ে কি দায় এড়াতে পারে সংগঠন? যদিও আগের নানা ঘটনাসহ সাম্প্রতিক ঘটনায় হেলমেটধারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্টতা স্বীকার করা হয় না, হচ্ছে না; হবেও না নিশ্চিত।

মামলার আসামিদের বেশির ভাগ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, আবার হেলমেটধারী দুর্বৃত্তদের যে কজন চিহ্নিত হয়েছেন, তারা সাংগঠনিক পদে না থাকলেও ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত—বিষয়গুলো সামনে এনে অনেকের আলোচনায় রাজনীতিটাই মুখ্য এখন। কিছু গণমাধ্যমেও এমনটা আসছে। তবে এটাকে ঠিক রাজনীতির মধ্যে না এনে পৃথক ঘটনা হিসেবেও দেখা দরকার। মারামারির যে ঘটনা, সেগুলো কেবল কোনো সংগঠনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না, এখানে পরিকল্পনা থাকতে পারে, প্রায়োগিক দিকও থাকতে পারে। তুচ্ছ ঘটনা থেকে ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থী এই দুই দলে বিভক্তির বিষয়ও এখানে ছিল। শেষ পর্যন্ত এখন সব আলোচনা দুই মৃত্যুতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে সত্য, কিন্তু এর পেছনের নানা দিককেও অস্বীকার করা যাবে না। হতাহতের বিষয়টি ঘটনার পরিণতি, তবে এর সঙ্গে মারামারিতে অংশ নেওয়া লোকের সংখ্যা ও উদ্দেশ্যকেও পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কেবল প্রাণহানির বিচারেই আমাদের দাবি সীমিত থাকলেও বিরোধের মূলোৎপাটন কখনোই সম্ভব হবে না।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে আমরা দেখেছি ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে হেলমেটধারীদের উপস্থিতি। তৎক্ষণাৎ পুলিশি ব্যবস্থাও ছিল দুর্বল। অভিযোগ রয়েছে ছোট্ট এক ঘটনা থেকে এর বিস্তৃতির পেছনেও রয়েছে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা। ঘটনা শুরুর আড়াই ঘণ্টা পর পুলিশ সক্রিয় হয়েছে এমন অভিযোগও এসেছে, আছে পক্ষপাতের অভিযোগও। পুলিশ প্রশাসন রাষ্ট্র ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে তাদের ব্যর্থতাগুলো আমলে নেওয়া হয় না। আগের অনেক ঘটনার মতো এখানেও এর ব্যতিক্রম ঘটছে না। ফলে প্রতিকারহীন নিষ্ক্রিয়তা কিংবা পক্ষপাতের অভিযোগ। অথচ এটা আমলে নেওয়া উচিত ছিল, এখনো উচিত। কারণ, শক্তিশালী ও কার্যকর প্রশাসন পারে এবং পারবে যেকোনো ঘটনার তাৎক্ষণিক সমাধান দিতে অথবা ছোট্ট ঘটনাকে বড় করার লাগাম টেনে ধরতে। এখানে প্রশাসনের আত্মসমালোচনার দরকার, শুদ্ধির পথ খোঁজা দরকার।

যে দুই যুবক মারা গেছেন দিন শেষে তাদের পরিবারই ভুগবে অনিঃশেষ শূন্যতায়। বিচার যদি হয়ও তবু তারা ফিরবে না, পরিবারের শূন্যতা স্বাভাবিকভাবেই পূরণ হবে না। নিজ নিজ পরিবারের এই ক্ষতির পাশাপাশি এটা রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার চিত্রও। এই অব্যবস্থাপনা, ব্যর্থতা থেকে উত্তরণের সুযোগ আছে রাষ্ট্রের। তার আগে অবশ্য দরকার ব্যর্থতা অস্বীকারের চেনা বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসা!

যেকোনো ঘটনায় কেন বারবার সামনে আসে ‘হেলমেট বাহিনী’? তারা কারা? কেন আসে, কীভাবে আসে? প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হবে। দোকানের মালিক-দোকানি কোন দল করেন, ছাত্ররা কোন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, আগে নিউমার্কেট প্রতিদিন রণক্ষেত্র থাকত কি না, এটা সরকারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র কি না, এখানেও তৃতীয় পক্ষের হাত—এই ধরনের প্রশ্ন ও মুখস্থ বুলি আওড়ানো বন্ধ করতে হবে। এমন অজুহাত আমরা আগেও শুনেছি, এখনো শুনছি; কিন্তু কোনো সমাধান কি হয়েছে? হয়নি। বরং অভিযোগ-অজুহাতে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টাই হয়েছে। আমরা চাই এই ধরনের প্রবণতা বন্ধ হোক। এখানে কে বিএনপি, কে ছাত্রলীগ, হেলমেটধারীদের সঙ্গে কার কী সম্পর্ক—এগুলো না দেখে সমস্যার স্থায়ী সমাধান খোঁজা উচিত। সৎ তদন্ত শেষে বিচারের আওতায় আনা দরকার। ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী’ হিসেবে পুলিশকে না দেখে তাদেরকে ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও ব্যবস্থাপনা বাহিনী’ হিসেবে কাজে লাগাতে হবে। নিউমার্কেটের ঘটনার তদন্তে যদি পুলিশের ব্যর্থতা বেরিয়ে আসে তবে এ থেকে উত্তরণের কী উপায়, এগুলো নিয়ে ভাবতে হবে, উদ্যোগ নিতে হবে।

নিউমার্কেট এলাকায় প্রাণের অপচয়সহ যে ক্ষতি হয়েছে, সেগুলো পূরণ হবে না যদিও, তবু এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যৎকে নিরাপদ করতে প্রশাসনিক উদ্যোগ নেওয়া দরকার। এখানে ক্ষণিকের রাজনৈতিক স্বস্তি-অস্বস্তি মুখ্য নয়, ভাবতে হবে ভবিষ্যৎ নিয়ে যাতে এখানে কিংবা অন্য কোনোখানে এই ধরনের কোনো ঘটনা আর না ঘটে। ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য বর্তমান হোক শুদ্ধির প্রপঞ্চ।

 

লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

Link copied!