• ঢাকা
  • রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পদ্মা সেতু: তবু মাথা নোয়াবার নয়


প্রভাষ আমিন
প্রকাশিত: জুন ১৬, ২০২২, ১১:১৪ এএম
পদ্মা সেতু: তবু মাথা নোয়াবার নয়

পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মো. আব্দুল কাদের। ২০০৯ সালে তিনি পদ্মা সেতু প্রকল্পে যোগ দিয়েছিলেন। ২০১০ সালে তিনি বিয়ে করেন। কিন্তু বিয়ের পর তাকে কিছুটা বিপাকেই পড়তে হয়। নতুন কারও সঙ্গে পরিচয় হলে তিনি নিজের পরিচয় দিতে পদ্মা সেতু প্রকল্পে কাজ করার কথা উল্লেখ করতেন। সবাই তাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করত, যে সেতু কোনো দিন হবে না, সেই সেতুতে কাজ করেন। এমনকি নবপরীণিতা স্ত্রীও একপর্যায়ে তাকে পদ্মা সেতুর পরিচয় না দিতে বলেন। দেওয়ান কাদেরের মন খারাপ হতো, অপমানিত বোধ করতেন। ২০০৯ থেকে ২০২২, এই ১৩ বছরে পদ্মা নদীতে অনেক পানি গড়িয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র, পাল্টাপাল্টি অভিযোগ হয়েছে। বিশ্বব্যাংক ফিরে যাওয়ার পর একজন ছাড়া সবাই ভেবেছিল পদ্মা সেতু আর হচ্ছে না। সেই একজন শেখ হাসিনা। 

পদ্মা সেতু না হলে আগে যেমন চলছিল, তেমনই সব চলত। তবে দেশের একটা বড় ক্ষতি হতো। কারণ, বিশ্বব্যাংক ফিরে গিয়েছিল দুর্নীতির অভিযোগ এনে। যদিও কোনো টাকা ছাড় হওয়ার আগেই আনা দুর্নীতির অভিযোগ আদালতে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তারপরও সেতুটি না হলে দুর্নীতির অভিযোগটাই সবার মনে থাকত। আর বাংলাদেশকে সব সময় বিশ্বব্যাংকের খবরদারি মেনে চলতে হতো। কিন্তু শেখ হাসিনার মনে ছিল অন্য চিন্তা। তিনি ঘোষণা দিলেন, বিশ্বব্যাংক চলে গেলেও পদ্মা সেতু হবে এবং সেটা নিজেদের টাকায়। অনেকেই তখন চমকে গিয়েছিলেন। চমকের প্রথম কারণ, নিজেদের টাকায় আদৌ পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব কি না। দ্বিতীয় কারণ, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে পদ্মা সেতু না হয় বানানো গেল, তারপর কী হবে। কিন্তু সবার শঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু করার স্বপ্নের পথে যাত্রা শুরু করেন। সেই স্বপ্ন আজ দৃশ্যমান বাস্তবতা। 

পদ্মা সেতু না হলে কী হতো, সে আলোচনা এখন অবান্তর। পদ্মা সেতু হলে অর্থনীতির কতটা উন্নতি হবে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনমানের কতটা অগ্রগতি হবে; তা নিয়েও আমার ভাবনা নেই। তবে আমি বুঝি পদ্মা সেতু আমাদের মর্যাদা, সামর্থ্য আর সক্ষমতার প্রতীক। পদ্মার মতো খরস্রোতা নদীতে নিজেদের টাকায় সেতু বানিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংক এবং গোটা বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছে, ‘সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়/ জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার/ তবু মাথা নোয়াবার নয়।’

২০১৭ সালে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। তখন খালি পদ্মার বুকে এপাড়-ওপাড় দেখা যায় না। সেই পদ্মা সেতু এখন তৈরি, উদ্বোধনের অপেক্ষায়। গত রোববার সম্পূর্ণ পদ্মা সেতু দেখতে ঢাকা থেকে সাংবাদিকদের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আবার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়। এবার পদ্মার বুকে চাঁদের মতো বাঁকা এক সেতু সংযুক্ত করেছে দুই পাড়কে, অনেক স্বপ্নকে, অনেক সক্ষমতাকে। কাছ খেকে পদ্মা সেতু দেখার যে শিহরণ, তা আসলে ভাষা দিয়ে পুরো বোঝানো মুশকিল। একদিন পদ্মা সেতুতেও আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাব। পদ্মার বুকে হয়তো আরও সেতু হবে। কিন্তু কোনো আবেগই এই অনুভূতিকে ছুঁতে পারবে না। 

শুরুতে যে প্রকৌশলী দেওয়ান মো. আব্দুল কাদেরের কথা বলছিলাম, তিনিই জানালেন, এত দিন কেউ জানতে চাইলে বলতাম, ৩০ ভাগ কাজ বাকি আছে, ২০ ভাগ কাজ বাকি আছে, ১০ ভাগ কাজ বাকি আছে। আজ বলছি, পদ্মা সেতুর কাজ শূন্য ভাগ বাকি আছে। পদ্মা সেতু এখন তৈরি। এটা বলার সময় তার চেহারায় যে স্বস্তি, যে গর্ব, যে অহংকার দেখেছি; আমি নিশ্চিত শত অপমান, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ভুলে গেছেন তিনি। পদ্মা সেতুর সব কাজ শেষ হলেও তারা আরও এক বছর দায়িত্ব পালন করবেন। কোথাও কোনো সমস্যা হয় কি না, কোথাও পানি জমে কি না, যান চলাচলে কোনো অসুবিধা হয় কি না; তা পর্যবেক্ষণ করেই তারা দায়িত্ব শেষ করবেন। সেদিন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। ব্যয়, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা, পদ্মা সেতুর জটিল নির্মাণ কৌশলসহ অনেক প্রশ্নের উত্তর মিললেও কিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা পদ্মা সেতু নিয়ে সেই প্রশ্নগুলো রইল এখানে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের তারিখ ঘোষণার পর থেকেই প্রবাসী প্রকৌশলী সফিকুর রহমান অনু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রেল সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগে সড়ক সেতুর উদ্বোধন না করার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। তার যুক্তি হলো, ওপরে গাড়ি চললে নিচে রেল সেতুর নির্মাণকাজ ভালো হবে না। এই প্রশ্ন অবশ্য সেদিন করা হয়নি। প্রকৌশলী অনুর যুক্তিটা আমি ভালো বুঝিনি। তাই এর লাভক্ষতির হিসাবটাও জানি না। তবে আমার মনে হয়, এই পর্যায়ে এই প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। তবে আরেকটি অতি জরুরি প্রশ্ন করা হলেও, উত্তর মেলেনি। দুই প্রান্তে ওজন মাপার মেশিন না বসিয়েই উদ্বোধন হতে যাচ্ছে পদ্মা সেতুর। বাড়তি ওজনের কোনো যান যাতে সেতুতে উঠতে না পারে, সে জন্য এই মেশিনটা অতি জরুরি। সচিব জানিয়েছেন, ছয় মাসের মধ্যে মেশিনটি লাগানো হবে। কিন্তু এই ছয় মাস যদি বাড়তি ওজনের কোনো যান সেতু পারাপার করে, তবে তা সেতুর ওপর চাপ তৈরি করবে। এত স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিয়ে এই ঝুঁকিটা নেওয়া সংগত হয়নি।

তবে পদ্মা সেতু নিয়ে স্বপ্নমেদুরতার পাশাপাশি টোল নিয়েও কথা কম হয়নি। নিজেদের টাকায় হলেও পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় টোলের টাকা থেকেই তুলে আনতে হবে। তাই টোল নিয়ে কোনো আপত্তি নেই। কেউ কেউ আপত্তি করেছেন টোলের উচ্চহার নিয়ে। ফেরি ভাড়ার দেড় গুণ হারে সেতুর টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এই হার নিয়েও আমার আপত্তি নেই। কারণ, ফেরিঘাটের ঘণ্টার পর ঘণ্টার বসে থাকার যে ক্ষতি, দেড় গুণ টোল সেই তুলনায় কিছুই না। কিন্তু বাসের বাড়তি ভাড়া নির্ধারণে আমার প্রবল আপত্তি। টোল একটু বেশি লাগলেও ফেরিঘাটে যে বাড়তি সময় লাগত, সেটা বিবেচনায় নিলে ভাড়া বাড়ানোর কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তি নেই। আরেকটা বিষয়ও আলোচনার আড়ালে রয়ে গেছে। শুধু পদ্মা সেতুতে টোল দিলেই হবে না, টোল দিতে হবে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের জন্যও। একবার ভাবুন ঢাকা থেকে যদি আপনি পদ্মা সেতু পেরোতে চান তবে আপনাকে কয়বার টোল দিতে হবে। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে শুরু এরপর ধলেশ্বরীর দুই সেতুতে দুইবার, এক্সপ্রেসওয়েতে একবার, ফাইনালি পদ্মা সেতুর টোল। সব মিলে টোলের অঙ্কটা কম নয়। নিজের গাড়ি নিয়ে পদ্মা সেতু দেখতে যেতে চাইলেও কয়েক হাজার টাকা বাড়তি নিয়ে যেতে হবে। তবে টাকার অঙ্কের চেয়েও যেটা নিয়ে আমি শঙ্কিত, তা হলো গতি। এক্সপ্রেসওয়েতে যদি দফায় দফায় টোল দেওয়ার জন্য থামতেই হয়, তাহলে গতির সুবিধাটা মানুষ পাবে কীভাবে? ধলেশ্বরী সেতুতে যেভাবে গাড়ি থামিয়ে থামিয়ে টোল নেওয়া হয়, তা এই এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে বড্ড বেমানান। 

আরেকটা বড় শঙ্কা রয়ে গেছে যানজটের। এটা সত্যি, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে উঠলে হঠাৎ মনে হয় কোনো ভিনদেশে আছি। পদ্মা সেতু উদ্বোধন হওয়ার এই ৫৫ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে পেরোনো যাবে অল্প সময়েই। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলা ঢাকার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হবে। একসময় যে পদ্মা পাড়ি দিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হতো, এখন সেই পদ্মা পাড়ি দেওয়া যাবে ৬ মিনিটে। ১৯ জেলার গাড়ি এখন দ্রুতগতিতে পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে ঢাকায় আসবে। কিন্তু এই দ্রুতগতির গাড়িগুলো যখন মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার হয়ে ঢাকায় ঢুকতে চাইবে, তখন তাদের কতক্ষণ সময় লাগবে। এমনিতেই এখন হানিফ ফ্লাইওভারে যানজট হয়। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর অবস্থা কী দাঁড়াবে, সেটা ভেবে আমি এখনই শঙ্কিত। সেই যানজটের প্রভাব ছড়িয়ে যেতে পারে ঢাকা শহরেও। এই ব্যাপারে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে পদ্মা সেতু আর এক্সপ্রেসওয়ের গতিমুখ থুবড়ে পড়তে পারে ঢাকার মুখে এসে। 

পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ততায় হয়তো এসব ছোটখাটো বিষয় নীতিনির্ধারকদের নজর এড়িয়ে গেছে। তবে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের উৎসবমুখরতা সামনে রেখেও এই সব ছোটখাটো বাস্তবতাগুলো লিখে রাখলাম। নিশ্চয়ই এই দিকগুলোতেও দ্রুতই নজর দেওয়া হবে।

 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Link copied!