• ঢাকা
  • রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আইভীর অনেক অর্জনের নির্বাচন


কবির য়াহমদ
প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৮, ২০২২, ০৭:২১ পিএম
আইভীর অনেক অর্জনের নির্বাচন

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বিজয়ী হয়েছেন। বিএনপি থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারকে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করেছেন তিনি। এ নিয়ে টানা তিনবার মেয়র হলেন আইভী। আইভীর এই বিজয় নানা কারণে আলোচিত। এই আলোচনা কেবল সরকারদলীয় একজন প্রার্থীর নির্বাচনী বিজয় হিসেবে সীমিত থাকছে না, নির্বাচনের আগের নানা ঘটনাপ্রবাহ বিশেষ করে স্থানীয় রাজনীতির কারণে। আলোচিত-সমালোচিত ও স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের সঙ্গে আইভীর বিরোধের কারণে নির্বাচন যতটা না আইভী-তৈমূরের লড়াই ছিল তারচেয়ে বেশি ছিল আইভী-শামীম ওসমান পরিবারের লড়াই। যদিও শুরু থেকেই এই লড়াই কিংবা বিভক্তি অস্বীকার করে গেছেন শামীম ওসমান।

নির্বাচনের আগে থেকেই সেলিনা হায়াৎ আইভী শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে গেছেন। অভিযোগ করেছেন শামীম ওসমান অনুসারীরা তার বিরুদ্ধে মাঠে নামার। অভিযোগ এমন পর্যায়ে পৌঁছায় খোদ শামীম ওসমানকে সংবাদ সম্মেলন করে বলতে হয় তিনি নৌকার বিরুদ্ধে যাবেন না। নৌকা প্রতীক নিয়ে কলাগাছ নির্বাচনে দাঁড়ালেও তিনি সেই প্রতীকে ভোট দেবেন বলেও জানিয়েছেন। প্রার্থী হিসেবে কলাগাছ শব্দ-বাক্যের এই ব্যবহারের মধ্যেও যে সূক্ষ্ম খোঁচার রাজনীতি ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার শামীম ওসমানকে এই ধরনের কথা বলতে বাধ্য করানোর মধ্যেও যে রাজনীতি ছিল সেটাও অস্বীকার করা যাবে না। তাই প্রকাশ্যে আইভীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় নামবেন ঘোষণা দেওয়ার পর আইভীর পাল্টা চালে শুনিয়ে দেন সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচনী প্রচারণায় নামা বিষয়ক আইনি সীমাবদ্ধতা। দলীয় অভ্যন্তরীণ রাজনীতির যে কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন আইভী সেখানে রীতিমত কোণঠাসা হয়ে পড়েন শামীম ওসমান।

আইভী-শামীম ওসমানের বাগযুদ্ধে নির্বাচনের আগে মাঠের আলোচনা থেকে বেশ দূরে সরে যান তৈমূর আলম খন্দকার। নির্বাচনী আলোচনা সীমিত হয়ে পরে আইভী ও শামীম ওসমানের মধ্যে। তৈমূর শামীম ও সেলিম ওসমানের প্রার্থী এমন এক আবহ তৈরি করে ফেলেন সেলিনা হায়াৎ আইভী। নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দল নারায়ণগঞ্জে গিয়ে যে সকল হুঁশিয়ারি দেয় সেগুলো শামীম ওসমানের বিপক্ষে যায়। শামীম ওসমানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের একাধিক প্রেসিডিয়াম মেম্বার। নির্বাচনের সময়ে মহানগর ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের মহানগর ও জেলা কমিটি এবং অধীন থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন কমিটিগুলো বিলুপ্ত করার মত ঘটনাও ঘটে। যে কমিটির লোকজন শামীম ওসমানের অনুসারী বলে অভিযোগ। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের এই অবস্থান শামীম ওসমানকে কেন্দ্রে বেকায়দায় ফেলেছে। এর বাইরে তৈমূর আলম খন্দকার শামীম ওসমান পরিবারের প্রার্থী এমন প্রচার নারায়ণগঞ্জ নগরবাসীর মনে কিছুটা হলেও বিশ্বাসযোগ্য হয়েছিল, যার প্রভাবে শান্তিপ্রিয় ভোটারেরা আইভীর প্রতি ঝুঁকেছে।

নারায়ণগঞ্জে শামীম ওসমান পরিবার প্রভাবশালী। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি মিলেমিশে এই পরিবারের রাজনীতির ধারা। শামীম ওসমান জেলার একটি আসনের আওয়ামী লীগের সাংসদ, অপর একটি আসনে তার ভাই সেলিম ওসমান জাতীয় পার্টির (এরশাদ) সংসদ সদস্য। এই পরিবারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ নিয়ে আলোচনা আছে। আইভীও নির্বাচনের আগে প্রকাশ্যে এই পরিবারের সদস্যের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। আইভীর এই সাহস সাধারণ ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। এবং ভোটারদের অনেকেই ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো মানুষ যে একমাত্র আইভীই, সেটা বিশ্বাস করেছে। কেবল নির্বাচনের আগেই নয়, সেলিনা হায়াৎ আইভী গত কয়েক বছর সাহসের সঙ্গে লড়াই করছেন এদের বিরুদ্ধে। ফলে নারায়ণগঞ্জের মানুষ মনে করে প্রভাবশালী ওই গ্রুপটির বিরুদ্ধে একমাত্র আইভীই হতে পারেন তাদের ভরসাস্থল।

শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জের একটি আসনের সাংসদ, প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেকেই তার অনুসারী। কিন্তু তুলনামূলক বিচারে শামীম ওসমানের চাইতে সেলিনা হায়াৎ আইভী অধিক জনপ্রিয়। এ দুজনের মুখোমুখি লড়াইয়েরও ইতিহাস আছে সেখানে শোচনীয় পরাজয় ছিল শামীম ওসমানের। আইভীর তিন দফা নির্বাচনী বিজয়ের প্রথম দফাতেই মুখোমুখি লড়াইয়ে লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধান ছিল। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়েও আইভীর সঙ্গে পেরে ওঠেননি শামীম ওসমান। সেবার স্বতন্ত্র প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর ১ লাখ ৮০ হাজার ৪৮ ভোটের বিপরীতে শামীম ওসমান পেয়েছিলেন মাত্র ৭৮ হাজার ৭০৫ ভোট। ওই নির্বাচনেও তৈমূর আলম খন্দকার ছিলেন, শেষ মুহূর্তে নির্বাচন বর্জন করার পর তার বাক্সে পড়েছিল মাত্র ৭ হাজার ৬১৬ ভোট। ২০১৬ সালে দ্বিতীয় দফা বিজয়ের সময়ে বিএনপির প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খানকে পরাজিত করেছিলেন সেলিনা হায়াৎ আইভী। ওই নির্বাচনে ডা. আইভী পান ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬১১ ভোট। বিপরীতে অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত পান ৯৬ হাজার ৪৪ ভোট। আর এবার ডা. আইভীর প্রাপ্ত ভোট ১ লাখ ৫৯ হাজার ৯৭। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার পান ৯২ হাজার ৫৬২ ভোট।

তিন নির্বাচনে ভোটের পার্থক্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১১ সালে শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে আইভীর জয় ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৩৪৩; ২০১৬ সালে বিএনপির অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খানের বিরুদ্ধে জয় ছিল ৭৯ হাজার ৫৬৭ ভোটের; এবার বিএনপির থেকে অব্যাহতি পাওয়া তৈমূর আলম খন্দকারের বিরুদ্ধে ভোটের ব্যবধান ৬৬ হাজার ৫৩৫ ভোটের। অর্থাৎ কোনো নির্বাচনেই ডা. আইভীর বিরুদ্ধে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়তে পারেননি। এর মধ্যে আবার সবচেয়ে শোচনীয় পরাজয় শামীম ওসমানের, যিনি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সরকার-দলের সমর্থন পেয়েও লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে হেরেছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ডা. আইভীর কাছে।

ভোটের লড়াইয়ে প্রধান প্রতিপক্ষকে আগে থেকেই ‘মাঠ ছাড়া’ করতে কিনা তৈমূর আলম খন্দকারকে শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমানের প্রার্থী রূপে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ফাঁদ পেতেছিলেন ডা. আইভী। এর ফলও মিলেছে। শামীম ওসমান আইভীর পাতা ফাঁদে আটকা পড়েছেন। তৈমূর তার প্রার্থী নন, এমনটা বলেছেন বারবার। কিন্তু তার সে দাবি বিশ্বাসযোগ্যতা পায়নি। না দলের কাছে, না ভোটারদের কাছে। ফলে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে এবং সুশাসনের প্রতিশ্রুতির পক্ষে একাট্টা থাকা স্থানীয় জনতা আইভীকেই গ্রহণ করেছে। শামীম ওসমান নৌকা প্রতীকের পক্ষে কাজ করবেন বলে যতই প্রতিশ্রুতি দিন না কেন তা বিশ্বাসযোগ্যতা পায়নি খোদ কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে। জাহাঙ্গীর কবীর নানকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম ও ১৬ কেন্দ্রীয় নেতাকে নিয়ে যে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি করা হয় তারাও শামীম ওসমান ও তার অনুসারীদের রেখেছিলেন কঠোর নজরদারিতে। এতে একদিকে যেমন শামীম ওসমান অনুসারীদের ডা. আইভীর বিরুদ্ধে মোটাদাগে যাওয়া যেমন সম্ভব হয়নি, অন্যদিকে আলোচিত এই সাংসদের ভাবমূর্তিও কেন্দ্রের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এটা কেবল তার নির্বাচনে জয়ের কারণ হয়নি, অপরদিকে ডা. আইভীকে স্থানীয় রাজনীতিতেও অবিসংবাদিত নেত্রী রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে।

আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ফের নারায়ণগঞ্জের মেয়র হয়েছেন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। তিনি কি কেবলই নৌকা প্রতীকের কারণে বিজয়ী হয়েছেন— এমন প্রশ্নও আছে। উত্তর একেকজনের কাছে একেক রকম হলেও ইতিহাসের ধারাবাহিকতা এবং বাস্তবতা হচ্ছে, তিনি কেবলই আওয়ামী লীগের দলীয় ভোটে মেয়র হননি। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ভোটারদের অবস্থান এবং তার আগের দুই আমলের মূল্যায়নও ছিল এই নির্বাচন। এই নির্বাচনসহ প্রতিটি নির্বাচনেই তার প্রাপ্ত ভোট লাখের কোটা অতিক্রম করে আসছে। যখন তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থন পাননি, তখনও তিনি নির্বাচিত হয়েছেন এবং সেটা আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে। তাই তিনি কেবল আওয়ামী লীগ বা নৌকার প্রতীকের ভোটে নির্বাচিত মেয়র এমনটা বলা যাবে না। ব্যক্তি আইভী এখানে দল ও প্রতীকের প্রভাবকে ছাড়িয়ে গেছেন— এমনটা ববললে কি অত্যুক্তি হবে? থাক না বিতর্ক এখানে, তবু তিন-তিনটা নির্বাচনের ফল যে ডা. আইভীর পক্ষেই যায়! এছাড়া চলমান স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে (ইউপি, পৌরসভা) যেখানে দলীয় প্রতীক নৌকা নিয়েও সারাদেশে যেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ধরাশায়ী হচ্ছেন সেখানে ডা. আইভী সেই নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ই আসতে দেননি।

এক নির্বাচনে অনেক অর্জন এবার ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর। আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদ শামীম ওসমান কেবল অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে নৌকার বিপক্ষে যেতে পারেন এমন একটা ধারণা তিনি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের বড় একটা অংশ যতটা না কেন্দ্র বিশেষত শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের প্রতি অনুগত তারচেয়ে বেশি শামীম ওসমানের অনুগত এমনটা প্রমাণ করতে পেরেছেন তিনি, যার প্রকাশ ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কয়েকটি ইউনিটের কমিটির বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত। এছাড়া আছে নির্বাচনের পূর্বাপরের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও সহনশীলতার রাজনীতি যেখানে এক প্রার্থী অন্য প্রার্থীর বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণায় যাননি। এখানে ডা. আইভী যেমন প্রশংসার যোগ্য, একইভাবে প্রশংসার দাবিদার অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। এটাও অর্জন নিঃসন্দেহে।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন দিয়ে ভোটের গণতন্ত্র ফিরেছে— এমন মন্তব্য অনেকের। ভোটগ্রহণ নিয়ে নিয়ে আত্মসমালোচনায় থাকা আলোচিত নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের ভাষ্যমতে ‘বিগত ৫ বছরে যতগুলো সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়েছে আমাদের প্রথম কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সর্বোত্তম।’ এই নির্বাচন কমিশনারের এমন মন্তব্য আশাব্যঞ্জক। আমরাও চাই তেমন সুষ্ঠু নির্বাচন যেমন নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটারেরা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পায়। অনেক কিছু পাইনি, অনেক কিছু পাচ্ছি না বলে বিবিধ শঙ্কা নিয়ে দেখতে বসা এই নির্বাচন আমাদেরকে ফের আশাবাদী হওয়ার প্রেরণা জোগাচ্ছে। এই আশাবাদ যেন অঙ্কুরেই বিনষ্ট না হয়!

লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

Link copied!