• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অনুভূতিতে আঘাত সাম্প্রদায়িকতার উপসর্গমাত্র


ইমতিয়াজ মাহমুদ
প্রকাশিত: নভেম্বর ৩, ২০২১, ০২:২৯ পিএম
অনুভূতিতে আঘাত সাম্প্রদায়িকতার উপসর্গমাত্র

খবরটা এসেছে এইভাবে যে ব্যান্ডদল ‘মেঘদলে’র ৭ সদস্যের বিরুদ্ধে দায়ের করা ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের’ মামলা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত। যিনি মামলা করেছেন, তিনি নিজে একজন আইনজীবী। এর আগে তিনি বাউলশিল্পী রীতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধেও একই রকম একটা মামলা করেছিলেন। মেঘদলের সব সদস্যকে এই মামলার আসামি করা হয়েছে। ডেইলি স্টারের খবরে বলা হয়েছে, মামলাটা করা হয়েছে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ২৯৫ক ধারায়। গত ২৬ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে সহিংসতাবিরোধী যে কনসার্ট হয়, সেই কনসার্টে মেঘদল ‘ওম’ নামের এই গানটি গেয়েছিল, সেই অনুষ্ঠানের ভিডিও ইউটিউবে দেখে নাকি ওই আইনজীবী সাহেবের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে, সে জন্য মামলা ইত্যাদি। মেঘদলের এই গানটি পনেরো বছরের পুরোনো, এই গান অনেকেই শুনেছেন, এর একটা পুরোনো ভিডিও বহু বছর ধরে ইউটিউবে রয়েছে।  

মামলাটি এমনিতে টেকার কথা নয়, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবেরই উচিত ছিল মামলাটি সরাসরি খারিজ করে দেওয়া, সেটা না করে তিনি পিবিআইয়ের কাছে পাঠিয়েছেন তদন্তের জন্য। এইখানে তদন্তের কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। মেঘদল আসলেই সেদিন এই গানটা করেছে সহিংসতাবিরোধী কনসার্টে। যে প্রেক্ষাপটে কনসার্টটি হয়েছে, সেখানে মেঘদলের উদ্দেশ্য আর যাই-ই হোক কোনো বাংলাদেশের মানুষের বা নাগরিকদের কোনো অংশের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার উদ্দেশ্য যে ওদের ছিল না, এটা বুঝতে তো আর আপনাকে বিশেষজ্ঞ আইনজীবী হতে হয় না। আর লিখিত বা উচ্চারিত কোনো কথা যদি সেই রকম অবমাননা করার অসৎ উদ্দেশ্যে বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে না করা হয়, তাইলে সেই কথায় কারও অনুভূতিতে আঘাত লাগলেও সেটা ২৯৫ক ধারায় অপরাধ হয় না। আমার ধারণা, পিবিআই তাদের তদন্তেই এই মামলার উপাদান পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদন দিয়ে দেবে, আর সেটা যদি না-ও দেয়, এই মামলা চূড়ান্ত বিচারে খারিজ হতে বাধ্য।

২৯৫ক ধারায় মামাল আমাদের এখানে আগেও হয়েছে কিন্তু সেগুলো হতো কদাচিৎ। আপনাদের মনে থাকবে হয়তো আমাদের আইনজীবী এ বি এম নুরুল ইসলাম নব্বইয়ের দশকে এই রকম আরেকটা মামলা করেছিলেন তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে। কিন্তু সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে যে এই রকম মামলার প্রবণতা যেন অনেক বেড়ে গেছে। ঢাকায় ও ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় লোকজন হরহামেশা ‘আমার ধর্মীয় অনুভূতি আঘাত পেয়েছি’ বলে ফটাফট মামলা ঠুকে দেয়। কেউ কেউ দণ্ডবিধির এই ধারায় মামলা করেন, আবার অনেকেই ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের অধীনে মামলা করেন। প্রশ্ন হলো, এই প্রবণতা কেন বেড়ে গেল গত কয়েক বছরে?

কেন এই রকম মামলার প্রবণতা বেড়ে গেল, সেটা বলার আগে এই আইনটা কী করে আমাদের দণ্ডবিধিতে ঢুকল, সেই প্রেক্ষাপটটা আগে বলে নিই। আপনারা জানেন যে দণ্ডবিধি বা ইংরেজিতে যেটাকে বলে পেনাল কোড, তা প্রণীত হয় ১৮৬০ সালে। ভারতবর্ষের শাসনক্ষমতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ইংল্যান্ডের রানির হাতে ন্যস্ত হওয়ার পর ভারতবর্ষের জন্য প্রথম যে কয়েকটা আইন তৈরি করা হয়, এই কোড সেগুলোর মধ্যে একটি। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া ব্যাপারটিকে মূল পেনাল কোডে একটি অপরাধ হিসেবে প্রথম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ১৯২৭ সালে ‘রঙ্গিলা রসুল’ নামে একটা ছোট পুস্তক প্রকাশিত হয়, আর সেটা প্রকাশিত হওয়ার পর সেই বইয়ের লেখক প্রকাশক ওদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও, ওরা বেকসুর খালাস পেয়ে যায়, কেননা সে সময় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার ব্যাপারটা একটা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতো না।

তখন দাবি উঠল যে—না, কেউ যদি ইচ্ছে করে, অসৎ উদ্দেশ্যে কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসকে আঘাত করে, তার জন্য একটা আইন তো থাকা দরকার। সেই প্রেক্ষাপটেই এই ধারাটা পেনাল কোডে যুক্ত করার জন্য একটা সংশোধনী আইন তখনকার কেন্দ্রীয় আইন সভায় ওঠে। কৌতূহল জাগানিয়া ব্যাপার হচ্ছে, এই ধারার ওপর আলোচনা করতে গিয়ে আইন সভায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেখানে তিনি এই আইনটি পেনাল কোডে যুক্ত করার ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি। বরং তার মনে যে শঙ্কাটি প্রবল ছিল, সেটা হচ্ছে যে এই রকম একটা আইন করলে নাগরিকদের লিবার্টি বিঘ্নিত হতে পারে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার বক্তৃতায় বলেছিলেন, এমনিতে যদি কেউ কোনো ধর্মকে ছোট করে দেখায় বা ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা বা নবীদের ইচ্ছা হলেই গালাগালি করে, এ রকম উটকো লোকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার আছে বটে, কিন্তু আমাদের সেই নীতিটাও রক্ষা করতে হবে যে যারা ইতিহাস নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বা সত্য নির্ণয়ের চর্চায় সৎ উদ্দেশ্যে ধর্মকে সমালোচনা করে, ওদেরকে যেন সুরক্ষা দেওয়া হয়।

এই ধরনের সব আইনই কোনো না কোনোভাবে মানুষের বাক্‌ ও চিন্তার স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করে। এ জন্য এসব আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। আধুনিক রাষ্ট্রকে এই জন্য ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচরণ থেকে দূরে থাকতে হয়, তাহলেই কেবল রাষ্ট্র নাগরিকদের বাক্‌ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের স্বাধীনতা এই দুইয়ের মধ্যে যথাযথ একটা ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে। সেটা যদি না হয়, রাষ্ট্র যদি তার সাংবিধানিক চরিত্র, দৈনন্দিন কার্যাবলি, সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের আচার-আচরণ—এসবের মাধ্যমে কোনো বিশেষ ধর্ম বা ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখায়, সেই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের মধ্যে আর সেই ভারসাম্যটা বজায় রাখা সহজ হয় না।

আমাদের এখানে এটাই হয়েছে। সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্ম হিসাবে ইসলামকে চিহ্নিত করা হয়েছে। রাষ্ট্রের আচরণে বিশেষ একটা ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব স্পষ্ট। সরকারের নেতৃস্থানীয় সবাইকে প্রতিদিনের আলাপ-আলোচনায় একটি বিশেষ ধর্মের মাহাত্ম্য বলতে থাকেন। এমনকি হিন্দুদের ওপর যখন সাম্প্রদায়িক হামলা হতে থাকে, তখনো দেখা গেছে যে সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা তো বটেই, এমনকি সরকারবিরোধী নেতৃস্থানীয় লোকজনকে দেখা গেছে যে ওরা সংখ্যাগুরুর ধর্মের মাহাত্ম্য প্রচারে অধিক গুরুত্ব দিতে থাকেন: এই ধর্ম ভিন্ন ধর্মের কার ওপর হামলা সমর্থন করে না, এই ধর্ম শান্তির ধর্ম ইত্যাদি। তাহলে জিনিসটা কী দাঁড়ায়? মানুষের মনে তখন স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এই রাষ্ট্রটি সংখ্যাগুরুর ধর্মকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে রাখতে সবকিছুই করবে। সেই সঙ্গে যখন দেখা যায় সরকারের সঙ্গে হেফাজত নেতাদের প্রকাশ্য ও সশ্রদ্ধ সম্পর্ক তখন কী বার্তা প্রচার হয়?

এ সকলেরই ফলাফল হচ্ছে এসব মামলা। এখন আমাদের বিচার বিভাগ, আমাদের নির্বাহী বিভাগ আর আইন বিভাগ সকলেই যেন মেনেই নিয়েছেন যে এটা হচ্ছে শতকরা নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশ, অন্যদের দেশ এটা নয়। ফলে যে উকিল সাহেব শান্তি ও মানবতার পক্ষের একটি গানের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিলেন আর ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবও সেই মামলাটি তদন্তের জন্যে পাঠালেন, এটাকে আর আপনি একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে পাশ কাটাতে পারবেন না। রাষ্ট্রের সাংবিধানিক চরিত্র যদি ধর্মনিরপেক্ষ হয়, সেটা যদি আমরা ফেরত আনতে পারি, তাহলে দেখবেন যে আবার বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ সবাই বেশ লিবারেল ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখাচ্ছে আর নাগরিকরাও অধিকাংশ সেভাবেই বেড়ে উঠবে।

‘মেঘদলে’র বিরুদ্ধে এই মামলাটা যিনি করেছেন, তিনি যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হয়রানিমূলক মামলা করছেন, সেটা স্পষ্ট। তিনি এটা করতে উৎসাহ পাচ্ছেন এবং কোনো না কোনোভাবে অন্য কারো কাছ থেকে আশকারা পাচ্ছেন, সেটাও স্পষ্ট। এই লোক না হয় ধরে নিলাম যুক্তিবুদ্ধির বাইরে গিয়ে মামলা করেছেন, কিন্তু কেবল গানের জন্য করা মামলায় আমাদের পুলিশ তো রীতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে, আদালত আবার সেটা বিচারের জন্য গ্রহণও করেছে। আপনি কেবল একজনকে নিন্দা করলে হবে? এই মামলাগুলো এবং হয়রানিগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, রাষ্ট্র যে সাম্প্রদায়িকতার ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে, এসব মামলা ও হয়রানি সেই ব্যাধিরই উপসর্গ।

 

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট

Link copied!