মাত্র পাঁচ দিনেই উল্টে গেল গণেশ। পিতাকে স্বাধীনতা পুরস্কার এনে দিতে উপসচিব মো. আছাদুজ্জামানের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা পণ্ড হয়ে গেল মাত্র পাঁচ দিনেই। গত ১৪ মার্চ এবছরের জন্য ঘোষিত স্বাধীনতা পুরস্কারের তালিকায় নাম ছিল মো. আমির হামজার। তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছিলেন সাহিত্যে অবদানের জন্য। ১৮ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তার নাম বাদ দিয়ে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে। এবছরের স্বাধীনতা পুরস্কার ঘোষণা পর্যন্ত আমির হামজার নাম কেউই জানতেন না। কিন্তু মাত্র পাঁচ দিনে বাংলাদেশের প্রায় সবাই জেনে গেছেন তার নাম। তবে সাহিত্যিক হিসেবে নয়, অতীতের নানা কর্মকাণ্ড এবং সন্তানের অতি চালাকিতেই সমালোচিত হয়েছেন মরহুম আমির হামজা।
স্বাধীনতা পুরস্কারে আমির হামজার নাম অন্তর্ভুক্তি এবং বাতিল, দুটিই হয়েছে এক পৃষ্ঠার ছোট্ট প্রজ্ঞাপনে। কেন তাকে সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হলো, আবার কেন বাতিল করা হলো; তার কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। পুরস্কার দেয়ার ব্যাখ্যা না হলেও বাতিলের ব্যাখ্যাটা জরুরি ছিল। বছরজুড়ে নানান প্রক্রিয়ায় খুঁজে পেতে যাকে পুরস্কার দেয়া হলো, মাত্র পাঁচ দিনেই কেন তা বাতিল করতে হলো, তা জানার অধিকার জনগণের আছে। মাঝের পাঁচ দিনে আমির হামজাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর গণমাধ্যমে রীতিমত তোলপাড় হয়েছে। ফেসবুক আর গণমাধ্যম কী বললো, সেটা বিবেচনায় নিয়ে নিশ্চয়ই স্বাধীনতা পুরস্কার গ্রহণ-বর্জন করা হয় না, হওয়া উচিতও নয়। আমরা বরং দেখি মরহুম আমির হামজার আলোচিত অযোগ্যতাগুলো। স্বাধীনতা পুরস্কার ঘোষণার পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় নাগরিক কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের কেউই তাকে চেনেন না। কিন্তু নাগরিক বুদ্ধিজীবীদের না চেনা তো একজন মানুষের অযোগ্যতা হতে পারে না।
এরপরের আলোচনা হলো, আমির হামজার প্রকাশিত তিনটি বইয়ের অধিকাংশ কবিতাই বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা, শেখ হাসিনা, বর্তমান সরকারের উন্নয়ন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা। এটাও কোনো সাহিত্যিকের যোগ্যতা বা অযোগ্যতা হতে পারে না। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে উচ্চ মানের কবিতা-গান লিখলে যে কেউ স্বাধীনতা পুরস্কার পেতেই পারেন। প্রকাশিত বইয়ে না থাকলেও এখন জানা যাচ্ছে, আমির হামজা বিএনপির সাথে ঘনিষ্ঠ ছিলেন, জিয়াউর রহমানকে নিয়েও তিনি কবিতা-গান লিখেছিলেন। জিয়াউর রহমানকে নিয়ে কবিতা-গান লেখাটা নিশ্চয়ই কোনো লেখকের অযোগ্যতা নয়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখলে জিয়াউর রহমানকে নিয়ে লেখা যাবে না, এমন কোনো কথা নেই। এখন জানা যাচ্ছে, আমির হামজা একটি খুনের মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হিসেবে ৮/৯ বছর কারাগারে ছিলেন। পরে বিএনপি নেতা মজিদ-উল হকের তদবিরে তিনি ছাড়া পান।
পুরস্কার দেয়ার আগেই তো কমিটির এটা যাচাই করা উচিত ছিল। বাংলাদেশের পুলিশ ভ্যারিফিকেশন বলে একটা বিষয় আছে। পাসপোর্ট, এনআইডি, চাকরি, পুরস্কার— সবকিছু পেতে হলে পুলিশ ভ্যারিফিকেশন লাগে, যাতে একজন ব্যক্তির অতীত যাচাই করা হয়। আমির হামজাকে পুরস্কার দেয়ার আগে কি সেটা করা হয়নি? না হলে কেন হয়নি, গাফিলতিটা কার? হলে, কারা পুলিশ ভ্যারিফিকেশন করেছে? তাদেরও দায় নিতে হবে। তবে এই মামলা-দণ্ড বিষয়েও আমি আমির হামজাকে বেনিফিট অব ডাউট দেবো। হতে পারে মামলাটি উদ্দেশ্য প্রণোদিত। আর পুরস্কারটি যেহেতু সাহিত্যে, তাই তিনি যদি সত্যি সত্যি অতি উন্নতমানের সাহিত্যিক হন, ব্যক্তিগত অন্য সবকিছু ছাড় দিয়ে হলেও আমি তার পক্ষে থাকবো। কিন্তু পুরস্কার কমিটির কেউ কি পুরস্কার দেয়ার আগে বা বাদ দেয়ার আগে তার কোনো বই পড়েছেন? মনে হয় না। আমি যেটুকু পড়েছি, তাতে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, আমির হামজা গ্রামের একজন স্বভাব কবি। কিন্তু তার লেখায় দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কার তো নয়ই, সাহিত্যে কোনো পুরস্কার পাওয়ার মতো সাহিত্য মান নেই। তাহলে আমির হামজাকে পুরস্কার দিয়ে আবার তা বাতিল করার কারণ কি? নাগরিক বুদ্ধিজীবীদের কাছে অচেনা, অতি নিম্নমানের সাহিত্য রচয়িতা, খুনের অভিযোগে দণ্ডভোগ, নাকি জিয়াউর রহমানকে নিয়ে কবিতা লেখা? কারণ যাই হোক, সেটা জনগণকে জানানো উচিত ছিল।
যে কারণেই হোক, আমির হামজার পুরস্কার বাতিল হয়েছে। কিন্তু ছোট্ট একটা প্রজ্ঞাপনে বাতিলেই বিষয়টি শেষ হয়ে যাওয়া উচিত নয়। যারা স্বাধীনতা পুরস্কারের মতো সর্বোচ্চ সম্মানের পুরস্কারটিকে বারবার হাস্যকর করে তুলছেন; সময় এসেছে তাদের খুঁজে বের করার এবং জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করার। মাত্র দুই বছর আগে সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার নিয়ে একই কেলেঙ্কারি হয়েছিল। ২০২০ সালে সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছিলেন এস এম রইজ উদ্দিন। তুমুল সমালোচনার মুখে সেটিও বাতিল করা হয়েছিল। ভুল থেকে মানুষ শিক্ষা নেয়। কিন্তু মাত্র এক বছর বিরতিতেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি কীভাবে ঘটলো, তা খতিয়ে দেখা এখন সময়ের দাবি।
স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়ার কমিটি খুবই উচ্চমর্যাদার। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীকে প্রধান করে গঠিত কমিটিতে মন্ত্রিসভার ১৩ জন সদস্য আছেন। আছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ১০ জন সচিব। এমন উচ্চপর্যায়ের কমিটি বারবার একই ভুল কীভাবে করতে পারে। আসলে পুরস্কারের বাছাই প্রক্রিয়াতেই বড় রকমের গলদ রয়ে গেছে। বিদ্যমান প্রক্রিয়ায় তিন শ্রেণির ব্যক্তি স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দিতে পারেন। ১. স্বাধীনতা পুরস্কার যারা পেয়েছেন, ২. বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান, ৩. বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব। প্রাথমিক মনোনয়নের পর মন্ত্রিপরিষদ যাচাই বাছাই করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটির কাছে পাঠায়। সেই কমিটি সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করে, মূল কমিটি যেখান থেকে যোগ্যতম ব্যক্তিকে বেছে নেন। কিন্তু রইজ উদ্দিন ও আমির হামজা কেলেঙ্কারির পর বোঝা যাচ্ছে পুরস্কার দেয়ার পুরো প্রক্রিয়াটি এখন আমলানির্ভর হয়ে গেছে। এস এম রইজ উদ্দিন নিজেই সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। আর সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য রইজ উদ্দিনের নামটি প্রস্তাব করেছিল ভূমি মন্ত্রণালয়। আমির হামজা নিজে সরকারি কর্মকর্তা না হলেও তার ‘যোগ্য সন্তান’ মো. আছাদুজ্জামান পিতার জন্য আবেদন করেছিলেন, যাতে সুপারিশ করেছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব। ব্যাপারটি কি তাহলে এভাবেই চলবে, আমলারা সুপারিশ করবেন আর যাচাই বাছাই ছাড়া কমিটি পুরস্কার দিয়ে হাস্যরস সৃষ্টি করবে।
আগের লেখায়ও বলেছি, পুরো ঘটনায় আমির হামজার কোনো দায় নেই। পিতার অতীত কর্মকাণ্ডে দণ্ডের তথ্য গোপন ছাড়া আছাদুজ্জমানের তেমন দায় দেখি না। একজন সন্তানের কাছে তার পিতার লেখাই শ্রেষ্ঠ মনে হতে পারে। একজন সন্তান তার পিতাকে সম্মানিত করার চেষ্টা করতেই পারেন। কিন্তু একজন চাইল, আর কমিটি দিয়ে দিল; বিষয়টা অত সহজ হওয়া উচিত নয়। এই কেলেঙ্কারির দায় পুরোটাই নিতে হবে জাতীয় পুরস্কার সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিকে। কেউ আবেদন বা সুপারিশ করলেই কি কমিটি যাচাই বাছাই ছাড়া যে কাউকে পুরস্কার দিয়ে দেবেন? কমিটির ১৩ মন্ত্রী এবং ১০ আমলার সবাই নিজ নিজ কাজের ক্ষেত্রে যোগ্য হতে পারেন। কিন্তু বিনয়ের সাথে বলতে চাই আমির হামজা শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক না শহীদুল জহির; এটা যাচাই করার যোগ্যতা তাদের কারো নেই। কেচো খুঁড়তে গিয়ে এখন অজগর বেরিয়ে আসছে।
উপসচিব পদমর্যাদায় খুলনা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বে থাকা আছাদুজ্জামান তথ্য গোপন করে পিতাকে স্বাধীনতা পুরস্কার পাইয়ে দিয়েছিলেন। এখন প্রশ্ন উঠছে, তাহলে আছাদুজ্জামান সরকারি চাকরি পাওয়ার সময়ও নিশ্চয়ই পিতার দণ্ডের তথ্য গোপন করেছিলেন। তার মানে আছাদুজ্জামান দুইবার তথ্য গোপন করেছেন; একবার নিজের চাকরির সময়, একবার পিতার পুরস্কারের জন্য আবেদনের সময়। দুইবারই নিশ্চয়ই পুলিশ ভ্যারিফিকেশন হয়েছে। আছাদুজ্জামানের চাকরি এবং তার পিতার পুরস্কারপ্রাপ্তি বাংলাদেশে পুলিশ ভ্যারিফিকেশ প্রক্রিয়াকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিল।
তবে সময় এসেছে বাংলাদেশে পদক-পুরস্কার প্রদানের প্রক্রিয়াটি বদলে ফেলার। প্রতিটি পুরস্কারের জন্যই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা তার পক্ষে কাউকে আবেদন করতে হয়। তাহলে তো নিভৃতচারী কোনো নির্মোহ লেখক কখনোই পুরস্কার পাবেন না। সত্যিকারের যোগ্য লোককে সম্মানিত করতে হলে রাষ্ট্রকেই তাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব নিতে হবে। কেউ পুরস্কারের জন্য আবেদন করেছে, এটা শোনার সাথে সাথেই তো আমার তাকে অযোগ্য মনে হয়। আমি দাবি জানাচ্ছি, নিজ থেকে বা তার পক্ষে আবেদন করার অসম্মানজনক পদ্ধতিটি এখনই বাতিল করা হোক। সত্যিকারের যোগ্য কোনো লেখক কখনোই আবেদন করে পুরস্কার নেবেন না। কারণ আত্মসম্মানটাও লেখক-সাহিত্যিকের একটা বড় যোগ্যতা। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, জীবনানন্দ দাশ, আখতারুজ্জমান ইলিয়াস বা শওকত আলীর পক্ষে কেউ আবেদন না করলে তারা কখনোই বাংলাদেশে কোনো পদক-পুরস্কার পাবেন না। শহীদুল জহির সরকারি আমলা হলেও তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন কথাসাহিত্যিক। তিনি নিজে আমলা হলেও ছিলেন আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন একজন সত্যিকারের লেখক। বেঁচে থাকতে তিনি কখনো পুরস্কারের জন্য আবেদন করেননি। মৃত্যুর পরও তার হয়ে আবেদন করবেন, এমন কেউ নেই। তাহলে কি যোগ্যরা কখনো পুরস্কার পাবে না। বারবার বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক বা স্বাধীনতা পুরস্কার ঘোষণার পর প্রতিবারই বিতর্ক হবে।
আমার প্রস্তাব হলো, জাতীয় পদক বা পুরস্কারের জন্য যোগ্য লোকদের খুঁজে বের করতে সংশ্লিষ্ট শাখায় যোগ্য তিনজনের সমন্বয়ে একটি উপকমিটি গঠন করা হোক। এ ক্ষেত্রে যারা ইতিমধ্যে পুরস্কার পেয়েছেন, তাদেরই উপকমিটিতে রাখা যেতে পারে, যাতে স্বার্থের সংঘাত এড়ানো যায়। যেমন আগেই স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন এমন তিনজন সাহিত্যিক সে বছরের জন্য যোগ্য সাহিত্যিক খুঁজে বের করবেন। আর আবেদন করার অমর্যাদাকর প্রক্রিয়া বাতিল করতে হবে। উপকিমিটির বাছাই করে দেয়া সংক্ষিপ্ত তালিকা থেকে মন্ত্রিসভা কমিটি যোগ্য লোককে পুরস্কৃত করবে।
রইজ উদ্দিন ও আমির হামজা কেলেঙ্কারি থেকে যেন আমরা শিক্ষা নিই। আমরা যেন এই কেলেঙ্কারির জন্য দায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনি। যেন ভবিষ্যতে জাতীয় পুরস্কার নিয়ে আর কোনো বিতর্ক না হয়। সম্মানিত করতে গিয়ে আমরা যেন কাউকে অসম্মান না করি।
লেখক: সাংবাদিক