• ঢাকা
  • রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুকুটহীন কোহলি হতে পারেন ভারতের ‘বিরাট’ ভরসা


অঘোর মন্ডল
প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৬, ২০২২, ০৩:০৩ পিএম
মুকুটহীন কোহলি হতে পারেন ভারতের ‘বিরাট’ ভরসা

অধিনায়ক তিনি এখন ছেঁড়া ছেঁড়া অতীত। তবে ক্রিকেটার হিসেবে মোটেও বিস্মৃত বর্তমান নন। গত তিন মাসে তিনি ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটে অধিনায়কত্ব হারিয়েছেন। এবং ছেড়েছেন। কেপটাউন টেস্টে ভারত হারার পরই ড্রেসিংরুমে টিমমেটদের বিরাট কোহলি জানিয়ে দিলেন, তিনি আর অধিনায়কত্ব করবেন না। টিমমেটদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিলেন, কথাটা ড্রেসিংরুমের বাইরে যাবে। তবে সেটা তার মাধ্যমে। পরের অংশ ক্রিকেট বিশ্বের সব গোলার্ধে নেট মাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে। আর সেটা এখন সবার জানা।

বিরাট কোহলি বিশ্ব ক্রিকেটে অন্য রকম এক চরিত্র। ‘জেনারেশন এইট’ নামে যাদের ক্রিকেটগ্রহে পরিচিতি, অর্থাৎ ২০০৮ সালের যুব বিশ্বকাপ থেকে উঠে এসে যারা নিজেদের আলাদা উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, বিরাট তাদের অন্যতম। বিরাট-জো রুট-স্টিভ স্মিথ-কেন উইলিয়ামসন একই সরণির বাসিন্দা। কিন্তু তারা প্রত্যেকেই আলাদা। সেটা ক্রিকেটীয় দর্শন, মানসিকতা, ফিটনেস, স্কিল সবকিছুতেই। মিল শুধু তাদের এক জায়গায়। তাদের সবার রানের ক্ষুধা বড় তীব্র। জয়ের আকাঙ্ক্ষা বড্ড উদগ্র। তবে যে কারণেই হোক এ দেশের মানুষের কাছে বিরাট কোহলি খুবই অজনপ্রিয়!

তার বড় একটা কারণ হতে পারে, বিরাট কোহলি মানুষের হৃদয় জয় করার চেয়ে ম্যাচ জয়কে সব সময় বড় করে দেখেন। হারকে বড্ড ঘৃণা করেন। ভারতীয় হয়েও অস্ট্রেলিয়ান এই ক্রিকেট দর্শনের রিবাট আমদানিকারক তিনি। গান্ধীর আত্মা বা রঞ্জির আত্মা শান্তি পাবে এমনভাবে খেলে হারতে নারাজ তিনি। তার এই ক্রিকেটীয় দর্শন তিনি মাঠে সব সময় প্রয়োগ করেছেন। সেটা প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা বা বাংলাদেশই হোক। আর বাঙালিয়ানায় ক্রিকেট এখনো নিছক রোমান্সের প্রতিমূর্তি!

বিরাট কোহলি স্কোরশিটে প্রতিটি রানের পাশে তার প্রভাব লেখা থাক, এমন মেজাজে ব্যাট করেন। অধিনায়কত্বও করেছেন সেই মেজাজে। আসলে তিনি হচ্ছেন ‘উইদাউট ফিয়ার’ নামের এক ক্রিকেট বিস্ময়। যেখানে তার স্বদেশি শচীন নন, ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ভিভের ছায়া-কায়া আপনি খুঁজলেও খুঁজতে পারেন। কিন্তু খুঁজেটুজে দিন শেষে মনে হবে, বিরাট আসলে বিরাটের মতোই। ওকে দেখে মনে হবে প্রতিভাবান। কিন্তু প্রচণ্ড আগ্রাসী। এই আগ্রাসনের জন্য তার কাছে সবার আগে প্রাধান্য পায় ফিটনেস। শরীর, শরীর, শরীর এবং শরীরই শেষ কথা। তারপর আপনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ উপন্যাসের একটা লাইন যোগ করতেই পারেন নিজের মতো করে, “...শরীর, শরীর, তোমার মন নেই বিরাট!”

মন? সেটা তো ক্রিকেটীয় সৃষ্টিশীলতায় প্রচণ্ড পরিশ্রমে মগ্ন। বিরাট ক্রিকেটের যেকোনো শটের আগে জীবনের ধ্রুবতারা করেছেন ফিটনেসকে। তিনি জানেন, বিশ্বসেরাদের হারাতে হলে ওদের ফিটনেসকে আগে জয় করতে হবে। আধুনিক ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নের কাছে সেটাই দাবি করে। ফিটনেসের কারণেই ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটেই বিরাট কোহলির গড় পঞ্চাশের ওপরে। আধুনিক ক্রিকেটে এই সাম্রাজ্য তিনি অধিনায়কের মুকুট মাথায় পরেও ধরে রেখেছিলেন। অধিনায়কত্বের চাপমুক্ত বিরাট হয়ে উঠতে পারেন আরও ভয়ংকর, আগ্রাসী বিধ্বংসী এক ব্যাটসম্যান। আগামী কয়েক বছর ভারতীয় ক্রিকেটের মূল্যবান কোহিনুর হয়ে উঠতে পারেন তিনি।

সুনীল গাভাস্কার, শচীন টেন্ডুলকারের মতো সর্বকালের গ্রেট ব্যাটসম্যান জন্ম দিয়েছে ভারত। কিন্তু ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। ভিন্ন সময়ে তারা খেলেছেন। তাই তাদের সঙ্গে বিরাটের তুলনা করা ঠিক না। অনেকে বলবেন সাহসকিতা, আগ্রসনে শচীনের চেয়েও এগিয়ে থাকবেন রিবাট। কিন্তু বিরাট সেই ভারতের প্রতিনিধিত্ব করছেন, যে ভারত পরমাণু শক্তিধর, যে ভারতে কয়েক হাজার কোটিপতি, বিশ্বে দশজন সেরা ধনীর তালিকা করলে সেখানে জনাকয়েক ভারতীয় পাবেন। পৃথিবীর বড় বড় কোম্পানিগুলোর সিইওসহ বড় পদে এখন ভারতীয়রা কর্তৃত্ব করছেন, দাপট দেখাচ্ছেন। গুগল, টুইটার, আমাজনের মতো প্রতিষ্ঠান চালান ভারতীয়রা! বিরাটও তো ক্রিকেটের বাইশ গজে সেই দাপটই দেখাতে চাইবেন, সেটা আপনার আমার ভালো লাগুক বা না লাগুক।

অধিনায়ক বিরাট কোহলির রাজ্যপাট আর আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা নেই। কিন্তু তার ব্যাটে আক্রান্ত হতে পারে অনেক দল। তিনি আরও বেশি নির্মম ফিটনেসনির্ভর ব্যাটিংয়ে মনোযোগী হবেন, সেটা না বললেও চলে। দলে কোহলির অবস্থান বদলে যাবে। কিন্তু ভারতের হয়ে চার নম্বরে ব্যাট করতে নামা লোকটার প্রস্তুতির দিগন্ত রেখাও আরও বদলে যাবে। কোহলি হলেন সেই প্রজন্মের যাদের দর্শন, সারা দিন প্রচণ্ড খাটো। প্রচুর সময় জিমে পার করো। প্রাণপণ জিম করো। রুটিন মেনে খাও। মাঠে পারফর্ম করো। আর নিজের জীবনটকে নিজের মতো উপভোগ করো। ক্রিকেটের বাইরে নিজের জন্য স্পেস রাখো।

নিজের গ্রেটনেস কোহলি প্রমাণ করেই চলেছেন। তবে সেটা প্রমাণের মনে হচ্ছে, আরও স্পেস পেতে যাচ্ছেন তিনি। অধিনায়কত্ব ছাড়লেন কোহলি। কিন্তু দেশের হয়ে পারফর্ম করার উচ্চাকাঙ্ক্ষা আরও কিছুদিন বয়ে বেড়াবেন তিনি, তাতে সন্দেহ নেই। তাই মুকুটহীন কোহলি আগামী দিনে ভারতের আরও ‘বিরাট’ ভরসা হয়ে উঠতে পারেন। কারণ, কোহলির মতো ক্রিকেটাররা একটা শৃঙ্গ জয় করে সেখানেই বিজয় পতকা উড়িয়ে বসে থাকেন না।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক

Link copied!