• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
সীতাকুণ্ড বিস্ফোরণ

মুদ্রায় কি মোছে শোকের কান্না?


তুষার আবদুল্লাহ
প্রকাশিত: জুন ৬, ২০২২, ০৭:৪১ পিএম
মুদ্রায় কি মোছে শোকের কান্না?

ডেউয়া ফল ভীষণ প্রিয়। নীল রঙটাও প্রিয়। কিন্তু নীলকে অসহ্য মনে হচ্ছে। যেন নীলের মতো হিংস্র নেই কেউ। নীলের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা মৃত্যু ডেউয়াকে প্রিয়জনের কাছে পৌঁছতে দেয়নি । ছিল আহ্লাদ, ছিল ভালোবাসা। প্রেমের ফুল ফুটতে মাস কয়েক বাকি। তার আগে আদর, অভিমানী বায়না ছিল ডেউয়ার। প্রতিশ্রুতি ছিল একটি প্রিয়মুখ, নির্ভরতার করতলের ডেউয়া পৌঁছে দেওয়ার । কিন্তু নীল ড্রামে লুকিয়ে থাকা হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ঝলসে দিয়েছে প্রিয়জনের মুখ। করতল বিচ্ছিন্ন হয়ে উড়ে গেছে কতদূর জানা নেই। শুধু জানি এমন বিভৎস মৃত্যু , আহাজারীর শুমারী করে যাবো শুধু। এবং একদিন আমিও হয়ে যেতে পারি এমন মৃত্যুর একটি সংখ্যা ।

গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে সীতাকুন্ডের মতো মৃত্যুকুন্ডের কাছাকাছি গিয়েছি বহুবার । ভবন ধ্বসে পড়া স্পেক্ট্রাম, ফিনিক্স, শাঁখারী বাজার থেকে রানা প্লাজা। গার্মেন্টেস, বস্তি, বিপনী বিতান, অফিস আর আবাসিক ভবনের আগুনের ফর্দটা বেশ বড়। আছে লঞ্চ ডুবির হাহাকারও । নিমতলীর কেমিক্যাল কারখানা, মগবাজার , নারায়ণগঞ্জের গ্যাস বিস্ফারণের ঘটনার ক্ষত এখনও দগদগে । কিন্তু সেই ক্ষতের পীড়ন শুধু হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর স্বজনেরাই সয়ে যাচ্ছে। যারা দগ্ধ, আহত হয়ে বেঁচে আছেন, তাঁরা জানেন জীবন কতো বিভীষিকাময় । কিন্তু যে দফতর ও প্রতিষ্ঠানের অবহেলায় মৃত্যুপুরী হয়ে উঠে শহর, দেশ, তাদের যেন ঘুম ভাঙে না।

যে কোনো দুর্ঘটনার পর, কখনো দেখিনি পরের দুর্ঘটনা যেন না ঘটে সেজন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া । তাৎক্ষনিক কমিটি তৈরি, দপ্তর প্রধানদের দৌঁড়ঝাপ , টাস্কফোর্স গঠন হয়ে যায় আগুন নিভে যাওয়া বা দুর্ঘটনার আহাজারী প্রতিধ্বনিত থাকা অবস্থাতেই। কিন্তু ঘটনার স্মৃতি বছর বা দশক পেরিয়ে গেলেও কমিটি, টাস্কফোর্স বা মন্ত্রী, আমলাদের নির্দেশনার কোন বাস্তবায়ণ দেখা যায় না । বরং আরেকটি একই আকারের বা তার চেয়েও ভয়াবহ দুর্ঘটনার মুখোমুখি হতে হয় আমাদের । আরেকটি বিষয় লক্ষ্যনীয়-দুর্ঘটনার পর ঘুম থেকে জেগে উঠে তদারক প্রতিষ্ঠান । চোখ কচলাতে কচলাতে বলে- লঞ্চ বা বাসের রুট পারমিট, লাইসেন্স ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ, চালকের লাইসেন্স ছিলো না । ভবনের গ্যাস বিদ্যুতের সংযোগ ছিল অবৈধ, ভবনের নকশার অনুমোদন ছিলো না, মার্কেট বা বাণিজ্যিক ভবনের অগ্নিনির্বাপনের ব্যবস্থা ছিলো না । সীতাকুন্ডে কন্টেইনার ডিপোর অগ্নিকান্ডের পরেও দেখলাম বিস্ফোরক অধিদপ্তর বলছে, রাসায়নিক দ্রব্য মজুদের কথা জানানো বা অনুমোদন নেওয়া হয়নি । কন্টেইনার ডিপো জলের নিচে নয়, ওপরেই ছিল। তবু তাদের চোখে পড়েনি। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়েরও চোখে জলের বুদবুদ দিয়ে রেখেছিল ডিপো মালিকেরা । যেজন্য তাদেরও ডিপোটির অস্তিত্ব ছিল অজানা।

ঘুম পাড়িয়ে রাখার নানা মুদ্রা থাকে মালিক গোষ্ঠীর কাছে। তবে কোনো মুদ্রাতেই মুছে দেয়া যায় না স্বজনের চোখের জল। যে ডেউয়া ফলের আকাঙ্ক্ষা ছিল, সেই ফলটিও হয়ে ওঠে অমূল্য। জানি এখানেই শেষ নয়। অবহেলা, অবজ্ঞার জীবনই পুঁজির পর্বত গড়ে দেবার কাজে নিরলস রয়ে যাবে। এও জানি পৃথিবীর উষ্ণতায় গলছে বরফের পাহাড়। সবহারাদের দীর্ঘশ্বাসের উষ্ণতার আঁচ পাচ্ছি। পূর্বাভাসটা না হয় আপনারাই বুঝে নেবেন।

 

লেখক: সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

Link copied!