পরিসংখ্যান নাকি আবেগ! পরিসংখ্যান রুক্ষ ক্যাটকেটে। আর আবেগের মাঝে একটা উষ্ণ হৃদয়ের ডাক আছে। সেঞ্চুরিয়নের সুপার স্পোর্ট পার্ক সেই হৃদয়ের ডাকটাই শুনল। সেঞ্চুরিয়ন পার্কে দিন-রাতের দুটো ম্যাচই বাংলাদেশ জিতল। নতুন ইতিহাস গড়ল। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে প্রথম ওয়ানডে সিরিজ জিতল। যেখানে কোনো ফরম্যাটেই কোনো ম্যাচ জয়ের নজির ছিল না বাংলাদেশের।
এবং এমনভাবে জিতল, যেখানে সমবেতভাবে বাংলাদেশ দলটা থেকে জৌলুস ঠিকরে বের হলো। দক্ষিণ আফ্রিকা দলটা পাত্তাই পেল না সফরকারীদের কাছে! শেষ ম্যাচে বাংলাদেশের কাছে মাত্র ১৫৪ রানে অলআউট হলো, যা বাংলাদেশের বিপক্ষে তাদের সবচেয়ে কম রানের স্কোর। তাসকিন আহমেদের বোলিংয়ের সামনে রীতিমতো কাঁপুনি ধরে দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটিং লাইনে। আর প্রোটিয়াদের এই কাঁপাকাঁপি দেখে দারুণ গর্বিত মনে হলো আরেক প্রোটিয়াকে। অ্যালেন ডোনাল্ড। সাউথ আফ্রিকার সাবেক পেসার। বাংলাদেশ দলের পেস বোলিং কোচ। তার ছোঁয়ায় কীভাবে বদলে গেল তাসকিনের বোলিংটাও। শেষ ম্যাচে ৩৫ রানে ৫ উইকেট নিলেন তাসকিন। ক্রিকেট ক্যারিয়ারের অন্যতম স্মারক হিসেবে ‘সাদা বল’টাকে বার কয়েক টেলিভিশন পর্দায় দেখা গেল তাসকিনের হাতে। সত্যিই চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া বোলিং তাসকিনের। শুধু একটা ম্যাচে নয়। গোটা সিরিজজুড়ে। তাই একে একে ম্যান অব দ্য সিরিজ, ম্যান অব দ্য ম্যাচ দুটো ট্রফিই তার হাতে উঠল। ক্রিকেটজীবনের স্মৃতিবিজড়িত এমন দুটো ট্রফির সংরক্ষণ একটু আলাদাভাবেই হয়তো হবে তার ট্রফি ক্যাবিনেটে।
সিরিজ নির্ধারণী তৃতীয় ম্যাচটা ধুন্ধুমার হবে। এমনটা যারা আশা করেছিলেন, তারা খানিকটা হতাশ। এবং হতাশ সেই মানুষগুলোর কাছে অত্যাশ্চর্য মনে হতে পারে, যে দলটা ভারতকে কিছুদিন আগে হোয়াইটওয়াশ করল; তাদের এত অসহায় মনে হলো কেন নিজেদের মাটিতে! ক্রিকেট বিশ্লেষকদের কাছে ব্যাখ্যা যা-ই হোক; এই সিরিজে টিম হিসেবে বাংলাদেশের দারুণ একটা রূপান্তর ঘটেছে। প্রত্যেকেই নিজেকে উজাড় করে দিয়ে ক্রিকেট খেলেছেন। পেশাদারত্বে নাকি আবেগের কোনো জায়গা নেই। কিন্তু এই বাংলাদেশ দলে দেখা গেল, পেশাদারত্ব আর আবেগ মিলেমিশে একাকার! দেশে হাসপাতালে মা-শাশুড়ি-কন্যা-পুত্র রেখে বাইশ গজে দেশের হয়ে লড়াইয়ে নামলেন সাকিব! রূপকথা মনে হতে পারে। কিন্তু রূপকথা নয়। এটাই বাস্তবতা। শেষ ম্যাচে উইনিং স্ট্রোকটাও এলো সেই সাকিবের ব্যাট থেকে। অন্যদিকে তামিম ইকবাল ব্যাট হাতে যা করলেন, তাতে দক্ষিণ আফ্রিকার বোলারদের গলির বোলারদের স্তরে নামিয়ে এনেছিলেন। ৮৬ রানের অসাধারণ এক ইনিংস খেললেন। পুরো সিরিজে সবচেয়ে বেশি রানও তার নামের পাশে। আর তার ওপেনিং পার্টনার লিটন দাস। দিনে দিনে অনেক পরিণত ব্যাটার। তিনিও হয়তো হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছেন দল তার ব্যাট থেকে রান চায়। তিনি সেই রানটাই করে দিয়ে যাচ্ছেন। এবং ধারাবাহিকভাবে।
দক্ষিণ আফ্রিকার ১৫৪ রান তাড়া করে তামিম-লিটন যেভাবে ব্যাট করলেন, তাতে শিল্পের ছোঁয়া ছিল। ক্রিকেটীয় রোমাঞ্চ ছিল। তাদের ব্যাট থেকে বেরিয়ে আসা প্রতিটি স্ট্রোকে ছিল একধরনের মুগ্ধতা, যা আপনি-আমি টেলিভিশনে দেখেছি। আর সেটা দেখে ‘বাংলাদেশ’ ‘বাংলাদেশ’ ধ্বনিটা জোরালো হচ্ছিল সুপারস্পোর্ট পার্কের ক্যাসল ও হিলে।
হ্যাঁ, সুপার স্পোর্ট পার্ক অন্য আর দশটা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের মতো কাটখোট্টা, রসকষহীন নয়। জোহানেসবার্গ আর প্রিটোরিয়া শহরের মাঝামাঝি জায়গায় এই ক্রিকেট মাঠে দর্শকদের খেলা দেখার আলাদা একটা মজা আছে। চমৎকার আধুনিক গ্যালারি, সবুজ ঘাস। দুদিকে খেলা দেখার উঁচু জায়গা ঢালু হয়ে নেমেছে। আর এটাই হলো ক্যাসল ও হিল। সেই হিলটা জুড়ে ছিলেন প্রচুর আফ্রিকাপ্রবাসী বাঙালি। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে তাদের বিপক্ষে সিরিজ জয় ওই সব প্রবাসীকেও আলাদা একটা আইডেন্টিটি দিয়ে দিল। তারা বাংলাদেশি। সুপার স্পোর্ট পার্ক তাদের হৃদয়ের ডাকটাও মনে হয় সেদিন ভালোভাবেই শুনতে পেয়েছে। সে কারণে সেঞ্চুরিয়নের চারদিকে বুধবার সন্ধে নামতেই ‘বাংলাদেশ’ ‘বাংলাদেশ’ শব্দটা ধ্বনিত হয়েছে।
লেখক : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।