• ঢাকা
  • সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

সাকিবদের দুঃখ-যন্ত্রণাকে বলি দিতে হয়


অঘোর মন্ডল
প্রকাশিত: মার্চ ২২, ২০২২, ০২:১১ পিএম
সাকিবদের দুঃখ-যন্ত্রণাকে বলি দিতে হয়

সাকিব আল হাসানকে নিয়ে লিখতে গিয়ে বারবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে অন্য একটা নাম। সি এল আর জেমস। বিখ্যাত ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান লেখক। ক্রিকেট নিয়ে যিনি বহুমাত্রিক একটা লাইন লিখে রেখেছেন: “তারা ক্রিকেটের কী বোঝে, যারা শুধুই ক্রিকেট বোঝে?” জেমসের বাক্যকে ভুল প্রমাণ করতে সবচেয়ে বেশি মরিয়া আমরা। আমাদের কাছে ক্রিকেট মানে আবেগ। ক্রিকেট মানে সাফল্য। আমরা ক্রিকেট দেখি শুধু নিজেদের দলের জয় দেখার জন্য। আমরা ক্রিকেটারদের লড়াইকে দেখি না। মাঠে এবং মাঠের বাইরে তাদের লড়াই আমাদের খুশি করে না। উদ্দীপ্ত করে না!

দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় ওয়ানডে শুরুর আগে যে লড়াই শুরু হয়েছে সাকিবের, সেটা দৃশ্যমান নয়। মা হাসপাতালে। শাশুড়ি আরেক হাসপাতালে ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করছেন। ছেলে এবং এক মেয়ে অন্য আরেক হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে! এসব পেছনে রেখে সাকিব আল হাসান মাঠে নামবেন দেশের জার্সি গায়ে জড়িয়ে। সাফল্য-ব্যর্থতার কথা ভুলে যান। শুধু আবেগজড়িত দৃশ্যকল্পটা চিন্তা করুন। তিনি সফল না হলে আমরা বলতে শুরু করব, ওর খেলা ঠিক হয়নি। মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। আবার সফল হলে আবেগ আপ্লুত হব। কিন্তু ভুলেও কেউ বলব না ‘আমরা আপনার কাছে কৃতজ্ঞ!’

বোর্ডকর্তা ও ক্রিকেট প্রেসের কথা ভুলে যান, তারা তাদের মতো করেই বলবেন আর লিখবেন। তাদের অনেক দায়িত্ব। কারও প্রচার পেতে হবে। কারও টিআরপি বাড়াতে হবে। কারও লাইক বাড়াতে হবে! কিন্তু এই দেশে তো অনেক নামীদামি লেখক, সমাজবিজ্ঞানী আছেন। তারা কি কখনো সাকিব নামের কোনো ক্রিকেটারের মনটাকে পড়ার চেষ্টা করেছেন। খুঁজেছেন কি তার সাফল্যের চাবিকাঠি?

মন না শৃঙ্খলা? মন যদি হয়, তাহলে এ রকম পারিবারিক বিপন্নতা নিয়ে মাঠে নামার সাহস কজন দেখাতে পারবেন! গত দুই যুগে পারিবারিক বিপন্নতা আর বিষণ্ণতাকে সাফল্য দিয়ে আড়াল করে দেওয়ার বড় উদাহরণ একটাই। শচীন টেন্ডুলকার। ’৯৯-এর বিশ্বকাপ চলার সময় পিতৃহারা হয়েছিলেন তিনি। বাবাকে শ্মশানে পুড়িয়ে আবার ফিরে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে। সদ্য স্বামীহারা শচীনের মা তাকে বলেছিলেন: ‘ফিরে এলে কেন? বিশ্বকাপে যাও। তোমার বাবার তো সেটাই ভালো লাগবে, তুমি দুঃখে ভেঙে না পড়ে দেশের হয়ে খেলছ!’ অসামান্য জীবনদর্শন গোটা পরিবারের। শচীনের বাবাকে হারানোর সঙ্গে সাকিবের হাসপাতালে থাকা মা, শাশুড়ি, ছেলেমেয়ের অসুস্থতাকে তুলনা করা ঠিক হবে না। নিকটতম প্রিয়জনের অসুস্থতা, শোক, দুঃখ একেকজনের কাছে একেক রকম। কারও সঙ্গে কারওটা তুলনা চলে না। তবে আমাদের মনে রাখা উচিত, আমরা যাদের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে এত কথা বলি বা লিখি, তারাও রক্ত-মাংসের মানুষ। তাদেরও জীবন আছে। সুখ আছে। দুঃখ আছে। আনন্দ-বেদনা তাদেরও ছুঁয়ে যায়।

সাকিব মনের জোর নিয়ে মাঠে নামবেন। দেশের হয়ে লড়াই করতেই নামবেন। লড়াইয়ের কথা এলে হারের কথাও আসবে। জীবনের সব লড়াইয়ে কেউ জয়ী হয় না। বিভিন্ন পর্যায়ে হেরে যায়। নিজেদের সেই হারের সঙ্গে ক্রিকেট দলটার হারকে মেলাতে চাই না। হেরে যাওয়া মানুষগুলোর সঙ্গে নৈকট্য বোধ করি না! ক্রিকেট উন্মাদনার সঙ্গে অন্য কিছুকে মেলাতে চাই না।

সাকিব দেশের জন্য খেলতে চান না। বিদেশের মাটিতে রেকর্ড খারাপ হবে বলে বিভিন্ন অজুহাতে পালাতে চান। এ রকম অনেক কথাই লেখা হয়। হয়েছে। আগামীতে হবে না, সেই গ্যারান্টি দেওয়া যাচ্ছে না। তবে সাকিব আল হাসান নামের এই ক্রিকেটারকে তারকা, মহাতারকা, এমনকি জাতীয় দলের হয়ে খেলার আগে থেকে চেনার সুযোগ হয়েছিল। যখন মাঠের ক্রিকেটকে কাভার করেছি ঘাস মাড়িয়ে। যখন ক্রিকেট সার্কিটের বাইরের লোক তাকে ঠিকমতো চিনত না, তখন ‘ক্রিকেট অনলাইন’ নামে একটা বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে ওকে নিয়ে এক ঘণ্টার একটা লাইভ শো করতে হয়েছিল। কারণ, সেদিনের নির্ধারিত তারকা ক্রিকেটার যেকোনো কারণেই হোক শো শুরুর ঘন্টাখানেক আগে জানিয়েছিলেন, তিনি আসতে পারছেন না! প্রোডিউসারের মাথায় হাত। বললাম, চিন্তার কি আছে। কাউকে না কাউকে পাব। মোহামেডান ক্লাবের প্র্যাকটিস সেরে সাকিব রওনা হয়েছিলেন রিকশায়। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম থেকে তাকে চ্যানেলের গাড়িতে তুলে এনে সোজা স্টুডিওতে নিয়ে বসলাম! বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের জার্সি গায়ে পুরো শো-টা করলেন। যা বলার সোজাসাপ্টা বললেন। ১৭ বছর আগে দেশজ টেলিভিশন শিল্পেও এ রকম অবস্থা হয়নি যে অনলাইনে যেকোনো জায়গা থেকে যে কাউকে যুক্ত করে নেওয়া যাবে। কিন্তু সেদিন সাকিব আল হাসানকে টেবিলের উল্টো পাশে কখনো সামান্যতম নার্ভাসও মনে হয়নি। সেদিনই বুঝেছিলাম, এই ছেলেটি মানসিকভাবে কতটা শক্তিশালী। বাকিটা ইতিহাসে। ক্রিকেট বিশ্ব দেখছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেই সাকিব ভয়ে বিদেশের মাটিতে খেলতে চান না! এই কথাটা যারা বলেন এবং লেখেন, তাদের বোধ হয় সাকিবের বিদেশের মাটিতে গত ২৬টা ম্যাচের পরিসংখ্যান একটু উল্টে দেখা উচিত। ২৬ ম্যাচে তার রান ১৪৩৩। বল খেলেছেন ১৫৮৬। গড় রান ৬৭-এর ওপরে!

তবে হ্যাঁ, আপনি যদি নেভিল কারডাস হন, তাহলে এই ক্রিকেট স্ট্যাটাসকে চূড়ান্ত বোরিং মনে হবে। তিনি বেঁচে থাকলেও হয়তো সাকিবের দক্ষিণ আফ্রিকায় সিরিজ খেলার জন্য থেকে যাওয়ার মাঝে, অন্য রকম এক শৌর্য খুঁজতেন। স্যালুট জানাতেন তার লড়াকু মানসিকতাকে। নামের পাশে রান কত, কিংবা কটা উইকেট, সব সময় তা দিয়ে একজন ক্রিকেটারকে মাপতে না যাওয়া ভালো। কিন্তু আমরা যে এখনো শুধু ক্রিকেটই বুঝি!

 

লেখক: সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক

Link copied!