নারী কেবল রূপেই অনন্যা নয়, গুণেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে একধাপ এগিয়ে। তবু এই নারীই যখন অবলা, অসহায় রূপে মানবসমাজে পরিগণিত হয়, তখন মরমে মরে যেতে হয়! নারীরা কেন অন্যদের কাছ থেকে ‘অবলা তকমা’ পেয়ে সেটাকে কাজে লাগিয়ে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হতে চেষ্টা করবে!
নারীকে একইসঙ্গে পরিবার-পরিজন ও কর্মক্ষেত্র উভয়ই সামলাতে হয়। তবুও তার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় বারংবার! তাকে মানসিক শক্তিতে বলীয়ান করে তুলতে সচেষ্ট না হয়ে বরং তার গতির সব পথ রুদ্ধ করে দেয় পুরুষতন্ত্র। নারীকে কিছু বাড়তি সুবিধা দেওয়ার নামে তাকে বোঝানো হয়, ‘তোমরা পুরুষের চেয়ে মেধা-যোগ্যতায় পিছিয়ে!’ নারীরাও সেই টোপ গিলে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনে।
একটি পরিবারের দিকে যদি লক্ষ্য করা যায়, তাহলে নিশ্চিত দেখতে পাওয়া যায় ওই পরিবারের নারী সদস্যটি অনেক পরিশ্রম করেন। সন্তান লালন-পালন থেকে শুরু করে স্বামী, পরিজন সবার মুখে হাসি ফোটাতে দিন-রাত খেটে চলেন। তবুও দিন শেষে তার কাজের সঠিক মূল্যায়ন হয় না। এমনকি নারী যে কাজ করেছে, তাও অধিকাংশ পরিবারের সদস্যরা স্বীকার করে না।
পরিবারে নারীরা যে সময়টা ব্যয় করেন, সেটা যদি তারা বাইরে কাজে লাগাতেন, তবে সুনাম ও যোগ্যতার মূল্যায়ন দুই-ই হয়তো পেতেন। নারী কোথাও বাড়তি সুবিধা নিলে সেটা হবে তার প্রতি অন্যায়-অসম্মানজনক। যোগ্যতা ও দক্ষতা দিয়ে যেমন পরিবারকে আগলে রাখতে চেষ্টা করে নারী, তেমনি কর্মস্থল থেকে শুরু করে সর্বদাই যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রমাণ দেওয়া উচিত।
আর এখন শুধু ঘরের কাজকে প্রাধান্য দেয় না নারীরা, বরং জীবনযাত্রার মান ঠিক রাখতে পুরুষের পাশাপাশি তারাও দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। ফলে পুরুষের পাশাপাশি নিজেদের যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী কাজ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু নারীর প্রতি পুরুষের হীন-দৃষ্টি তাকে পেছনে ঠেলে দেয়। যোগ্যতা থাকলেও নারীরা সঠিকভাবে নিজেদের তুলে ধরতে পারছে না।
সমাজ বিভিন্ন শৃঙ্খল তৈরি করে নারীর জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে রেখেছে। কিন্তু পরিবার-সমাজের উচিত ছিল, নারীর প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা দেখিয়ে, তার যোগ্যতা কাজে লাগানোর পথে সহায়তা করা। পরিবার, সমাজ সবার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত।
নারীর যোগ্যতা ও দক্ষতার মূল্যায়ন পরিবার থেকেই হচ্ছে না। কিন্তু পরিবার, সমাজের দৃষ্টির পরিবর্তন ঘটানো দরকার। তাহলে পরিবারে নারীর কর্তৃত্বকে যেমন স্বীকার করা হবে, তেমনি সমাজেও নারীর অবস্থান শক্ত হবে।
সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলালে নারী ও তার কর্মের প্রতি শ্রদ্ধা আসবে। তাহলে নারীকে অবলা নয় বরং তার যোগ্যতা দিয়ে বিচার করা হবে।
গণপরিবহনের সিট থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ময়দান, কর্মক্ষেত্র, পরিবার, রাষ্ট্রে নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতার মাধ্যমে অবস্থান করে নেবে। সেখানে কোটা সুবিধার প্রয়োজন হবে না।
এক্ষেত্রে নারীর যোগ্যতাই তাকে সুফল ভোগ করতে সহোযোগিতা করবে। গণপরিবহনে নারী, শিশুর জন্য নয়টি সিট বরাদ্দ। কিন্তু নারী তো তার রাষ্ট্রীয় যোগ্যতা বলে স্বাধীন ও পুরুষের সমান অধিকারভুক্ত। তবে নারীর জন্য সেক্ষেত্রে কেন হাফ সিট দেওয়া হয় না। নারী কি তার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি সঠিকভাবে পাচ্ছে।
আবার রাজনৈতিক ময়দানেও নারীকে করে তোলা হচ্ছে অবহেলিত। তার জন্য কিছু সিট বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। তাহলে প্রশ্ন হলো নারী কি সেগুলো পাওয়ার যোগ্য নয়? যদি নারীর যোগ্যতা ও দক্ষতা না থাকে তবে কেন তার প্রতি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে নারীরা বিশেষ করুণমিশ্রিত সুবিধা ভোগ করবে। নারী তার আপন আলোকে আলোকিত হোক। পরিবার হোক বা রাজনৈতিক ময়দান নারী তার আপনার যোগ্যতা বলে স্থান করে নিক। কারও মুখাপেক্ষী হয়ে বা কারও পেছনে চরকির মতো ঘুরে নিজের অবস্থান না করুক। নারীর আত্মসম্মান গড়ে উঠুক। ‘বিনা যুদ্ধে নাহি’ নিক ‘সূচাগ্র মেদিনী’।
রাজনৈতিক ক্ষেত্র ছাড়াও কর্মক্ষেত্রেও নারীরা অবহেলিত। নারীর যোগ্যতা ও দক্ষতাকে মূল্যায়ন না করে নারীকে অবলা, অসহায় তকমা দিয়ে এগিয়ে নিতে তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদান করে রাষ্ট্র। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কিছু সুবিধা নারীর যোগ্যতাকে কি প্রশ্নবিদ্ধ করে না!
পুরুষতন্ত্র সর্বদা নারীকে বিভিন্নভাবে দমিয়ে রাখতে চায়। কখনো শারীরিক শক্তি দিয়ে কখনোবা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে! নারীকে কখনোই পুরুষের ওপরে অবস্থান দিতে নারাজ এ শ্রেণির ব্যক্তিবর্গ! ফলে নারীর যোগ্যতা ও দক্ষতার মূল্যায়ন তো দূরে থাক বরং অবমূল্যায়নই তাদের ভাগ্যে জোটে। নারীকে মানসিকভাবে প্রচণ্ড শক্তিশালী হতে হবে।
লেখক : গবেষক ও শিক্ষক, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়।