সুবচন মানে সুন্দর কথা বা মধুর বচন। হাজার কড়া-কঠিন কিংবা তিক্ত কথায় যে কাজ হয় না, একটি মাত্র মিষ্টি কথায় তা-ও সহজে হয়ে যায়। সুবচন এমন একটি পন্থা, যা পাহাড়সম কাজকে অবলীলায় সহজ করে দিতে পারে। পরিবার, সমাজ, রাজনৈতিক ময়দান, কর্মক্ষেত্র, ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে, শিক্ষাক্ষেত্রে, মোটিভেশন প্রভৃতি ক্ষেত্রে কোথায় সুবচনের গুরুত্ব নেই? বরং পৃথিবীর কঠিনতম কাজটিও সহজে সম্পন্ন করার অন্যতম মাধ্যম হতে পারে সুবচন। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ, শিক্ষাঙ্গন থেকে শুরু করে কর্মস্থল, এমনকি রাজনৈতিক অঙ্গনেও সুবচন বয়ে আনতে পারে সুদূরপ্রসারী ফল।
যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠান কিংবা ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও ব্যক্তির সুবচন তাকে অন্য সাধারণ মানুষ থেকে স্বতন্ত্র ও আকর্ষণীয় করে তোলে। তাই পারিবারিক জীবনের পাশাপাশি সামাজিক আচরণেও সুবচনের বিকল্প নেই। খুব স্বচ্ছভাবেই বোঝা যায়, একটি অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে একশ জনের জমায়েতে যিনি অপেক্ষাকৃত কোমল স্বরে কথা বলেন, সুবচন যার অস্ত্র হয়ে ওঠে, তাকেই সবাই সমীহ করে।
সুবচনের নজরকাড়া উপকারিতা লক্ষণীয় রাজনৈতিক ময়দানে। রাজনৈতিক নেতার সুবচনই তাকে অন্য নেতাদের থেকে পৃথক করে তোলে। যে ব্যক্তি যত মৃদুভাষণে পারঙ্গম, তিনি ততটাই গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেন। রাজনৈতিক নেতাদের মৃদুভাষণে জনগণ দ্রুত আকৃষ্ট হয়। যিনি যত মৃদুভাষণে দক্ষ, তিনি নেতা হিসেবেও তত জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেন।
ব্যবসায় ক্ষেত্রে সুবচনের গুরুত্ব সর্বাধিক বললেও অত্যুক্তি হবে না। ব্যবসায়ীরা যদি ক্রেতার সঙ্গে মিষ্টি ভাষায় কথা বলেন, তাতে তাদের প্রতি আগ্রহ বাড়ে। একই সঙ্গে তৈরি হয় আস্থার জায়গাও। ক্রেতার সেই আস্থায় সহজেই ভাঙন ধরে না, কেবল সুবচনের জোরেই।
শিক্ষাক্ষেত্রে সুবচনের জয়-জয়কার। ছাত্রের সঙ্গে শিক্ষকের এবং শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আত্মিক সংযোগ ঘটে সুবচনের মাধ্যমে। যার ফল সুদূরপ্রসারী। শিক্ষার মানোন্নয়ন থেকে শুরু করে যেকোনো বিষয় সম্পর্কে জানতে বা বুঝতে অবলীলায় শিক্ষকের সাহায্য নিতে পারে ছাত্র-ছাত্রীরা। সুবচনকে পুঁজি করে শিক্ষকরাও তাদের হাতে গড়ে তোলা সন্তানদের ওপর ভরসা করতে পারেন। তাদের সুপথ দেখিয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারেন। পরিবার, সমাজ, শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র, রাজনীতির ময়দানে সর্বত্রই সুবচনের ফল সুদূরপ্রসারী। সুবচনের ফল যে কত মধুর তা বোঝা যায় মোটিভেশান স্পিচের ক্ষেত্রে। একজন মানুষের পুরো জীবনকে নাড়া দিতে পারে এ ধরনের সুবচন। মৃত্যুমুখী মানুষও জীবনের নতুন মোড় খুঁজে পেতে পারে। জীবনকে দেখার এবং বোঝার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গিয়ে নতুন দিক উন্মোচন করতে পারে। সুবচন তাই মানুষের জীবনকে ঝুঁকিমুক্ত করতেও অধিক কার্যকরী। সুবচনের চর্চা মানুষের পৃথিবীকে সুন্দর ও কল্যাণে ভরিয়ে দিতে পারে।
সুবচনের বিপরীতে আছে রূঢ় আচরণ। সুবচনের ফলে যেমন মনের গভীরে ঢুকে একজন অন্যের প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হয়, ভালোবাসায় সিক্ত হয়, তেমনি রূঢ় আচরণে হয় বিরক্ত-বীতশ্রদ্ধ। এমনকি রূঢ় আচরণকারী যতই সুদর্শন হোক, তাকে দেখলে সবাই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। পরিবার, সমাজ, কর্মক্ষেত্রে সর্বত্রই তাকে ঘৃণা করে, ভয় করে চলে। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সেলসম্যান বা কর্ণধারের ব্যবহার যদি খারাপ হয়, তাহলে ক্রেতারা দ্বিতীয়বার ওই পথে হাঁটবেন না। তেমনি রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, সমাজপতি, পেশাজীবীদের আচরণও যদি রূঢ় হয়, তাহলে সেবাপ্রার্থীরা তাদের পথ ভুলেও মাড়াবেন না।
সুবচনেই যদি কার্যসিদ্ধি হয়, তাহলে রূঢ় আচরণ কেন করবেন? সুবচনের ফলে শাসনকেও মধুর লাগে। ধমককেও উন্নতির সোপান মনে হয়। সুবচন সর্বদাই অমৃত বর্ষণ করে! তবে, সবকিছুরই পরিমিতি বোধ থাকা চাই। সুবচন ততক্ষণই উপকারী, যতক্ষণ তা নির্দিষ্ট সীমায় ও কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। চাণক্য বলেছেন, ‘প্রয়োজনের অতিরিক্ত সবকিছুই বিষ। সে ভালোবাসাই হোক বা ধনসম্পদ।’ তেমনি সুবচন ততক্ষণই মানবের কল্যাণে কাজে আসবে, যতক্ষণ অতিরঞ্জিত হবে না!
এত কিছুর পরও বলব, সুবচনের ফলে পাহাড়সম কঠিন কাজও সহজে করে ফেলা সম্ভব। তাই, আসুন, নিজের প্রতিপত্তি-ক্ষমতা দেখানোর জন্য রূঢ় আচরণ নয়, মানুষকে সম্মান দিতে, নিজের কার্যসিদ্ধি করতে সুবচনের চর্চা করুন। তবেই মানবমঙ্গল, তাতেই সমাজের উন্নতি।
লেখক : গবেষক ও শিক্ষক, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়