• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিসংখ্যান নিয়ে ব্যস্ততা, নিত্যপণ্যে অস্থিরতা


কবির য়াহমদ
প্রকাশিত: মে ১৫, ২০২২, ০৯:১৩ পিএম
পরিসংখ্যান নিয়ে ব্যস্ততা, নিত্যপণ্যে অস্থিরতা

নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি যখন চরমে তখন আমাদেরকে শোনানো হলো আগের চাইতে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। একজন শ্রমিক একদিনের মজুরির টাকায় ১২-১৫ কেজি চাল নিয়েও ঘরে ফিরতে পারেন এমনটাও শুনিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী। মাথাপিছু আয় বেড়েছে এমন প্রচারণা অনেক দিন থেকেই। রিজার্ভ বাড়ার তথ্যও শোনানো হয়েছে-হচ্ছে বারবার, জিডিপি-রিজার্ভ সেগুলোও মুখস্থ বুলি। এসব বলতে দিন-তারিখ উল্লেখ করে এখন কাউকে উদ্ধৃত করতে হয় না, মন্ত্রীদের উদ্ধৃত করে গণমাধ্যম নিত্যদিন সেই বক্তব্য প্রচার করে আসছে। মানুষ শুনছে সে সব, এ নিয়ে তাদের প্রশ্ন নেই, উত্তর নেই। তবে যে ভোগান্তি তাদের সেটা ব্যক্তি পর্যায়ে সকলের, সমষ্টি হয়ে প্রতিবাদের সুযোগ নেই, আগ্রহও নেই।

গত ১০ মে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান একনেক পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাব অনুযায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৪১ হাজার ৪৭০ টাকা বা ২ হাজার ৮১৪ মার্কিন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ২ লাখ ১৯ হাজার ৭৩৮ টাকা বা ২ হাজার ৫৯১ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ গতবছরের চাইতে মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ২৩৪ ডলার, টাকার হিসাবে যা ২০ হাজার টাকা বেশি। মাথাপিছু আয়ের এই যে হিসাব সেটাকে অনেকেই শুভঙ্করের ফাঁকি বলতে চান। এই আয়ের হিসাবের সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিজীবনের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া কঠিন। বৈষম্যের সমাজে দেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে যাওয়া মানে সকলের আয় বেড়ে গেছে এমন ভাবারও কারণ নাই, কারণ এটা পুরো দেশের মানুষের আয়ের গড় হিসাব। কোটিপতি আর প্রান্তিক চাষি থেকে শুরু করে সকল মানুষের আয়কে যোগ করে তার একটা গড় হিসাবই এই মাথাপিছু আয়।

মাথাপিছু আয় কিংবা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হিসাব মূলত সংখ্যার খেলা। এনিয়ে আগে থেকেই আলোচনা আছে, সন্দেহ আছে। আগের মতো এখনও অনেক অর্থনীতিবিদ এনিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। দুইবছর আগে একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে আলাপকালে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাবেক সচিব রীতি ইব্রাহীম জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে বলেছেন, ‘‘আমি তরুণ বয়সে দেখেছি, জিডিপি কত হবে, তা আগে ঠিক করা হয়। পরে ‘ব্যাক ক্যালকুলেশন’ করে হিসাব ঠিক করা হয়। এটা আগে ছিল। তবে আমি যে কয়েক বছর দায়িত্বে ছিলাম, তখন আমি এই ধরনের কাজ করতে দিইনি। বিশেষ করে আদমশুমারির সময় আমি নির্দেশ দিয়েছি, কোনো ইরেজার (ঘষামাজা করতে ব্যবহৃত) ব্যবহার করা যাবে না। মাঠপর্যায়ে যেসব তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাবে, তাই ব্যবহার করতে হবে। আমি বুঝি না, জিডিপি নিয়ে এত প্রভাব খাটানো হয় কেন? জিডিপিই সবকিছু নয়।’’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি বলছি না, বিবিএসের কোনো দুর্বলতা নেই। সংস্থাটির দুর্বলতা অবশ্যই আছে। সেখানে পরিসংখ্যান থেকে পাস করা লোক খুবই কম। সবচেয়ে বড় কথা, যারা বিবিএসকে পরামর্শ (গাইড) দেবেন, সেই মানের পরিসংখ্যানবিদ নেই। পরামর্শদাতারা সবাই প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। তাই বিবিএসকে পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট দুর্বলতা আছে। আবার মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতিতেও দুর্বলতা আছে।’

সচিব কিংবা দায়িত্বশীলরা সাবেক হয়ে যাওয়ার পর এধরনের তথ্যগুলো বের হয়ে আসে মূলত, তবে সাবেক হোন আর বর্তমান হোন এটা যে আমাদের সামগ্রিক অবস্থার একটা চিত্র তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সদ্যপ্রকাশিত মাথাপিছু আয়ের তথ্যের স্বপক্ষে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেছেন, ‘জনগণের মাথাপিছু আয় ঠিকই আছে। বর্তমান বাজারের সঙ্গে মাথাপিছু আয়ের সংগতি রয়েছে। মানুষের আয় বাড়ছে। আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় এবারের ঈদে বেচাকেনা বেশি হয়েছে। মানুষ আনন্দ নিয়ে বাজার করেছেন। এখন গ্রামের মানুষের হাতে মুঠোফোন আছে, কেউ খালি পায়ে নেই। গ্রামে ধান কাটার মৌসুমে এক হাজার টাকা মজুরিতেও শ্রমিক পাওয়া যায় না।’

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান একনেকের বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘মানুষের কেনাকাটা অনেক বেড়েছে। গ্রামে গেলেই দেখা যায়, মানুষ কেনাকাটা করছে। তার মানে মানুষের আয় বেড়েছে। হতে পারে কারো কম বেড়েছে কিংবা কারো বেশি। তবে আয় বেড়েছে।’ মন্ত্রীদ্বয়ের এই বক্তব্যে কি প্রান্তিক মানুষের চিত্র ফুটে ওঠে? বাস্তবতা বলছে—‘না’!

‘ব্যাক ক্যালকুলেশনে’ হোক বা সঠিক হিসাবেই হোক মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির এই তথ্য মানুষকে কি স্বস্তি দিতে পারছে? রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে না ভাবলেও বলতে হয়—পারছে না! কিছুদিন আগের টিসিবির ট্রাকের পেছনের মানুষের দীর্ঘ লাইন, কম দামে পণ্য পেতে জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেও ট্রাকের পেছনে ঝুলতে থাকা মানুষের সেই চিত্রটা তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। ‘ভাতের বিনিময়ে টিউশনির’ সেই বিজ্ঞাপনটা কি বিস্মৃত হয়েছি আমরা? আবার এও ঠিক উত্তরের সেই মঙ্গা এখন নেই, খাদ্যের অভাবে মানুষের মৃত্যুর তথ্যও নেই; কিন্তু তাই বলে মানুষ স্বস্তিতে পেট ভরে খেতে পারছে নিত্য এমনও ভাবা একপ্রকার বাড়াবাড়ি। গ্রামপ্রধান বাংলাদেশে গ্রামের মানুষের আর্থিক অবস্থার খবর মিলছে সামান্যই, যেটুকু আসছে তার অধিকাংশই শহুরে মানুষদের একাংশ। শহরে কাজ কিছু হয়তো আছে, গ্রামে সে তুলনায় কাজের অভাব রয়েছে। বলা হচ্ছে কৃষিশ্রমিকের অভাবের কথা। ধানের চাষ ও ধান তোলার সময়ে একসঙ্গে অনেক লোকের দরকার যেখানে সেখানে কিছু ক্ষেত্রে মৌসুমি শ্রমিকের অভাব থাকাটাই তো স্বাভাবিক। এই কাজ আবার সারাবছরের নয়, মৌসুমি কাজ; মৌসুম শেষ, কাজও শেষ! করোনার কারণে দেশে ভিক্ষুকের সংখ্যা বেড়েছে, কর্মহীনের সংখ্যা বেড়েছে, আয় কমেছে বেশিরভাগ মানুষের, বেড়েছে পরনির্ভরশীলতা। এখানে ঈদে মানুষের কেনাকাটা নিয়ে যে তথ্য, মানুষের হাতে-হাতে মোবাইল, পায়ে-পায়ে জুতা দেখার যে বক্তব্য সেটাকে তাই বাগাড়ম্বর ভাবা ছাড়া উপায় কী!

সরকার মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি আর জিডিপি প্রবৃদ্ধির গল্প শোনাচ্ছে, আর ওদিকে নিত্যপণ্য চলে গেছে মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রবৃদ্ধির গল্পে বুঁদ সরকারের মধ্যে বাজার ব্যবস্থাপনার ঘাটতির সুযোগ নিয়েছে ব্যবসায়ী ও মজুতদাররা। ফলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিকে তাই বাজার ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার কথা স্বীকার করতে হয়েছে। ব্যবসায়ীদের হাতে বাজারকে ছেড়ে দেওয়ার খেসারৎ দিতে হচ্ছে ভোক্তাসাধারণকে। মন্ত্রীর বোধোদয় যখন হলো তখন বড় বেশি দেরি হয়ে গেছে। এরআগেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে। গণমাধ্যমে প্রায়ই আসে চাল, চিনি, সয়াবিন আর পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির তথ্য। দাম বাড়ার পর সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হয় নানা উদ্যোগের কথা। কিন্তু এরবাইরে যে পণ্যগুলো মানুষের নিত্যব্যবহার্য সেগুলোকে স্বস্তিদায়ক অবস্থার মধ্যে আছে? কোনোটিই নেই; একটাও পণ্য নেই যার দাম গত ক’বছরে বাড়েনি।

বাজারব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় ফিরতে হবে সরকারকে। নির্দিষ্ট কয়েকটি পণ্য দিয়ে চলা যায় না, সকল পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে সামগ্রিক বাজার ব্যবস্থাপনায় নজর দিতে হবে। পণ্যের দরদাম কী প্রক্রিয়ায় বাড়বে-কমবে তা নিয়ে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি বাজারব্যবস্থাকে সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং আইনানুগ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষকে সংবাদ হওয়ার এবং সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার মতো প্রতীকী অভিযানের চাইতে নিয়মিত অভিযানের দিকে নজর দিতে হবে।

দেশে ভিক্ষুক নেই, দেশে দুস্থ লোক নেই, মানুষের আয় বেড়েছে, মানুষ ঠিকঠাক বাজার করতে পারছে, হাতে মোবাইল রাখছে, পায়ে জুতা পরছে—এধরনের বক্তব্য নেতা-মন্ত্রী-সাংসদ-আমলাদের মুখ থেকে যখনই আসে তখন মানুষ বিব্রত হয়, ক্ষুব্ধ হয়। সম্মিলিত প্রতিবাদ না করলেও ব্যক্তিগতভাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। এই প্রতিক্রিয়া প্রান্ত থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছায় না হয়তো তবু এই প্রতিক্রিয়ার মূল্য আছে, শক্তি আছে। মানুষের এই প্রতিক্রিয়া, এই শক্তিকে গুরুত্ব দিন, বাজার-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করুন!

 

লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

Link copied!