কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশন ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের ভাষায় নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত বিজয়ী হয়েছেন। বহিষ্কৃত বিএনপি নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুকে ৩৪৩ ভোটে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হন রিফাত। রিটার্নিং কর্মকর্তার ঘোষিত ফল অনুযায়ী, ১০৫ কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত পেয়েছেন ৫০ হাজার ৩১০ ভোট। বিদায়ী মেয়র সাক্কু টেবিল ঘড়ি প্রতীকে পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৯৬৭ ভোট।
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) হয়েছে এ ভোট গ্রহণ। ইভিএমে ধীরগতি ছাড়া আর কোনো অভিযোগ ওঠেনি। পরিবেশ নিয়েও ওঠেনি কোনো অভিযোগ। কেন্দ্র দখল করে ভোট দেওয়ার চিরায়ত যে অভিযোগ, সেটাও নেই এ নির্বাচনে। নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রথম ভোট নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের কোনো অভিযোগ না থাকায় বলা যায় প্রথম পরীক্ষায় পাস করেছে ইসি। এই পাস মার্ক তাদের ভোট গ্রহণ বিষয়েই কেবল, নির্বাচনের আগে-পরের পরিবেশ নিয়ে নয়। কারণ, নির্বাচনের আগে অনাহূত ঘটনায় উত্তাপ ছড়িয়েছিল, নির্বাচনের পর ফল ঘোষণার সময় কিছু বিশৃঙ্খলা হয়েছে। বিজিত প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর অভিযোগ, ফল ঘোষণা হয়েছে দখল করেই। এটা নিয়ে এখনই কিছু বলেনি নির্বাচন কমিশন। আশা করছি ইসি তাদের বক্তব্য দেবে।
নির্বাচনের ফল ঘোষণার সময়ের বিশৃঙ্খলা ছাড়া কুমিল্লা সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলা যায়। তবে এই নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন ও স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের মধ্যকার যে দ্বৈরথ হয়েছে, সেটা সুখের কিছু নয়। নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের কারণে কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্যকে প্রথমে সতর্ক করেছিল ইসি, এতে কাজ না হওয়ায় তাকে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দেয় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। এতেও কাজ হয়নি। ইসির চিঠির বৈধতার প্রসঙ্গ গেছে উচ্চ আদালতে। তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ তার প্রতিক্রিয়ায় ইসির নির্দেশকে একজন সংসদ সদস্যের ‘মৌলিক অধিকারের হস্তক্ষেপ’ বলেও মন্তব্য করেছেন। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘এভাবে তাকে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দিয়ে তার মৌলিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করা হয়েছে বলে আমি মনে করি। তিনি যাতে কোনো নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণা বা নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ না করেন, সেটির নির্দেশনা অবশ্যই থাকবে, থাকা বাঞ্ছনীয়। সেটি করলে অন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হতে পারে। কিন্তু যিনি ওখানে ভোটার ওই এলাকার সংসদ সদস্য, তাকে নিজের ভিটেবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলা কি সমীচীন হয়েছে, সেটিই হচ্ছে প্রশ্ন?’ মন্ত্রী এই আইনকে বৈষম্যমূলক মন্তব্য করে বলেছেন, ‘এলাকা ছেড়ে যেতে হবে এটি দুনিয়ার কোথাও নেই। সংসদ সদস্যরা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন না—এটি ভারতে নেই, পাকিস্তানে নেই, ইংল্যান্ডে নেই, কন্টিনেন্টাল ইউরোপে নেই, অস্ট্রেলিয়া, জাপানে নেই, কোথাও নেই। সেই আইনটাও কিন্তু বৈষম্যমূলক।’
সরকারি সুবিধাভোগীদের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেওয়াসংক্রান্ত যে বিধিনিষেধ, সেটা আইনবহির্ভূত নয়। এটা নিয়ে আগে এমন জল ঘোলা হয়নি। খোদ একজন আইনপ্রণেতা এই আইন মানেননি। নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেওয়ার কারণে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দেওয়ার পর সংসদ সদস্য এলাকা ছাড়েননি, ইসিও এরপর আর কিছু করতে পারেনি। এখানে নির্বাচন কমিশনের অসহায়ত্ব পরিষ্কার। দলীয় সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে একজন সংসদ সদস্যকেই নির্দেশনা মানাতে পারেনি নির্বাচন কমিশন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যখন দলীয় সরকারের অধীনে হবে তখন কী হবে অবস্থা—প্রশ্ন উঠেছে এমনই।
কুমিল্লা সিটি নির্বাচন, সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার ও নির্বাচন কমিশন নিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তাতে ইসি বেকায়দায়ই পড়েছে। নির্বাচন শেষ হওয়ার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজি হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘মাননীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের বিষয়টা আমার দৃষ্টিতে পাস্ট অ্যান্ড ক্লোজড।’ কেন, কীভাবে এ ঘটনা অতীত হয়? এই ইসির একমাত্র দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের কুমিল্লা সিটি নির্বাচনই নয়, আগামী পাঁচ বছরে সারা দেশে তাদের অনেকগুলো নির্বাচন করতে হবে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনও করতে হবে। যে প্রশ্নের জন্ম হয়েছে কুমিল্লায় তাকে ‘অতীত’ বলে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই তার। কুমিল্লার সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন বাহার ইসির নির্দেশ সত্ত্বেও এলাকায় অবস্থানই কেবল করেননি, তার এই অবস্থানের পক্ষে সরকারের মন্ত্রীরও সমর্থন পেয়েছেন। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা ঘটলে কী করবে ইসি? নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেওয়ার কারণে একজন সংসদ সদস্যকে ইসিকে কি এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দিতে পারে, চিঠির শব্দ ব্যবহারে কি আইনের বরখেলাপ হয়েছে কোন—এমনটাও খতিয়ে দেখার দরকার আছে।
বাহাউদ্দিন বাহার বলেছেন এই আইনের বিরুদ্ধে সংসদে কথা বলবেন, তথ্যমন্ত্রী এই আইনকে বৈষম্যমূলক বলেছেন। আমরাও চাই তারা এ নিয়ে সংসদে কথা বলুক, প্রয়োজনে আইনে সংশোধন-সংযোজন-বিয়োজন করুক, কিন্তু যতক্ষণ আইন আছে ততক্ষণ সে আইন মানতে তারা বাধ্য। আইন সংশোধনের আগে অন্য কোথাও স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচন হলে সেখানেও সরকারি সুবিধাভোগীরা বিধিনিষেধ মানতে বাধ্য। তাদের কাছ থেকে আমরা এ ক্ষেত্রে বিপ্লব চাই না, চাই আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন। কারণ, মন্ত্রীরা-এমপিরা আইন না মানলে অন্যদের আইন মানতে বলার মধ্যে নৈতিক শক্তি থাকে না।
কুমিল্লায় ইসির অসহায়ত্ব আমরা দেখেছি। এ ঘটনায় ইসির ক্ষমতার স্তর প্রকাশিত হয়েছে। তাদের দোষারোপ করছি আমরা। কিন্তু এই দোষারোপের সঙ্গে এ-ও মনে রাখা দরকার, সরকার চায়নি বলে সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন বাহার এলাকা ছাড়েননি। সরকার চাইলে তিনি ইসির চিঠি পাওয়ার পর উচ্চ আদালতে গেলেও তাকে এলাকা ছাড়তে হতো। এখানে সরকার ও সরকারি দল আওয়ামী লীগ ইসিকে যে বার্তা দিয়েছে, এটা সুখকর নয়। ইসিকে সরকার বোঝাল কিনা, তারা কতটা ক্ষমতাহীন! এই বার্তায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক প্রশ্নে কি কিছুটা হলেও গণভিত্তি দিল না?
লেখক : সাংবাদিক