• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বাংলা সাহিত্য : সংকট ও সম্ভাবনা


কুমার দীপ
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩১, ২০২১, ১০:৪৮ এএম
বাংলা সাহিত্য : সংকট ও সম্ভাবনা

বাংল সাহিত্য কি বিরাট কোনো সংকটের মুখোমুখি? এই প্রশ্নের সোজাসাপ্টা কোনো উত্তর দেওয়া কঠিন বটে, তবে ‘বিরাট’ কি না জানি না, কিন্তু বিশেষ সংকটের মুখোমুখি যে দাঁড়িয়ে, ইদানীং এ কথা প্রায়ই মনে হয় আমার। নিজে যদিও সাহিত্যের আস্বাদনেই অবসর সময়ের অনেকটা যাপন করি, তথাপি ঢোঁক গিলতে গেলে গলার কাঁটার মতো ফুটতে থাকে এই প্রশ্ন—সাহিত্য কি সত্যিই সংকটের মুখোমুখি নয়? অনেকে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিতে পারেন— সাহিত্য যদি সত্যিই সংকটের মুখোমুখি হয়, তাহলে চারিদিকে এত এত কবি-লেখক কেন? অগণিত সাহিত্য পত্রিকা বের হচ্ছে কী করে? আর প্রতিবছর হাজার-হাজার বই-ই বা ছাপা হয় কেমনে? আবার এসব প্রশ্ন করে কিংবা না করেও কেউ কেউ বলতে পারেন—কী সেই সংকট? কীভাবে কাটানো যাবে সংকট? প্রশ্ন যেমন একাধিক, উত্তরও বিবিধ; এবং বহুসাপেক্ষপ্রসূতও বটে।

কয়েক দিন আগে ‘সপ্তক’ নামে একটি সাহিত্য সংগঠনের আমন্ত্রণে মাগুরায় গিয়েছিলাম। ভায়না মোড় থেকে শহরে প্রবেশের রাস্তায় দু-তিনটি বইয়ের দোকান দেখে কবি অরবিন্দ চক্রবর্তী বললেন—‘দাদা, চলেন এখানকার দোকানে কোন ধরনের বই আছে, দেখে আসি।’ আমাদের সঙ্গে থাকা একজন বললেন—‘স্কুল-কলেজের গাইড বই ছাড়া আর কোন ধরনের বই থাকবে?’ আমিও মনে মনে এ রকমই ভেবেছি। সেই মুহূর্তে যেতে না পারলেও পরে একবার মুহূর্ত-ঢুঁ মেরে দেখেছি, ওই সঙ্গীর কথাই সত্য। অগ্রজ কবি হেনরী স্বপন কথাপ্রসঙ্গে বলছিলেন—‘এই আমাদের মতো পঞ্চাশোত্তর বা পঞ্চাশের কাছাকাছি লোকজন এখনো একটু-আধটু বইটই খোঁজে। এই জেনারেশন চলে গেলে আর কেউ বই পড়বে না।’ গত নভেম্বরে প্রশিক্ষণের কাজে দুসপ্তাহ বগুড়ায় ছিলাম। বগুড়া শহরের সবচেয়ে জনাকীর্ণ এলাকা হলো সাতমাথা। ঢাকার বিভিন্ন ফুটপাতে যেমন একসময় দৈনিকের পাশাপাশি বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা পাওয়া যেত, এই সাতমাথাতেও তেমনি অনেক সাহিত্য পত্রিকা, এমনকি দু-চারটি লিটলম্যাগেরও দেখা মিলত। ২০১৪ সালেও আমি একাধিক সাহিত্যের কাগজ পেয়েছি এখানে। এবার দেখলাম সেই এলাকায় মাস্ক, স্যানিটাইজার, মানিব্যাগ ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় কতিপয় দ্রব্যাদির সঙ্গে বই বলতে আছে কয়েকটি ধর্মীয় পুস্তক। ২০১৯-এর মার্চে আমার প্রিয় ক্যাম্পাস রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে শহীদুল্লা কলাভবনের পেছনের স্ন্যাকসের দোকানটিতে একবার ঢুঁ মেরেছিলাম। এই দোকানে কেক-পেস্টিসহ নানা রকমের খাবার ও প্রসাধনের পাশাপাশি জীবনানন্দ দাশের ‘প্রেমের কবিতা’; তারাশঙ্করের ‘কবি’; শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘দুরবীন’; সুনীলের ‘সেই সময়’, ‘পূর্ব-পশ্চিম’; সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’; বুদ্ধদেব গুহ’র ‘একটু উষ্ণতার জন্য’ ইত্যাদি নির্বাচিত বই শোভা পেত। হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন, জুলফিকার মতিনসহ এই ক্যাম্পাসে যাদের অধিক প্রিয়তা ও পরিচিতি আছে, তাদেরও সদ্যমুক্ত দু-একটি বই মিলত। দু-হাজার উনিশে সেই শোকেসে অন্য অনেক কিছু আছে, কিন্তু বই নেই বললেই চলে। রাজশাহী শহরে একটি দোকান ছিল, যেখানে শুধু ইন্ডিয়ান প্রিন্টের বই পাওয়া যেত। বিশেষ করে বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত বইগুলো কী-সহজেই না মিলত এখানে! রবিঠাকুরের কয়েকটি বই এখান থেকেই খুব স্বল্প মূল্যে কিনেছি ছাত্রজীবনে। বাংলা বিভাগের অধ্যাপক, গল্পকার সৈকত আরেফিন বললেন—‘দাদা, সেই দোকান এখন উঠে গেছে।’ রাজশাহী থেকে খুলনা ফেরার পথে ট্রেনে বসে বসে ভাবছিলাম—কোমরের নিচ থেকে গলা পর্যন্ত বই সাজিয়ে যারা বগিতে বগিতে হকারি করতেন, তারা এখন কোথায়? ট্রেনে উঠব, অথচ স্বল্প মূল্যে হাতের নাগালে পাওয়া দু-তিনটে বই কিনব না, এরকমটা ভাবতে পারতাম না একসময়! ‘বিষবৃক্ষ’, ‘বিষাদসিন্ধু’, ‘সোনার তরী’, ‘দেবদাস’, ‘দেনাপাওনা’, ‘চরিত্রহীন’, ‘রিক্তের বেদন’ ইত্যাদি কত বই যে তাদের বুকে হেলান দিয়ে ট্রেনে ট্রেনে ঘুরে বেড়াত! ‘লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’-এর মতো বিদেশি বইও এই ট্রেন থেকে কিনে পড়তে পড়তে গন্তব্যে গেছি আমি! মাসকয়েক আগে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে গিয়েছিলাম। ওখানকার ‘পল্লীমঙ্গল লাইব্রেরি’ নামের বইয়ের দোকানটি আমাদের স্বাধীনতার চেয়েও বেশি বয়সের। দোকানটি আমার মামা জিতেন্দ্রনাথের। মামাকে কখনো সাহিত্যের বই পড়তে দেখেছি বলে মনে পড়ে না, কিন্তু তাঁর ওই দোকানটিতে একেবারে সামনের দিকের র্যাকে সারি সারি সাজানো থাকত মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, মীর মশাররফ, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল, জীবনানন্দ, বিভূতি, মানিক, তারাশঙ্কর, জসীমউদ্দীন, ওয়ালীউল্লাহ, যাযাবর, ফাল্গুনী, নিমাই, নীহাররঞ্জন, নির্মলেন্দু, সুনীল, সমরেশ, শীর্ষেন্দু, শঙ্কর, হুমায়ূন, ইমদাদুল প্রমুখ লেখকের পাঠকপ্রিয় বইগুলো। আমার পঠন-জগতে প্রবেশের প্রধান আধার এই লাইব্রেরিটি এখন কিছু প্রতিষ্ঠানপাঠ্য গাইড আর দু-চারখানা ধর্মীয় পুস্তক নিয়ে অস্তিচর্মসার হয়ে ফুল-পাতাশূন্য বৃক্ষের মতো কোনোরকমে টিকে আছে। শিল্প-সাহিত্যের দেশি-বিদেশি ধ্রুপদি বই ও সাহিত্যের কাগজের তীর্থভূমি শাহবাগের আজিজে গেলে লেখক-শিল্পী, গবেষক-অধ্যাপক এবং অন্যান্য জ্ঞানপিপাসুর হৃদয় এখন আগের মতো চাঙা হয়ে ওঠে না। তাহলে?
 
২.
বর্তমানে সাহিত্যের অন্যতম প্রধান একটি সংকট হলো—পাঠক সংকট। সংকট বইয়েরও আছে; তবে সেটা পরিমাণের নয়, মানের। অবশ্য ‘মানের’ সংকটটি গৌণ হয়ে উঠছে এই কারণে যে, কিছু ভালো বইও তো হচ্ছে, তার পাঠক কই? থাকলে, তা কতজন? কথা আসতে পারে—সাহিত্যের পাঠক কারা? বই পড়ার মতো শিক্ষা ও পাঠের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে যার, তিনিই পাঠক। শৈশব-কৈশোরে দেখেছি, আমার বাবার মতো কিছু দূর লেখাপড়া জানা লোকেরা চাকরিবাকরি না করলেও হাতের কাছে বই পেলেই সেটা পড়তেন বা নাড়াচাড়া করে দেখতেন, সেটা ধর্মপুস্তকই হোক আর পঞ্জিকাই হোক। আমাদের স্কুলবইগুলোও তাদের পড়ার বাইরে থাকত না। বাবার মৃত্যুর ষোলো বছর পরও আমার চোখের সামনে ভাসে—বিকেলের আলোয় খালি চোখে পঞ্জিকার পাতা ওল্টাচ্ছেন প্রায় আশি বছরের একজন মানুষ। আমার জ্যেষ্ঠ ভগ্নিপতি, ৪-৫ বছর আগে যিনি প্রয়াত হয়েছেন, চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে এসেছিল বলে বারান্দায় ঝুলে থাকা বিজলি আলোর নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার কাছ থেকে গল্প-উপন্যাসের বই নিয়ে পড়তেন। যে যুগে স্কুলপড়ুয়া গ্রাম্য মেয়ে প্রায় বিরল ছিল, সে যুগের মেয়ে আমার মা ও মায়ের চেয়ে অগ্রজরা। পাশের বাড়ির এক ঠাকুরমা, কী মধুর সুরে যে রামায়ণ-মহাভারত পড়তেন! আমার মা এখন মধ্য আশিতে, যিনি এখনো মাঝেমধ্যে ছেলের বই নিয়ে বসেন; আমার শৈশবের বৃহস্পতিসন্ধ্যাগুলো তাঁর ব্রতকথায় কী অনিন্দ্য মুখরিত হতো! আমি যখন প্রাইমারিতে—ছোটদের রামায়ণ-মহাভারত-ঠাকুরমার ঝুলি পড়েছি, উপেন্দ্রকিশোর পড়েছি। এসএসসি পরীক্ষার সময় আমার সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ দেখে আগের বছরে ম্যাট্রিক পাস এক বড় ভাই বলেছিলেন, বঙ্কিমের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ না পড়লে ভাষা শেখা যায় না। পরীক্ষা শেষ করেই বইটি পড়ে ফেলেছিলাম, যদিও কিছু কিছু শব্দের অর্থ বুঝতে পারিনি তখন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথা নাই-বা বলি, মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের সময় বঙ্কিম-শরৎ-যাযাবর-ফাল্গুনী-নীহাররঞ্জন-নিমাই প্রমুখ কত কত লেখকের বই গো-গ্রাসে গিলেছি! আমার চেয়ে অধিক পড়ুয়া ছেলেমেয়েরও অভাব ছিল না আমাদের ছাত্রজীবনে। যারা সিলেবাসের বাইরের তেমন পড়ত না, তাদের পড়ার টেবিলেও শোভা পেত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শংকর, বুদ্ধদেব গুহ এবং শেষ দিকে হুমায়ূন আহমেদ-ইমদাদুল হক মিলন প্রমুখের জনপ্রিয় উপন্যাসগুলো। কিন্তু এখন? 

মান্না দের বিখ্যাত একটি গানে আছে—‘এখনো কি রাত নিঝুম হলে/ শরৎ কাহিনি পাশে খোলা পড়ে থাকে/ ব্যাকুল তিয়াসে আমারই পিয়াসে/ অন্তর কেঁদে মরে/ জানতে ইচ্ছে করে/ খুব জানতে ইচ্ছে করে...’। গীতিকবি মুক্তি রায় চৌধুরীর কলমে যে কথা সেই সময়ের বাস্তবতাকে ছুঁয়েছিল নিবিড় আদরে, এখনকার প্রেমে তার কি কোনো জায়গা আছে? শরৎ কাহিনি তো দূরের কথা, এখন তো কোনো চিঠিও পড়তে হয় না প্রেমিক-প্রেমিকাকে! অথচ একদিন প্রেমিক-প্রেমিকা পরস্পরের মন জয় করবার জন্য যে চিঠি লিখত, তা-ও মাঝেমধ্যে হয়ে উঠত সুখপাঠ্য সাহিত্য! চিঠিকে এই ‘হয়ে ওঠা’ বা গড়ে তোলার জন্য বইপড়া ছিল একটি প্রায় অনিবার্য কাজ। আর যারা বই পড়তে পারত না কিংবা টুকটাক পড়লেও সে ধরনের ভাষাটা আনতে পারত না, তারা প্রয়োজনে অন্য কারো নিকট থেকে লিখে নিতেও দ্বিধাবোধ করত না। হলুদ (কখনো কখনো নীল বা সবুজ) খামে আসা প্রিয়জনের চিঠির প্রিয় কথাগুলো কতবার করে যে পড়া হতো! গল্প-উপন্যাস তো ছিলই, এই তো বছর বিশেক আগেও প্রেমের কবিতার বইয়ের সন্ধানে বইয়ের দোকানে দোকানে ঘুরেছে প্রেমিক-প্রেমিকারা! জীবনানন্দ দাশ, পূর্ণেন্দু পত্রী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু গুণ, হেলাল হাফিজ প্রমুখের কবিতার বই থাকত তাদের অন্যতম পছন্দের তালিকায়। কিন্তু এখন সেই সব প্রেমিক-প্রেমিকার কাছে বই নেই, চিঠি নেই; আছে স্মার্টফোন। একটিমাত্র স্মার্টফোনের স্পর্শে তারা মনে উঠলেই পৌঁছে যাচ্ছে প্রিয়জনের অন্দর-মহলে। কথা বলাটাই একদিন যেখানে বিরাট প্রাপ্তি ছিল, এখন সেখানে লাইভ ভিডিওযোগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটাতে পারছে তারা। কোনো বিরহ নেই, একটিবার দেখা করার জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করা নেই, অন্য কোনো মানুষকে দিয়ে প্রিয়জনকে বারবার খবর দেওয়ার ঝক্কি নেই, একটি চিঠির জন্য দুরু দুরু বুকে পিয়নের পথ চেয়ে তাকিয়ে থাকা নেই। সুতরাং প্রেমের জন্য বইয়ের কাছে যাওয়ার—‘সে যুগ হয়েছে বাসি’। স্মার্টফোন কি শুধু তাদের প্রেমের দাবি পূরণ করেছে? প্রেমের বাইরে জীবন ও জগৎকে চিনতে যারা বইয়ের কাছে যেত, তারাও এখন স্মার্টফোনের দুনিয়ায় বন্দি। মোটাদাগে বলতে গেলে, ছাত্রছাত্রীরা এখন গল্প-কবিতা-উপন্যাস পড়ে না। বিনোদনের যাবতীয় আয়োজন, এমনকি মাঠের খেলাধুলাও উবে গিয়ে স্মার্টফোনের গেমই হয়ে উঠেছে সময়ের অনিবার্য আশ্রয়। অথচ একদিন যেকোনো ধরনের বইয়ের সবচাইতে বৃহৎ অংশের পাঠক ছিল ছাত্রছাত্রীরাই। হুমায়ূন আহমেদের একেকটি বই যে হাজার হাজার কপি বিক্রি হতো, তার প্রায় পুরোটাই তো এরা। শুধু ছাত্রছাত্রীদের কথাই-বা কেন বলি, যারা কৈশোরে-তারুণ্যে বই-পত্রকে তাদের অবসর যাপনের বিশেষ অংশ বলে মনে করতেন, সেই পিতা-মাতাদের অবস্থাই-বা এখন কী? স্মার্টফোনের কারসাজি থেকে তারাও কি নিজেদের মুক্ত রাখতে পারছেন? না। এখন মায়েদের একটা বিরাট অংশই তো টিভি সিরিয়ালের মতো আরেক মাদকে আসক্ত! তাহলে বইয়ের পাঠক কোথায়?

বইয়ের পাঠক যদি না থাকে, প্রতিবছর বইমেলায় এমন হাজার হাজার বই প্রকাশিত হয় কেন? বিক্রিই যদি না হয়, প্রকাশকরা লাখ লাখ টাকা খরচ করে এই সব বই প্রকাশই-বা করছেন কেন? হ্যাঁ, প্রতিবছর অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে কয়েক হাজার বই প্রকাশিত হয় আমাদের দেশে। এর মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি থাকে কবিতার বই, যার পাঠক এখন নেই বললেই চলে। প্রচুর বই বের হওয়ার প্রধান কারণ পাঠক নয়, লেখক। আমাদের দেশে প্রচুর লেখক এখন। লেখকের মধ্যে আবার কবির সংখ্যাই সর্বাধিক। বাঙালির ভেতরে কবিত্বের স্বভাব চিরকালই বেশি। অনেকেই কবিতা লিখতে চান। লেখক বেশি বলেই যে বেশি বেশি বই বের হবে, এটাও পুরোপুরি সত্য নয়। আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে বই ছাপানো এখন সামান্য একটি কাজ। হ্যাঁ, সামান্যই। একসময় একটি বই ছাপাতে যেখানে মাসের পর মাস লেগে যেত, কখনো-বা বছর। এখন সেখানে কয়েক দিনেই হাতে এসে যাচ্ছে ঝক্ঝকে তকতকে নতুন বই। লেখক নিজেই কম্পোজ করে দিচ্ছেন, ডাকঘর-পিয়নের অপেক্ষা না করে মুহূর্তেই সেটা পৌঁছে যাচ্ছে প্রকাশকের ডেরায়। লেখক নিজেই টাইপ করছেন বলে প্রুফের হ্যাপাটা যেমন হালকা হচ্ছে, তেমনি প্রচ্ছদশিল্পী থেকে ছাপাখানাও এমন প্রযুক্তিনির্ভর যে, রাতারাতিই সেটা বাঁধাইঘর হয়ে পাঠকের নাগালে এসে যাচ্ছে। নাগালে এসে যাচ্ছে কিন্তু পাঠক যতটা হাতে নিচ্ছেন, তার শতগুণ বেশি হাতে নিচ্ছেন লেখক নিজেই! হ্যাঁ, লেখক নিজে যদি নবীন হন তাহলে তো কথা নেই, এমনকি অনেক নবীনোত্তর এবং প্রায় প্রবীণ লেখকও নিজেই হয়ে উঠছেন নিজের বইয়ের সর্বোচ্চ ক্রেতা। সমাজের অন্যদের মতো লেখকেরও আর্থিক সামর্থ্য বেড়েছে, আগেকার দিনে যেমন প্রতিভাবান লেখকেরাও তাদের প্রথম পাণ্ডুলিপিটি নিয়ে প্রকাশকের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেড়াতেন, কখনো কখনো সামর্থ্যবানের কাছে ধর্না দিতেন, এখন আর তার প্রায় দরকারই হয় না। লেখকই বই ক্রয় কিংবা বিপণনের প্রতিশ্রতি দেন; কেউ কেউ আবার প্রকাশকের চাহিদামতো আগাম টাকা দেন। টাকা থাকলেই এখন লেখক হওয়া যায়, লেখার মান কোনো ব্যাপার নয়। কিছু প্রকাশক যেমন বসে আছেন এই ধরনের লেখকের অপেক্ষায়, কিছু লেখক হতে চাওয়া লোকও তেমনি টাকা হাতে বসে আছেন লেখক হওয়ার অপেক্ষায়। বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাবাজারের এক প্রকাশকের সঙ্গে কথা হয়েছিল, যিনি প্রতিবছরই দু-চারজন প্রবাসী লেখক এবং কয়েকজন টাকাওয়ালা নারী লেখকের বই করেন, যারা কিনা প্রকাশক যা চান, সেই পরিমাণ টাকা দেন। আমরা দেখে আসছি, প্রথম বইয়ের লেখকেরা, বিশেষত গল্প-কবিতার লেখকেরা একশ-দুশো কিংবা তিনশ কপি বই কিনে নিয়ে তিনিই পৌঁছে দিচ্ছেন পাঠকের হাতে। কবিতার ক্ষেত্রে তো প্রথম-দ্বিতীয় নেই, সব সময়ই প্রায় সমান। কবিতার বই, কবি নিজে বয়ে নিয়ে গিয়ে কিংবা পকেট থেকে কুরিয়ার খরচ দিয়ে তিনি বই পৌঁছে দিচ্ছেন প্রিয় পাঠকের দোরগোড়ায়। পাঠক বলছি বটে, কিন্তু লেখকের বদান্যতায় পাওয়া বইটি যে তিনি পড়ছেন, তারও তেমন কোনো প্রমাণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাওয়া যাচ্ছে না! এসবের ফলে, পাঠক কিনুন আর না কিনুন, পড়ুন আর না পড়ুন বই ছেপে কিন্তু প্রকাশকের বিশেষ লোকসান হচ্ছে না। বিপণনের ক্ষেত্রে বড় কোনো ঝামেলা ছাড়াই এই যে বইগুলো চলে যাচ্ছে, এতে তাঁর বরং পরিশ্রমই কমে যাচ্ছে। এক মেলাতেই তিনি ছেপে ফেলছেন শতাধিক বই। এই যে এতগুলো বই ছেপে দিচ্ছেন, এগুলোর সবটাই যে মানস্মত নয়, সে কথাও কিন্তু দিবালোকের মতো সত্য। কেউ কেউ বলেন, প্রতিবছর বইমেলাকে কেন্দ্র করে যে কয়েক হাজার বই ছাপা হয়, এর শতকরা ৯০ ভাগই নাকি মানসম্মত নয়। ৯০ ভাগ কি না নিশ্চিত করে বলতে পারি না, তবে অধিকাংশ বই যে মানসম্মত নয়, এ কথা স্বীকার করতেই হবে। যে কেউ ইচ্ছে করলেই যদি বইয়ের লেখক হতে পারেন, প্রকাশক যদি যাচাই-বাছাই ছাড়াই কেবল ব্যবসায়িক স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে বই প্রকাশ করেন, তাহলে মানসম্মত বই আসবে কোত্থেকে? 

জানি, এই পর্যন্ত পড়বার পরই, লেখক-প্রকাশকদের অনেকেই মনে মনে কট্মট্ করে তেড়ে আসছেন আমার দিকে। তাদের উদ্দেশে বিনয়ের সঙ্গে বলি, সব লেখক কিংবা প্রকাশক কিন্তু আমার উপর্যুক্ত বক্তব্যের উদ্দিষ্ট নয়। এমনকি পাঠক যে একেবারেই নেই-ই, এ কথাও আমার বলবার উদ্দেশ্য নয়। আমি জানি, আমাদের অধিকাংশ প্রবীণ লেখক, অনেক আধা প্রবীণ লেখক এমনকি বেশ কয়েকজন নবীন ও নবীনোত্তর লেখক আছেন; যাদের বই প্রকাশকরা স্বেচ্ছায়, কখনো কখনো স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রকাশ করেন। এই সব লেখকের প্রত্যেকেরই যে প্রচুর পাঠক আছেন, তা হয়তো নয়, কিন্তু কারো কারো বেশ কিছু পাঠক যে আছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর ব্যতিক্রম দু-একজন লেখকের অনেক পাঠক আছেন, যারা জনপ্রিয় ধারার উপন্যাস-টুপন্যাস লেখেন। উপন্যাস শব্দটি যেহেতু লিখেই ফেলেছি, সেহেতু এ কথাটিও বলা দরকার, এখনো কাগজের বইয়ের পাঠক যারা আছেন, তাদের সবচেয়ে বড় অংশটি উপন্যাসেরই। সেটা যেমন জনপ্রিয় ধারার, তেমনি পরিমাণে কম হলেও সিরিয়াস ধারারও। কিছু আছেন গল্পের, কিছু প্রবন্ধ ও ইতিহাসের, আর কবিতার পাঠক বিরলপ্রায়। এই যে সিরিয়াস ধারার উপন্যাস ও গল্পের কিছু, প্রবন্ধ ও ইতিহাস-দর্শনের সামান্য কিছু এবং কবিতার নগণ্য কিছু পাঠক আছেন, এদের অধিকাংশই কিন্তু আবার নিজেরাও লেখক। নিজেদের পাঠস্পৃহা এবং লেখালিখির সুবিধার্থে তারা প্রতিবছরই নতুন নতুন বই কেনেন। আরেকটি অংশ আছেন ওই বিষয়ের শিক্ষার্থী, গবেষক এবং অধ্যাপক, যারা একাডেমিক প্রয়োজনেই ওই সব বই কিনতে বাধ্য হন। বলে রাখা ভালো, সাহিত্যবিষয়ক এই আলোচনায় স্বাভাবিকভাবেই আমি কিন্তু প্রথাগত ধর্মীয় বই, ইংরেজি শিক্ষার শর্টকাট থেরাপি কিংবা ক্যারিয়ার উন্নয়নে ওই বেস্টসেলার টাইপের বইগুলোকে বাইরে রেখেছি। বই বিপণনের সবচেয়ে বড় অনলাইন কেন্দ্র ‘রকমারি ডটকম’-এর ওয়েবসাইটে ওগুলোই সারা বছর পাঠক-পছন্দের শীর্ষে থাকে, যা কিনা আমাদের দেশের বর্তমান পাঠসংস্কৃতির একটি চালচিত্রকে নির্দেশ করে। সাধারণ পাঠক এই সব পার্থিব-অপার্থিব দরকারি বইয়ের বাইরে কেবল সহজপাঠ্য ও জনপ্রিয় ধারার সাহিত্যের প্রতি বিশেষ আগ্রহী থাকেন। অবশ্য এ কথা বলে রাখা দরকার, সহজপাঠ্য ও জনপ্রিয় ধারার সাহিত্যের প্রতি সাধারণ পাঠকের সব সময়ই আগ্রহ ছিল, কিন্তু এ কথাও স্মরণ করিয়ে দেওয়ার দরকার, পূর্বে যে এই ধারার আওতায় বেশ কিছু লেখকের প্রতি আম-পাঠকের আগ্রহ অনেক ছিল, এখন তা হাতে গোনা দু-একজনে নেমে এসেছে। আর সেই দু-চারজনের বইও যে হাজার হাজার কপি বিক্রি হচ্ছে, তা-ও নয়। একসময় হুমায়ূন আহমেদের একটি বই ২৫-৩০ হাজার কপি বা তারও বেশি বিক্রি হতো; জাফর ইকবাল, আনিসুল হকের বইয়েরও বেশ কাটতি ছিল। কিন্তু এখন এমন কেউ কি আছেন? হালের প্রজন্মের ক্রেজ সাদাত হোসাইনের কিছু পাঠক আছেন বলে জেনেছি, কিন্তু তার সম্পর্কে কিংবা তার পাঠকদের সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলবার সময় বোধকরি আসেনি এখনো। শুধু পাঠকসংখ্যা দিয়ে কখনো সাহিত্যের মান যাচাই হয়নি কোনো দিন। বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের পাঠকপ্রিয় লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্যের মান কিন্তু কম ছিল না, আবার কাশেম বিন আবু বাকারের মতো পাঠকপ্রিয় লেখক কিন্তু পরের প্রজন্মের কাছেই পৌঁছাতে পারেন না ওই মানের অভাবেই। 

৩.
এই মুহূর্তে কোনো কোনো গ্রন্থপ্রেমী হয়তো ভাবতে শুরু করেছেনÑ পাঠকশূন্যতা নিয়ে এতগুলো কথা বললাম, অথচ প্রতিবছর বইমেলা শেষে যে কোটি কোটি টাকার বই বিক্রির খবর প্রচারিত হয়, সেগুলো কি মিথ্যা? নাকি সবই ওপরে উল্লেখিত কিছুসংখ্যক ক্রেতার ক্রোড়ে সীমাবদ্ধ? আমি বলবÑ মিথ্যা নয়, ওপরে উল্লেখিত ক্রেতাদের মধ্যেও সীমাবদ্ধ নয়। তবে আমার মনেও একটি পাল্টা জিজ্ঞাসা আছে। এই দেশে এখন আঠারো কোটির ওপরে মানুষের বসবাস, শিক্ষার হারও বেড়ে ৮০% হয়েছে বলে শুনি। পাঠক কি সেই তুলনায় বেড়েছে? নব্বইয়ের দশকে যখন ২৫-৩০% সাক্ষরতার হার ছিল, তখন কোনো কোনো লেখকের বই হাজার হাজার কপি চলত। এমনকি একুশ-শতকের প্রথম দশকের তুলনায় এখন কেবল গড়ই নয়, মোট পাঠকের সংখ্যাও কমে গেছে বলে মনে হয়! আগে তো সারা বছরই বই প্রকাশিত হতো। বিক্রিও হতো সারা বছর। এবং সারা দেশেই। এখন বই প্রকাশের প্রায় পুরোটাই ফেব্রুয়ারিনির্ভর। বিপণনও প্রায় তাই। ফলে এখনো যে কিছুসংখ্যক পাঠক আছেন, তারাও মূলত ফেব্রুয়ারির অপেক্ষায় বসে থাকেন। আবার পড়ুন আর না পড়ুন, মেলায় গিয়ে বই কেনাটাও কিছু মানুষের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। (অবশ্য বইমেলায় যে বহু মানুষ কেবল বেড়ানোর জন্যই যায়, সেই চিত্রও আমাদের চেনা।) মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, শহুরে মানুষদের কেউ কেউ নাকি ঘর সাজানোর আভিজাত্য হিসেবেও কিছু কিছু বইকে বেছে নিচ্ছেন। আর গত দু-বছর কোভিড বাস্তবতায় ঘরে বসে ভিটিও মিটিংয়ে যুক্ত হওয়ার যে জুম কালচার (জুম, মিট, রুম ইত্যাদি) তৈরি হয়েছে, সেখানেও ‘অ্যারিস্টোক্র্যাটিক’ হওয়ার প্রয়োজনে বই দিয়ে ব্যাক্গ্রাউন্ড সাজাচ্ছেন অনেকেই। সরকারিভাবেও ইদানীং অনেক বই কেনা হচ্ছে। বিশেষত দেশের পাবলিক লাইব্রেরিগুলোতে সরকারি অর্থায়নে প্রতিবছর যুক্ত হচ্ছে অনেক অনেক বই। ঊর্ধ্বতনের আদিষ্ট হয়েও বই ক্রয়ে বাধ্য হচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান। গত কয়েক বছরে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুবিষয়ক বইগুলো নিয়ম করে কিনছে, বিশেষত সরকারি অফিসগুলো। অবশ্য সরকারি আদেশে ক্রয়কৃত বইগুলোর অধিকাংশই সরকার কর্তৃক নির্ধারিত। কিন্তু এই যে সরকারি উদ্যোগে প্রতিবছর বিভিন্ন লাইব্রেরি ও অফিসগুলোতে অনেক বই ঢুকছে, এগুলো কি সেভাবে পঠিত হচ্ছে? আমি যে জেলা শহরে থাকি, সেখানে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে দুটি পাবলিক লাইব্রেরি আছে। আট-দশ বছর আগেও এই লাইব্রেরি দুটিতে গেলে সিটগুলো পাঠকে ভরে থাকত। বিশেষ করে বেসরকারি ম্যাক্ফারসন লাইব্রেরিটিতে বিকেল বা সন্ধ্যায় ছিট খালি পাওয়াই মুশকিল হতো। এদের অনেকেই যদিও পত্রিকার পাঠক ছিলেন, এখন তো একেবারে জনশূন্য হলঘরে খাঁ খাঁ চেয়ে থাকে টেবিলগুলো! কোভিড-১৯ এই দৃশ্যগুলোকে আরও দীর্ঘ ও দহনীয় করে তুলেছে। তাহলে? সংকট যদি সত্য হয়, উত্তরণের কোনো উপায় কি নেই? 

৪. 
‘শেষের কবিতা’র নায়ক অমিত রায়ের মুখ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—‘কমল-হীরের পাথরটাকেই বলে বিদ্যে, আর ওর থেকে যে আলো ঠিকরে পড়ে তাকেই বলে কালচার। পাথরের ভার আছে, আলোর আছে দীপ্তি।’ আমরাও যে ‘বিদ্যে’র পিছনে ছুটছি না—তা নয়, কিন্তু যে ‘বিদ্যে’র থেকে কালচারের আলো ঠিকরে পড়ে সেই বিদ্যেটা কোথায়? আমরা আজ সম্পূর্ণভাবে পুঁজিবাদের করতলে বন্দি। পুঁজি প্রতিনিয়ত যা বলাচ্ছে, আমরা তা-ই বলছি; পুঁজি প্রতিনিয়ত যা করাচ্ছে, আমরা তা-ই করছি; পুঁজি প্রতিনিয়ত যা ভাবাচ্ছে, আমরা তা-ই ভাবছি। পুঁজির ঊর্ধ্বপ্রবাহকে আরও গতিশীল করছে আমাদের সীমাহীন ভোগ-লালসা, দুর্নিবার আরামপ্রিয়তা আর নির্লজ্জ স্বার্থপরতা। কোনো দায়বদ্ধতা কিংবা মূল্যবোধ ছাড়াই আমরা নিরন্তর নিজেদের লাভের পিছনে ছুটছি। প্রযুক্তি আমাদের সবকিছুই করে দিচ্ছে বলে ওর পিছনে মুক্তকচ্ছ হয়ে কেবল দৌড়াচ্ছিই না, নিঃশর্ত আত্মসমর্পণও করছি নিজেকে। কিন্তু প্রযুক্তি আমাদেরকে যা দিচ্ছে, তার সবকিছুই কি ভালো? প্রযুক্তি যে কেবলমাত্র চোখের তৃপ্তি ও মনের সাময়িক আনন্দের উত্তাপ মিটিয়ে আমাদের মূল্যবান সময়ের বিরাট অংশ কেড়ে নিচ্ছে, তা কি আমরা টের পাচ্ছি? আমাদের প্রত্যেক সন্তানের হাতে ন্যূনতম একটি করে প্রযুক্তিপণ্য তুলে দিয়েছি। ওখানেও বিস্তর জ্ঞান আছে, লেখাপড়ার সমুদ্র আছে। একেবারে সত্য কথা। কিন্তু আমাদের শিশু ও উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েরা যে রণে-বনে-জলে-জঙ্গলে সবখানেই ওইটা মুঠো করে ধরে আছে, সব কি জ্ঞানের জন্য? লেখাপড়ার জন্য? যে-বয়সে অবসরে ঘরে বসে থাকারই কথা নয়, সেই বয়সে ওরা বসে-শুয়ে দিন-রাত কাটাচ্ছে, বকে-ঝকেও বাইরে পাঠানো যাচ্ছে না, এটা কি কেবল জ্ঞান আহরণের জন্য? বাইরে বের হলেও কি বাইরে থাকছে তারা? রাস্তার পাশে, নদীর ধারে, গলির কোণে... সবখানেই তো ওই একই যন্ত্রের অন্ধকারে ডুবে থাকছে! আমাদের খেলার মাঠগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে আমরা চিৎকার করি, মানববন্ধন করি; কিন্তু যেগুলো এখনো আছে, সেগুলো যে খেলোয়াড়শূন্য পড়ে থেকে ঘুমোচ্ছে, সেদিকটা কি খেয়াল করছি? ভার্চুয়াল দুনিয়া ওদেরকে এমনভাবে গ্রাস করেছে যে, একচুয়াল পৃথিবীর বন্ধুরা পাশাপাশি বসে থাকে কিন্তু কেউ কারও মুখের দিকে তাকায় না, গল্প করে না, শুধু চোখ ও আঙুলের কাজে মত্ত থাকে। ওরাও হয়তো ভালোবাসে, প্রেম করে কিন্তু আপন মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে সময় কাটানোর সময় কি ওদের আছে? অনলাইন ক্লাসের কথা বলে আমাদের কোমলমতি সন্তানেরা যে একটি করে ডিজিটাল ডিভাইস নিল, সেটা কোন লাইনে অধিক পরিমাণে ব্যয়িত হচ্ছে, তার খবর কি আমরা রাখছি? বিজ্ঞানের এই অভূতপূর্ব অগ্রগতির যুগে আমাদের সব সন্তানেরই তো বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে আগামী পৃথিবীর অগ্রসেনানী হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বাস্তবে তাই কি হচ্ছে? আমাদের সন্তানেরা প্রযুক্তিযুগের আগে যতটা কূপমণ্ডূক ছিল, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক ধ্যানধারণার ভেতরে ছিল, এখন কি তার চেয়ে কম? অনলাইনে, অফলাইনে তাদের অ্যাকটিভিটিগুলো দেখলে তো যেকোনো চোখওয়ালা মানুষেরই মনে হবে—অধিকতর মৌলবাদের পথে, উগ্রতর সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির পথে পা বাড়াচ্ছে আমাদের তরুণ প্রজন্ম। গত কয়েক বছরে ঘরে-বাইরে যে দৃশ্যগুলো দেখে আসছি, তাতে মানুষের জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা যে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, এ বিষয়ে অনেকেরই সন্দেহ থাকার কথা নয়। আমাদের সহমর্মিতা, পরমতসহিষ্ণুতা ও মানবিক মূল্যবোধ কোন খাদে গিয়ে নেমেছে তার বহু নমুনা আমাদের সামনে প্রতিনিয়ত মঞ্চায়িত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বলে যেগুলোকে অভিহিত করছি, সেগুলোতে সমাজ ও মানবতাবিরুদ্ধ এত কর্মকাণ্ড, নগ্নভাবে অন্যকে আক্রমণ ও অপমানিত করবার এমন মহড়া,—কী সামাজিকতা শেখাচ্ছে আমাদের?

কেউ কেউ নিশ্চয়ই ভাবছেন, সাহিত্যের সংকটের কথা বলতে গিয়ে, বিদ্যের আলো কিংবা কালচারের কথা বলতে গিয়ে এত সব বাড়তি কথা বলছি কেন? আমি জানি, অপরের বাড়তি কথা শোনার বা পড়ার মতো সময় আমাদের হাতে এখন আর নেই। এটাই আমাদের আজকের কালচার। আর হ্যাঁ, এই যে এতগুলো বাড়তি কথা বলে ফেললাম, এটাও কিন্তু আজকের কালচারটাকেই একঝলক দেখে নেওয়ার জন্যই। এই কালচারের ভেতরে আলোর সেই দীপ্তি কোথা থেকে আসবে? আলোর দীপ্তির জন্য আমাদের সেই বিদ্যের কাছে যেতে হবে, যে বিদ্যের ভেতরে একই সঙ্গে অগ্রগতি ও মানবিক মূল্যবোধের পরশ পাথর আছে। সেই পরশ পাথর যে অনলাইন প্রযুক্তির দুনিয়ায় নেই, তা কিন্তু নয়। বিস্তর আছে। কিন্তু যারা এগুলোর ভোক্তা, তারা পরশ পাথরের চেয়ে সাময়িক চাকচিক্যে ভরা আর্টিফিশিয়াল পাথরেই বুঁদ হয়ে আছে। সেই তুলনায় বই; সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, পুরাণ কিংবা যে ধরনেরই হোক; সেখানে পরশ পাথর সহজলভ্য। যারা মনে করেন, সাহিত্য মানুষকে কেবল গল্প-কবিতা-উপন্যাস ইত্যাদি ভাব-কল্পনার জগৎকে উপহার দেয়মাত্র, তারা জানেনই না যেÑ আমাদের দেশে যত মানুষ বিজ্ঞান পড়ে বিজ্ঞানমনস্ক হয়, তার চেয়ে বহুগুণ মানুষ সাহিত্য পাঠ ও চর্চার মাধ্যমে বিজ্ঞানমনস্কতাকে জীবনের পাথেয় করে নেয়। এবং একমাত্র সাহিত্যের ভেতরেই আছে মানুষের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-সামাজিকতা বিজ্ঞানচেতনা ও মানবিক মূল্যবোধের ধারাবাহিক বিবৃতি ও বোধের বিবিধ সূত্রাবলি। 
 
৫.
আলোচনার ইতি টানতে হবে। কিন্তু যেকোনো সংকটের আলোচনা শেষে নাকি সমাধানের পথ বাতলে দিতে হয়। কিন্তু সাহিত্যের সংকটের এই বিষয়টির আশু কোনো সমাধানের পথ আছে কি? আশাবাদী মানুষেরা বলবেন—সমস্যা যখন আছে, সমাধানও আছে নিশ্চয়ই। আমার বুদ্ধিতেও হয়তো সমাধানের দু-একটা সূত্র উঠে আসতে পারে, কিন্তু গ্রহণ করবেন কে? এখন তো সন্তানের জিপিএ-৫, সেরা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা, উন্নত দেশের স্কলারশিপ আর উচ্চতর বেতনের চাকরি পাওয়ার পরামর্শ ব্যতীত আর কোনো পরামর্শ কেউ শুনতে চান না। আর ছেলেমেয়ে? আমি যদি ‘আম আটির ভেঁপু’ পড়ুয়া স্কুলগামীদের বলি—বাবারা, ‘পথের পাঁচালী’টা একটু পড়ে নাও, তাহলে ওই সময়ের শৈশবটাকে সহজেই বুঝতে পারবে; কিংবা কলেজ পড়ুয়াদের বলি— ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’টা একটু সময় করে পড়ে নিও, মুক্তিযুদ্ধে মানুষের আত্মত্যাগের একটা স্বরূপ বুঝতে পারবে। আমার পরামর্শ কেউ কি নেবে? আমাদের শিক্ষকরাও তো এখন আর বই পড়তে চান না, অন্য পেশার লোকদের কথা কী বলব? আমার কাছে মনে হয়, এখন মূলত লেখকই পাঠক, পাঠকই লেখক। ভালো লেখকরা চিরকালই ভালো পাঠক ছিলেন, কিন্তু লেখকদের বাইরেও তো ছিলেন বিরাট পাঠক-সমাজ। তারাই এখন ‘নেই’ হয়ে যাচ্ছেন। ফলে আশাবাদের জায়গাটাও সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর হচ্ছে ক্রমশ। সেই সংকীর্ণ টানেলের ভেতর দিয়ে কোনো আলোর রেখা ফুটবে কি? অনেকেই হয়তো বলবেন, এই ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তির যুগে বই কে পড়বে? কেউ কেউ এটাকে পশ্চাদ্গামিতাও বলতে পারেন। কিন্তু একটি কথা স্মরণ করিয়ে দিই, যারা আমাদের থেকেও তথ্যপ্রযুক্তিতে অগ্রগামী, তাদের অনেকেই এখনো বই পড়ছেন। ২০২০ সালে করোনা মহামারির ভেতরেও বিশ্বে ১৪.৮ বিলিয়ন ডলারের বই বিক্রি হয়েছে, যার মধ্যে ৯০ শতাংশই কাগজের বই। আমাদেরই প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত এখনো বই পড়ায় অনেক ওপরে অবস্থান করছে। কানাডা, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি উন্নততর দেশগুলোতেও প্রচুর মানুষ বই পড়ছেন এখনো। আমাদের দেশের টিনএজড তরুণরা এখন ফেসবুক-ইউটিউবসহ নানা রকমের ভার্চুয়াল গতির জাদুতে এমন আসক্ত যে, বই পড়ার মতো বিষয়টি তাদের কাছে নিদারুণ বিরক্তিকর বলে মনে হয়। কিন্তু সবার কাছে কি তাই? না। এখনো কিছু ছেলেমেয়ে নিশ্চয়ই আছে, যারা বই পড়ে, পড়তে চায়। সেই সংখ্যাটা যাতে আর না কমে, বরং বাড়ে, সেই চেষ্টাটা আমাদের করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির এই অবাধ প্রবাহের যুগে দরজায় খিল এঁটে ঘরে বসে থাকলেও তো কোনো কিছু থেকে দূরে থাকা সম্ভব নয়। সেই চেষ্টা করতে চাওয়াও নির্বুদ্ধিতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশমাত্র। আমাদের বরং তথ্যপ্রযুক্তিকে সঙ্গে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। তবে এর জন্য চাই সবার সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন। সারা দিন ধরে যেমন সিলেবাসের বই কেউ পড়ে না, তেমনি অবসর পেলেই সবাই বই পড়বে এমনটা আশা করা যায় না। কিন্তু পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং রাষ্ট্রীয় সুষ্ঠু পরিকল্পনা থাকলে এবং তা বাস্তবায়নে যথেষ্ট পদক্ষেপ থাকলে বোধকরি বইপড়ার প্রতি নতুন প্রজন্মকে অধিকতর আগ্রহী করা যেতে পারে। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠলে সাহিত্যের বই এমনিতে পড়বে। কেবল অর্থ-বিত্ত-প্রতিপত্তি নয়, যথার্থ মানুষ হয়ে উঠতে চাইলে অন্য সবকিছুর মতো বইপড়াটাও যে একটি অতি আবশ্যক কাজ, সেটা আমাদের বুঝতে হবে। বোঝাতে হবে। আর অধিক মানুষ যদি বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন, বইয়েরও মানেরও যে আরও উন্নতি হবে, এটা বলাই বাহুল্য। আর হ্যাঁ, শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য কিন্তু মনুষ্যত্বের বিকাশসাধন। শুধু সিলেবাসের বই পড়ে আর ততোধিক গাইড বই মুখস্থ করে মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ হয় না, মনুষ্যত্বের বিকাশের জন্য চাই শিল্প-সংস্কৃতি-ইতিহাস-বিজ্ঞান-পুরাণ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের বই পড়া। বইয়ের পাঠক বাড়লে সাহিত্যেরও সম্ভাবনা বাড়বে।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

Link copied!