• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শাবিপ্রবিতে আন্দোলনের নৈতিক বিজয়


প্রভাষ আমিন
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৭, ২০২২, ০৭:১৬ পিএম
শাবিপ্রবিতে আন্দোলনের নৈতিক বিজয়

টানা দুই সপ্তাহ পর বুধবার আন্দোলনের একটা ‘বড় ধাপ’ অতিক্রম করেছেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এই দাবি অবশ্য আমার নয়। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একজন মেহনাজ মৌমিতা বুধবার রাতে এক টেলিভিশন টক শোতে এ দাবি করেছেন। তবে আমি তার দাবির সঙ্গে একমত। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের আহ্বানে সাড়া দিয়ে টানা ৭ দিনের আমরণ অনশন ভেঙেছেন শিক্ষার্থীরা। এই অনশন ভাঙা অবশ্যই আন্দোলনের বড় একটি ধাপ।

সাত দিন ধরে অনেকে অনেক রকম চেষ্টা করেও আমরণ অনশনে থাকা শিক্ষার্থীদের টলাতে পারেননি। জাফর ইকবাল সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস তো দিয়েছেনই। তবে তার একটি কথায় ঘুরে গিয়েছে আন্দোলনের মোড়। তিনি বলেছেন, জীবন অনেক মূল্যবান। যে দাবিতে তারা আন্দোলন করছেন, তা জীবন দেওয়ার মতো নয়। খুবই ঠিক কথা। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকলেন না গেলেন, তার চেয়ে আমরণ অনশনে থাকা শিক্ষার্থীদের জীবন অনেক মূল্যবান।

তিন বছর আগে অবসরে যাওয়া জাফর ইকবাল ঢাকা থেকে ছুটে গিয়ে যেটা পারলেন, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষকদের কেউ সেটা পারলেন না কেন? এই প্রশ্নটি আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। প্রশ্নটির জবাব দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. তুলসি কুমার দাস। নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে তিনি বলেছেন, “আমরা শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জন করতে পারিনি, যেটা পেরেছেন জাফর ইকবাল।” তিনি আরও বলেছেন, “আমাদের আরও অনেক জাফর ইকবাল দরকার।”

প্রভোস্টের পদত্যাগের আন্দোলন হঠাৎ উপাচার্যের পদত্যাগের আন্দোলনে বদলে দেওয়ার শতভাগ দায় পুলিশের। অবরুদ্ধ উপাচার্যকে উদ্ধার করতে এসে পুলিশ আসলে তাকে ডুবিয়ে দিয়ে গেছে। উদ্ধারে পুলিশ ডাকার মধ্য দিয়েই আসলে উপাচার্যের নৈতিক পতন ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আসলে উপাচার্য বা শিক্ষকদের কাছে সন্তানের মতো। সন্তানরা কোনো আবদার করলে তাদের বুঝিয়ে শান্ত করতে হয়। বাইরে থেকে পুলিশ ডেকে মার খাওয়াতে হয় না। উপাচার্য নিজে যদি পুলিশ ডেকে থাকেন, তাহলে তো নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেছেন। আর যদি তার শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে অন্য কেউ ডেকে থাকেন, সেটাও তাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এটা গভীর তদন্তের দাবি রাখে, কে বা কারা পুলিশ ডেকে এনে শিক্ষার্থীদের অনড় আন্দোলনে ঠেলে দিল। কাদের ইঙ্গিতে পুলিশ বিনা উসকানিতে শিক্ষার্থীদের ওপর বেপরোয়া হামলা চালালো, তা-ও তদন্ত করে দেখতে হবে।

অনশন ভাঙানোর পর জাফর ইকবাল সাংবাদিকদের বলেছেন, পুলিশ যখন শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়, তখন শিক্ষকদের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত ছিল। কিন্তু একজনও তা করেননি। কেন করেননি? এই প্রশ্নেরও জবাব দিয়েছেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক তুলসি কুমার দাস। তিনিও স্বীকার করেছেন, শিক্ষার্থীদের রক্ষা করা উচিত ছিল। কিন্তু সেই উচিত কাজটি তারা কেউই করতে পারেননি। কেউই জোহা হতে পারেননি। অধ্যাপক তুলসি কুমার দাস কিন্তু বিনয়ের সঙ্গেই সব স্বীকার করেছেন। আর তার স্বীকারোক্তিতেই লুকিয়ে আছে সমস্যার কারণ। তারা বিপদের দিনে শিক্ষর্থীদের পাশে দাঁড়ানোর মতো সাহসী নন। আর এ কারণেই শিক্ষার্থীরা তাদের আশ্বাসে আস্থা রাখতে পারেন না। শিক্ষক আর শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক আস্থা, মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক ফিরিয়ে আনাও এই আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত।

টানা অনশনে মরতে বসা শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙিয়ে প্রশংসা পাচ্ছেন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। আমার ধারণা ছিল, অন্তত এই কাজের জন্য সবাই তাকে সাধুবাদ জানাবে। কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে একটি পক্ষ জাফর ইকবালের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করছে। তিনি নাকি সরকারের দালাল হিসেবে এসে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে থাকা আন্দোলনের বারোটা বাজিয়েছেন। শুনে আমি অবাক হয়ে গেছি। শিক্ষার্থীরা না হয় আবেগে, ক্ষোভে, অভিমানে অনশন শুরু করেছিলেন। কিন্তু এই আন্দোলন থেকে অন্য কিছু পাওয়ার আশা করেছিল একটি পক্ষ। তাদের আশা ছিল অনশন করতে করতে কেউ একজন মারা যাবে। তারপর সে আন্দোলন ছড়িয়ে যাবে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে। পানি ঘোলা হবে, তারপর ষড়যন্ত্রকারীরা সেখানে মাছ শিকার করবে। জাফর ইকবাল সে ষড়যন্ত্রে পানি ঢেলে দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পাশে আছি, তাদের আবেগের সঙ্গে আছি; কিন্তু শিক্ষার্থীদের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে, তাদের জীবনের বিনিময়ে কারও ষড়যন্ত্র যেন সফল হতে না পারে।

আমরণ অনশন প্রত্যাহারের পর বুধবার রাতে উপাচার্যের বাসার সামনের অবরোধও প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনের অন্যান্য কর্মসূচি চলবে। আন্দোলনের মুখে উপাচার্য পদত্যাগ করবেন কি না, জানি না। তবে আমি মনে করি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের নৈতিক বিজয় হয়েছে অনেক আগেই। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে শুধু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নয়; দেশের বাকি ৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের চেয়ারও নড়বড়ে হয়ে গেছে। আলোচনায় উঠে আসছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনিয়ম। যারা ভবিষ্যতে দেশ ও জাতির নেতৃত্ব দেবেন, তারা যে পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকেন, যেভাবে সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের শারীরিক-মানসিক নিগ্রহের শিকার হন, ক্যান্টিনে যা খান; তা গোটা জাতির জন্যই লজ্জার, অপমানের।

কম দামে ‘ছা-ছমুসা-সিঙ্গারা’ খাওয়ানোর দরকার নেই। ন্যায্য দামে পুষ্টিকর খাবার, থাকার একটি মানসম্পন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আলো ফেলেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দিনের পর দিন চলতে থাকা অনেক অনিয়মের দিকে। রানা প্লাজার দুর্ঘটনা ইতিবাচকভাবে বদলে দিয়েছে আমাদের গার্মেন্টস খাতকে। তেমনি এই আন্দোলন যেন বদলে দেয় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ। উপাচার্য নিয়োগের আগে সরকার যেন দলীয় আনুগত্যের চেয়ে দক্ষতা, যোগ্যতা, সততা, চারিত্রিক দৃঢ়তার ওপর বেশি নজর দেয়। আর দুই সপ্তাহে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গোটা জাতিকে দেখিয়ে দিয়েছে, কীভাবে আন্দোলন করতে হয়, কীভাবে বিজয় ছিনিয়ে আনতে হয়। দুই সপ্তাহের আন্দোলনে পুলিশ তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছে। কিন্তু তারা একটি ঢিলও ছোড়েনি। কয়েক শ শিক্ষার্থীর দৃঢ় ও অহিংস আন্দোলন কাঁপিয়ে দিয়েছে সবাইকে। এ প্রাপ্তিও কম নয়।

 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Link copied!