• ঢাকা
  • রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

৫০ বছরে শিক্ষার রূপ-রূপান্তর


মিল্টন বিশ্বাস
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৫, ২০২১, ০৫:১২ পিএম
৫০ বছরে শিক্ষার রূপ-রূপান্তর

১.

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে, তার মূলে রয়েছে এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়ন। ১৯৭১-এর আগে পাকিস্তান আমলে শিক্ষাকে ইসলামীকরণের চেষ্টা করা হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব বাংলার গড়ে তোলা হয়েছিল বৈষম্য। পাকিস্তান আমলে ছাত্রসমাজের শিক্ষা আন্দোলন এবং বঙ্গবন্ধুর সেই আন্দোলনে সম্পৃক্ততা একাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশের শিক্ষাকাঠামোয় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়ন কিংবা ১৯৭৩ সালের চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ, ১৯৭৪ সালের প্রাথমিক শিক্ষা টেকিং ওভার অ্যাক্ট, মাদ্রাসা শিক্ষা অর্ডিন্যান্স অর্ডার (১৯৭৩), বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অ্যাক্ট (১৯৭৩) এবং দ্য বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান অ্যান্ড সার্জন অর্ডার (১৯৭২) প্রভৃতির কথা স্মরণে রেখে বলা যায় শিক্ষার রূপ-রূপান্তর বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে শুরু হয়েছিল এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে তার ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে।

২.

মূলত আধুনিক, বৈজ্ঞানিক, অসাম্প্রদায়িক, সর্বজনীন ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন ঘটে বঙ্গবন্ধুর আমলে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৮ অক্টোবর ১৯৭০ সালে বেতার-টেলিভিশন ভাষণে বলেছিলেন, ‘সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের চাইতে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর হতে পারে না। ১৯৪৭ সালের পর বাংলাদেশে প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার পরিসংখ্যান একটা ভয়াবহ সত্য। আমাদের দেশের শতকরা ৮০ জন অক্ষরজ্ঞানহীন। প্রতিবছর ১০ লাখেরও অধিক নিরক্ষর লোক বাড়ছে। জাতির অর্ধেকের বেশি শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। শতকরা মাত্র ১৮ জন বালক ও ৬ জন বালিকা প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করছে। জাতীয় উৎপাদনের শতকরা কমপক্ষে ৪ ভাগ সম্পদ শিক্ষাখাতে ব্যয় হওয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। কলেজ ও স্কুল, বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করতে হবে। নিরক্ষরতা অবশ্যই দূর করতে হবে। পাঁচ বছর বয়স্ক শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্য একটি ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালু করতে হবে। মাধ্যমিক শিক্ষার দ্বার সকল শ্রেণির জন্য খোলা রাখতে হবে। দ্রুত মেডিকেল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়সহ নয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দারিদ্র্য যাতে উচ্চশিক্ষার জন্য মেধাবী ছাত্রদের অভিশাপ না হয়ে দাঁড়ায় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।’

স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বৈষম্যহীন সমাজ তৈরিতে মনোযোগী ছিলেন। স্বপ্ন দেখতেন পাকিস্তান আমলের সব বৈষম্যের নিরসনের। ভাবতেন স্বাধীন দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এমন হবে যেন একটি সুখী সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের সন্তানরা বেড়ে উঠতে পারে সংস্কারমুক্ত পরিবেশে।

স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্নির্মাণ করা এবং স্বাধীন দেশের উপযোগী পাঠ্য বই রচনা ও প্রকাশের দায়িত্ব সরকারকে পালন করতে হয়। উপরন্তু মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য শিক্ষক শহীদ হওয়ার তাদের পদগুলো পূরণ করা, নয় মাস শিক্ষকদের বেতন বন্ধ ছিল— সেই বেতন পরিশোধ করাও ছিল গুরু দায়িত্ব। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্রসমাজ যে নিদারুণ ত্যাগ স্বীকার করেছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সব সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের বেতন মওকুফ করা হয়। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সম্মতিক্রমে ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠনের জন্য ৫১ কোটি টাকা বরাদ্দের কথা ঘোষণা করেন। এর অধিকাংশ অর্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনর্নির্মাণে ব্যয় হয়। ১৯৭২ সালে ভাষার মাসে, ১২ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা। স্কুল-কলেজের বেতনও পুনর্নির্ধারণ করা হয়। ১৯ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করা হয় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা মূল্যে বই প্রদান করবে সরকার। সেই সঙ্গে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ৪০ শতাংশ কম দামে বই দেওয়া হবে। নারীদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু সরকারের অবদান আছে। ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রীদের বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। ফলে নারীশিক্ষার জন্য যুগান্তকারী একটি পদক্ষেপ সূচিত হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের সংবিধানে শিক্ষা নিয়ে স্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করা হয়। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয়। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ১৭ অনুচ্ছেদে শিক্ষা সম্পর্কে বলা আছে, রাষ্ট্র (ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য; (খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য; (গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য; কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন৷

বঙ্গবন্ধু মনে করতেন— শিক্ষার্থীরা যেন শুধু ডিগ্রীধারী না হয়ে বরং সমাজের প্রয়োজনে শিক্ষিত হয়ে দেশের কাজে ভূমিকা রাখতে পারে, এই লক্ষ্যে তাদের পাঠদান করাই হবে শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য।’এ জন্য তিনি কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। গণমুখী শিক্ষা এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সঙ্গে মিল রেখেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে গড়ে তুলতে তিনি এই শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন। কমিশন ১৯৭৪ সালের ৩০ মে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করে। বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন শিরোনামে ৩০৯ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। রিপোর্টে বলা হয়, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, দেশপ্রেম ও সুনাগরিকত্ব, মানবতা ও বিশ্বনাগরিকত্ব, নৈতিক মূল্যবোধ, সামাজিক রূপান্তরের হাতিয়ার রূপে শিক্ষা, প্রয়োগমুখী অর্থনৈতিক অগ্রগতির অনুকূলে শিক্ষা, কায়িক শ্রমের মর্যাদাদান, নেতৃত্ব ও সংগঠনের গুণাবলি, সৃজনশীলতা ও গবেষণা, সামাজিক অগ্রগতি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক প্রগতির ক্ষেত্রে শিক্ষা মুখ্য ভূমিকা পালন করবে।

কিন্তু দুঃখের বিষয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি স্বৈরশাসকদের দ্বারা অবহেলিত হয় এবং দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া হয়। ফলে দেশের মধ্যে ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও শিক্ষার মান ক্রমাগত নিম্নমুখে ধাবিত হয়।

৩.

১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর এ দেশে শিক্ষার অগ্রগতি পুনরায় সঠিক পথ অনুসরণ করতে শুরু করে। বিএনপি-জামায়াত ও সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০১ থেকে ২০০৮ অবধি সেই অগ্রগতি থমকে দাঁড়ালেও ২০০৯ থেকে আজ পর্যন্ত শিক্ষা সেক্টরে এগিয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত বিশদ। এ জন্য ‘শিক্ষার্থীদের সংখ্যা দিয়ে নয়, বরং শিক্ষার গুণগত মান হবে একটা প্রতিষ্ঠানের মান নির্ধারণের মাপকাঠি।’— এই মুখ্য মন্ত্র আজকের শিক্ষার চালিকা শক্তি। একইভাবে উচ্চশিক্ষায় গবেষণাকাজকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, ‘উচ্চশিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এখন বেশি জোর দিতে হবে গবেষণার ক্ষেত্রে। তবেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছাতে সক্ষম হবে। শিক্ষার্থীদের সংখ্যা দিয়ে নয়, বরং শিক্ষার গুণগত মান হবে একটা প্রতিষ্ঠানের মান নির্ধারণের মাপকাঠি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হবে উচ্চশিক্ষা তথা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার সূতিকাগার।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শিক্ষায় জিডিপির অন্তত ৪ শতাংশ বিনিয়োগের কথা বলেছিলেন। কিন্তু আমরা আজও ৩ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ করতে পারছি না। তবে অন্যান্য যেসব বিষয়ে বিনিয়োগ করা হচ্ছে, সেগুলো পক্ষান্তরে শিক্ষা খাতেই বিনিয়োগ হচ্ছে। কারণ সেগুলো শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করছে। দারিদ্র্য যেন কারও উচ্চশিক্ষা অর্জনে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, আমাদের সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।’ শিক্ষামন্ত্রীর প্রত্যাশা এবং বর্তমান বাস্তবতায় ইউজিসির বিভিন্ন উদ্যোগ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গবেষণার অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করেছে।

বর্তমান সরকারের সাড়ে ১২ বছরে দেশের ৪৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী ও দক্ষ উপাচার্য নিয়োগ দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি প্রশংসা অর্জন করেছেন। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেকের জীবনবৃত্তান্ত, একাডেমিক সাফল্য পর্যালোচনা করেই তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। অর্থাৎ প্রথমত উপাচার্যরা নিয়োগ পেয়েছেন একাডেমিক যোগ্যতায়। তারপর তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দেশপ্রেম ও সংস্কারমুক্ত মুক্তবুদ্ধির অনুসারী কি না, তা বিবেচনায় এনে প্রশাসনিক পদে পাঠানো হয়। এসব চেতনায় অবিশ্বাসীরা কিংবা দুর্বল একাডেমিক রেকর্ড নিয়ে চাকরিপ্রত্যাশীরাই মূলত উপাচার্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ এনে থাকে, যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

ধরুন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্ট অনুসারে প্রশাসন পরিচালনায় উপাচার্যকে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সেখানে সিনেট কিংবা অন্য কোনো পরিষদের (সিন্ডিকেট, ডিন) সদস্যদের জন্য নির্বাচনের ব্যবস্থা নেই। সে ক্ষেত্রে সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. মীজানুর রহমান তাঁর কর্তৃত্ব বজায় রাখবেন, এটাই স্বাভাবিক ছিল। প্রশাসন চালিয়েছিলেন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুসারে কারও প্রতি অনুরাগ কিংবা বিরাগের বশবর্তী হয়ে নন। অনেক সময় দেখা গেছে সরকার দলীয় শিক্ষক কিংবা ছাত্র নেতাদের অযৌক্তিক দাবি মেনে নিতে অপারগ হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়েছে। উপাচার্যদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা বিরোধী দলের সমর্থক কেবল নয়, নিজের দলের লাল-নীল শিক্ষকদের ইন্ধনেও হয়ে থাকে, যা ন্যক্কারজনক। নিজেদের স্বার্থ রক্ষা পেলে উপাচার্য ভালো বনে যান আর নিজেদের আনডিউ স্বার্থ হাসিল না হলে তিনি মন্দ হিসেবে গণ্য হন। এ বাস্তবতায় উপাচার্যদের দলীয় আনুগত্যকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখার কোনো সুযোগ নেই। তাছাড়া শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের রাজনীতিকে খারাপ বলার মধ্য দিয়ে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে মুছে ফেলার চক্রান্ত করা হচ্ছে বলে আমরা মনে করি। কারণ অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম পাথেয় ছিল। তার ধারাবাহিকতায় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রাজনীতিচর্চা গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট অনুসারে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগরে নির্বাচিত উপাচার্য নিযুক্ত রয়েছেন।

সেদিক থেকে দাবি করা যেতে পারে যে, উপাচার্য নিয়োগে গণতান্ত্রিক ধারা, যোগ্যতার মাপকাঠি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এর সবকিছু একীভূত। এ ধরনের ব্যবস্থা চর্চিত হলে উপাচার্যদের ছত্রছায়ায় দলীয় ছাত্রসংগঠনের বেপরোয়া চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির অভিযোগ থাকবে না বলে আমাদের বিশ্বাস। তাছাড়া বর্তমান সরকার দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বজায় রাখা শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি’র জন্য কোনো ব্যাপার না। অবশ্য একথা ঠিক কোনো শিক্ষকের দলীয় মনোভাবে কাজ করা উচিত নয়। যা কিছু করা দরকার, সব শিক্ষা ও জাতির স্বার্থে করতে হবে। কিন্তু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়মের জন্য সব উপাচার্যকে ঢালাওভাবে দায়ী করাও ঠিক নয়। কারণ, কোনো উপাচার্যের দলীয় মনোবৃত্তি নিয়ে কাজ করার সুযোগ নেই। তবে যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, সেই সরকারের ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা কিছু সুযোগ-সুবিধা নিতে চায়, এটাই স্বাভাবিক। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দলীয়করণের সুযোগ কম। কারণ শিক্ষা নিয়ে দলীয়করণ করলে শিক্ষার মান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান ধরে রাখা সম্ভব নয়।

৪.

মনে রাখতে হবে, মানবজাতির কল্যাণকর, শান্তিপূর্ণ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ সৃষ্টি শিক্ষার মূল লক্ষ্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘মানুষের অভ্যন্তরের মানুষটিকে পরিচর্যা করে খাঁটি মানুষ বানানোর প্রচেষ্টাই শিক্ষা।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘শিক্ষা হলো, বাইরের প্রকৃতি ও অন্তঃপ্রকৃতির মধ্যে সমন্বয় সাধন।’ মানবশিশুর জন্মের পর থেকে ক্রমাগত এবং অব্যাহত পরিচর্যার মাধ্যমে তার দৈহিক বৃদ্ধি ঘটে। অন্যদিকে নানা সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমে তার মানসিক বিকাশ হয়। উন্নত মানসিক বিকাশের ক্রমচর্চার মধ্য দিয়ে নৈতিকতার পরিগঠনের মাধ্যমে আত্মার শুদ্ধি ঘটে। এ জন্য বলা হয়ে থাকে দেহ, মন ও আত্মার সুসামঞ্জস্য বিকাশই শিক্ষা। এককথায় পরিপূর্ণ মানবসত্তাকে লালন করে দেহ, মন ও আত্মার সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে, নিজেকে জাতির উপযোগী, যোগ্য, দক্ষ, সার্থক ও কল্যাণকামী সদস্য হিসেবে গড়ে তোলার নামই শিক্ষা। শিক্ষা মানবজীবনের এক মূল্যবান সম্পদ। এ সম্পদ কখনোই খোয়া যায় না বা বিলুপ্ত হয় না। বেঁচে থাকার জন্য, নিজেকে অভিযোজিত করার লক্ষ্যে শিক্ষা অপরিহার্য। শিক্ষা ব্যক্তির উন্নয়ন, সমাজের উন্নয়ন এবং দেশের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশের প্রথম সরকার কর্মকাণ্ড শুরু করে। এখন ২০২১ সাল ‘মুজিববর্ষ’। এই দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশকে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে, পাল্টে গেছে শিক্ষা-সংস্কৃতি, নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে মানুষের চিন্তাচেতনা। পাকিস্তান আমলে শিক্ষাপদ্ধতি দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য তৈরি করেছিল। একাধিক শিক্ষাপ্রণালি ছিল এর মূল কারণ। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ‘কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন’-এর রিপোর্টে এ দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান নানা রূপ বৈষম্য অবসানের কথা উল্লেখ করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করা হলে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে পাকিস্তানের পুরোনো ভূত ভর করে। ১৯৭৩ সালে চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গণতান্ত্রিক অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধু যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন, তারও মৃত্যু ঘটে পঁচাত্তর-পরবর্তী স্বৈরশাসকদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরাসরি হস্তক্ষেপের ফলে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে ব্যাপক উন্নয়নের জোয়ার চলছে। ঢাকায় ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় ভালো সাফল্য দেখাচ্ছে। রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুরে ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহজাদপুর-শিলাইদহে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, নেত্রকোনার শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পর নতুন উৎসাহে একাডেমিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। যুগান্তকারী এসব উদ্যোগ চার দশকের শিক্ষাচিত্রে অনন্য সংযোজন।

বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর ইতোমধ্যেই বলেছেন, শ্রমশক্তিতে তারুণ্যের প্রাধান্য বাড়ায় আগামী ১০ বছর বাড়তি সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। এ সুবিধা পেতে বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে নতুন কৌশল নিতে হবে। শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে কর্মমুখী উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে উচ্চশিক্ষা। বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পূর্ববর্তী সরকারের তৈরি নানান অসংগতি দূর করা হচ্ছে।

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুণগত মান নিশ্চিতকরণ ও তা বিশ্ব পর্যায়ে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এর আলোকে ‘অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল ফর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিজ ২০১২’ প্রবিধানমালা প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তা বাস্তবায়িত করা হচ্ছে। দু-একটি বাদে এত দিন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয় প্রচলন ছিল না। বর্তমান সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির অনুরোধ রক্ষা করেছে অনেকেই; স্নাতক ও স্নাতকোত্তর বিভাগে বাংলা ভাষা-সাহিত্য পড়ানো হয়। বাংলাদেশে বিদেশি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের স্থান ও পরিচালনাসংক্রান্ত প্রবিধানমালা প্রণয়নের কাজ চলছে।

ইউজিসির বদৌলতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা লক্ষ করা যাচ্ছে। বর্তমানে প্রতি মাসে পোস্ট-ডক্টরালে ৫০ হাজার এবং পিএইচডি প্রোগ্রামে গবেষণার জন্য ৩০ হাজার টাকা বৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া গবেষণা প্রকল্পেও অর্থ বরাদ্দ বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। হেকেপসহ বেশ কিছু প্রকল্পের আওতায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণার জন্য দেশের অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা উপপ্রকল্পে কয়েক শ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। দেশের উচ্চশিক্ষা খাতে গবেষণায় এর আগে এত বেশি বরাদ্দ আর কখনো দেওয়া হয়নি। গবেষণার ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির সংযুক্তি একটি অনিবার্য দিক। আন্তবিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণার জন্য আন্তর্জাতিক যোগাযোগে উচ্চ গতিসম্পন্ন ডেটা যোগাযোগ নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের আমলেই ইউজিসি ও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের মধ্যে কোম্পানিটির দেশব্যাপী বিস্তৃত অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক ২০ বছরব্যাপী ব্যবহার বিষয়ে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি কার্যক্রমে অনলাইন পদ্ধতির ব্যবহার যুক্ত করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৪৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ও এসএমএসের মাধ্যমে ভর্তির আবেদনপত্র ও ফি গ্রহণ করা হচ্ছে।

করোনা মহামারি শুরু হওয়ার আগে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রদেয় গবেষণা সহায়তা মঞ্জুরি অনলাইনে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. কাজী শহীদুল্লাহ ইউজিসিতে আয়োজিত ‘অনলাইন সাবমিশন ফর রিসার্চ গ্র্যান্টস’ সফটওয়্যার উদ্বোধন করেন। তাঁর মতে, ‘অনলাইন সাবমিশন ফর রিসার্চ গ্র্যান্টস সফটওয়্যারটি ব্যবহার করলে কাউকেই আর ইউজিসিতে গবেষণা সহায়তা মঞ্জুরির জন্য আসতে হবে না। এর মাধ্যমে সেবা দ্রুত পাওয়া যাবে। এটি ইউজিসি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করবে এবং কর্মপরিবেশ উন্নত করবে। সফটওয়্যারটির সুফল পেতে এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে বলে তিনি জানিয়েছিলেন। ওই সময় তিনি উচ্চশিক্ষার সুফল পেতে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ও ইউজিসির সেবা জনবান্ধব করার জন্য সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ প্রদান করেন।’ উল্লেখ্য, ইউজিসির গবেষণা সহায়তা ও প্রকাশনা বিভাগ থেকে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে বিদেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কনফারেন্স/সেমিনার/সিম্পোজিয়াম/ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ; উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য যাতায়াত খরচ, দেশের অভ্যন্তরে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কনফারেন্স/সেমিনার/সিম্পোজিয়াম/ওয়ার্কশপের জন্য সহায়তা এবং এমফিল/পিএইচডি/পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণায় সহায়তা দিয়ে থাকে। সফটওয়্যারের মাধ্যমে সহজে সেবা প্রদান যেন বিঘ্নিত না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে ইউজিসি চেয়ারম্যান পরামর্শ প্রদান করেছেন। করোনাকালে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা প্রদানের উদ্যোগ এবং অনলাইন ক্লাসের জন্য টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিয়ে ইউজিসি তাদের কাজের দক্ষতা দেখিয়েছে। ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্যাম্পাসভিত্তিক ক্লাস বন্ধ থাকলেও অনলাইন লেখাপড়ার কার্যক্রম পুরোটাই মনিটরিং করে ইউজিসি। এমনকি কোভিড-১৯-এ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা কার্যক্রমও দেখভালের দায়িত্ব এই সংস্থার ওপর বর্তেছে। আসলে চার দশকে শিক্ষার উদ্দেশ্যের সঙ্গে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মযজ্ঞ প্রসারিত হয়েছে। এরই পরিণতিতে স্থাপিত হয়েছে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়; নিযুক্ত হয়েছেন ইউজিসিতে বিজ্ঞ চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ। ব্যক্তির জীবনে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন বা কলাকৌশল আয়ত্ত করতে সহায়তা করার এসব প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যৎ-প্রসারী ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আমরা মনে করি। কারণ, আওয়ামী লীগের প্রশাসক হলেও মানের দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তারা ক্রমান্বয়ে উচ্চ স্তরে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন। নতুন নতুন বিভাগ ও মেধাবী শিক্ষকদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। জ্ঞানের প্রসারিত দিগন্তে বিশ্বের যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বরেণ্য গবেষকদের সঙ্গে সমান্তরাল মেধা ও যোগ্যতা প্রদর্শনে সক্ষম এ দেশের বর্তমান প্রজন্ম।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের শিক্ষা ক্ষেত্রে বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রত্যাশিত গতিতে অগ্রসর হচ্ছে। বর্তমান সরকারের সাড়ে ১২ বছরে উচ্চ শিক্ষাঙ্গনের অশান্ত পরিস্থিতিকে দ্রুত স্বাভাবিক করে তোলা হয়েছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব অর্জনের জন্য শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা এবং তাদের মধ্যে সুস্থ মানসিকতা ও উচ্চ মানসম্পন্ন মনন সৃষ্টি করা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব। মুক্তচিন্তার চর্চা, নিরাসক্তভাবে সত্যের অনুসন্ধানের মাধ্যমে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলাও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তব্য, যার প্রধান অবলম্বন হলো গবেষণা। ডা. দীপু মনির শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহর ইউজিসি প্রশাসনের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রথম শ্রেণির বিদ্যাপীঠে পরিণত করতে সহায়ক হবে।

৫.

করোনার প্রকোপ কিছুটা হ্রাস পাওয়ার পর চলতি বছর (২০২১) পাবলিক পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। ডা. দীপু মনি জানিয়েছিলেন, স্কুল-কলেজ খোলার পর ক্লাসে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে ২০২১ সালের এসএসসি ও এইচএসসি ছাত্রছাত্রীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। তারা সপ্তাহে ছয় দিন ক্লাস করবে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের বাকি শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে এক দিন ক্লাস করবে। তিনি জানান, এ বছর অটোপাস দেওয়ার ইচ্ছা সরকারের নেই। বিশ্ববিদ্যালয় খোলা নিয়ে তিনি আরও জানান, শিক্ষার্থীদের করোনাভাইরাসের টিকা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। এ বিষয়ে শিগগিরই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সঙ্গে বৈঠক করবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। উল্লেখ্য, প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে মাধ্যমিক (এসএসসি) ও এপ্রিলে উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষা শুরু হলেও এ বছর করোনার কারণে এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষা এখনো নেওয়া সম্ভব হয়নি। গত বছর এসএসসি পরীক্ষা নেওয়া গেলেও এইচএসসিতে শিক্ষার্থীদের অটোপাস দেয় সরকার। এর আগে সময় পিছিয়ে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে এসএসসি পরীক্ষা জুনে ও এইচএসসি পরীক্ষা আগস্টে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। সে জন্য এসএসসি ৬০ দিন ও এইচএসসি ৮৪ দিন ক্লাস ধরে পরিমার্জিত সংক্ষিপ্ত সিলেবাসও প্রকাশ করেছিল শিক্ষা বোর্ড। হঠাৎ করে করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় এ ঘোষণার বাস্তবায়নও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। দেশের শিক্ষা সেক্টরে অশনি সংকেত ধ্বনিত হলেও প্রথম থেকে শিক্ষামন্ত্রীর বাস্তবসম্মত পদক্ষেপগুলো ছিল যথার্থ। তিনি নিজে ডাক্তার হওয়ায় এবং করোনায় আক্রান্ত হয়ে এই ভাইরাসের ক্ষতিকর দিক সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণায় লাভ করায় যুবসমাজকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে চাননি। বরং একাধিক সভায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা উল্লেখ করে অনলাইন ক্লাসের ওপর জোর দিয়েছেন। তবে দুটি বড় পাবলিক পরীক্ষা শেষ করতে পারা আমাদের জন্য সৌভাগ্যের সূচনা করেছে।

করোনার মধ্যে অনলাইন শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে ডা. দীপু মনি বলেছিলেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই যুগে আমাদের কর্মক্ষেত্র এত পরিবর্তন হবে যে বর্তমানে অর্জিত জ্ঞান হয়তো ভবিষ্যতে আর প্রয়োজন হবে না। সে ক্ষেত্রে কর্মজীবীদের পক্ষে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে, যাতে কোনো কর্মজীবী যেকোনো সময় যেকোনো পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। সে যেন অনলাইনের মাধ্যমে শিখতে পারে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সে সুযোগ রাখতে হবে। তাঁর মতে, ডিজিটাল শিক্ষার যুগে বাচ্চাদের শেখার উপকরণগুলো সহজেই বোধগম্য এবং উপভোগ্য করে তৈরি করা দরকার। পড়াশোনা সব সময় পরীক্ষাকেন্দ্রিক হওয়া উচিত নয়, বরং নীতিবান, দায়িত্বশীল এবং সংবেদনশীল মানুষ গড়তে যেসব শিক্ষা দরকার, তার প্রয়োজনীয়তা অনেক, যেমনটা জাতির পিতা স্বপ্ন দেখেছিলেন।

অর্থাৎ করোনা-পরবর্তী সময়েও দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভার্চুয়াল ক্লাস চলমান থাকবে। দীপু মনি তখন বলেছিলেন, ‘১০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে রয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য সুদবিহীন ঋণ দেওয়া যায় কি না, তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা ওয়ান স্টুডেন্ট ওয়ান ল্যাপটপ লোনও দিতে পারি।’ তাঁর মতে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উদ্যোগ নিয়ে চাহিদা অনুযায়ী জনশক্তি তৈরি করতে হবে। চলমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধকালীন সময়ে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির পাঠদানের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য “সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশন”-এ বিষয়ভিত্তিক ক্লাস শুরু করে। এ প্রসঙ্গেও শিক্ষামন্ত্রী কথা বলেছেন। সংসদ টিভির ক্লাসগুলো প্রযুক্তির বিভিন্ন মাধ্যমে প্রায় ৯০ ভাগ শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছেছে জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, ‘মাঠপর্যায়ের জরিপে আমরা জানতে পেরেছি, সংসদ টিভির ক্লাসগুলো মোবাইল ফোনসহ প্রযুক্তির বিভিন্ন মাধ্যমে প্রায় ৯০ ভাগ শিক্ষার্থী দোরগোড়ায় পৌঁছেছে। তবে এখনো ১০ ভাগ শিক্ষার্থীর কাছে সংসদ টিভির ক্লাসগুলো পৌঁছায়নি। কিন্তু এই দশ ভাগকে পেছনে ফেলে আমরা সামনে এগিয়ে যাব না। তাই ইতিমধ্যেই আমরা টোল ফ্রি মোবাইল সুবিধা দেব, যা খুবই দ্রুত চালু করতে যাচ্ছি, যার মাধ্যমে সেই ১০ ভাগ শিক্ষার্থীও শিক্ষকদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার মাধ্যমে পাঠের সুযোগ পাবে। এছাড়া ইন্টারনেটের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে বাজেটে প্রস্তাবনা থাকলেও শুধু শিক্ষাক্ষেত্রকে এর বাইরে রেখে বা নামমাত্র মূল্যে কীভাবে ইন্টারনেট সুবিধা দেওয়া যায়, সেটা নিয়েও আমরা ভাবছি। এ ছাড়া কমিউনিটি রেডিওর মাধ্যমেও তাদের কাছে শিক্ষা পৌঁছানোর বিষয়ে আমাদের কাজ চলছে। ইউনিয়ন পর্যায়ের তথ্য সেবাকেন্দ্র ও ডিজিটাল সেবাকেন্দ্রগুলোকে শিক্ষার জন্য ব্যবহার করা পরিকল্পনা রয়েছে।’ ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণিতে অনলাইন ভর্তির কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয় শিক্ষামন্ত্রীর সার্বক্ষণিক তদারকিতে।

বিশ্বব্যাপী চলমান করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়নি। জেএসসি, জেডিসি, এসএসসি ও দাখিল পরীক্ষার ফলাফলের গড়ের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হয়। মূল্যায়নের পর ডিসেম্বরে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল অটোপাস হিসেবে প্রকাশিত হয়। সে সময় ডা. দীপু মনি বলেছিলেন, কোভিড-১৯ পরিস্থিতি কখন স্বাভাবিক হবে, এর নিশ্চয়তা নেই। আমাদের কাছে অবশ্যই পরীক্ষার্থীদের জীবনের নিরাপত্তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে ২০২০ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা সরাসরি গ্রহণ না করে একটু ভিন্ন পদ্ধতিতে মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। পরীক্ষা না নিয়ে পরীক্ষার্থীদের মূল্যায়ন শিক্ষা বোর্ডগুলোর জন্য একেবারেই নতুন।

৬.

৫০ বছরের উল্লেখযোগ্য দিক হলো, ‘শিক্ষানীতি ২০১০’ সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, প্রায় ১০ বছর আগে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। তাই এখন শিক্ষানীতিকে সংশোধন, পরিমার্জন ও সংযোজন করা প্রয়োজন। এজন্য সরকার শিক্ষানীতি সংশোধন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

মহামারির মধ্যে প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, ‘ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে সরকারি সেবাসমূহের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা সহজ হয়।’ তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের ১৩০টি সেবা একই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে প্রদানের কার্যক্রম myGov-এর উদ্বোধন করেন। ২০২০ সালের ৭ আগস্ট এ সম্পর্কে শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) বিপ্লব। যেখানে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের সঙ্গে একান্ত সঙ্গী হয়ে যাবে প্রযুক্তি। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। এই শিল্পবিপ্লবের ফলে গতানুগতিক অনেক চাকরি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আবার চাকরি ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে। এই চ্যালেঞ্জকে সরকার সম্ভাবনায় পরিণত করতে চায়। এ জন্য প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে। আর এ লক্ষ্যে ২০৫০ সালের মধ্যে কারিগরি শিক্ষায় ভর্তির হার ৫০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ ও এর অধীন অধিদপ্তর/দপ্তর/সংস্থার ডিজিটাল সার্ভিস রোডম্যাপ ২০২১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে a2i প্রোগ্রামের সহায়তা করা ছাড়াও করোনাকালে“ডিজিটাল সার্ভিস ডিজাইন অ্যান্ড প্ল্যানিং ল্যাব” বিষয়ক কর্মশালা চালু হয়।২০২০ সালে শিক্ষা ক্যাডারের বিভিন্ন ব্যাচের ৬০৯ জন সহযোগী অধ্যাপককে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।

২০২০ সালের ৪ আগস্ট শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব জমি নেই, সে রকমের প্রতিষ্ঠানকে ভবিষ্যতে আর এমপিও প্রদান করা হবে না। ইতিমধ্যে ভাড়া বাড়িতে স্থাপিত যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিও প্রদান করা হয়েছে তাদের আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে নিজস্ব জায়গায় প্রতিষ্ঠান স্থানান্তর করতে হবে। মন্ত্রী বলেন, কোনো ট্রাস্ট বা সংস্থা দ্বারা পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ট্রাস্ট বা সংস্থার সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে এমপিওভুক্ত করা হবে। এই রকমের যেসব প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে এমপিওভুক্ত হয়েছে, ট্রাস্ট যদি না চায় তাহলে সেসব প্রতিষ্ঠানের এমপিও বাতিল করা হবে। এবং ওই সব প্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা চাইলে অন্য এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে পারবেন। অথবা আগের প্রতিষ্ঠানে থেকে যেতে পারবেন। তা ছাড়া ভবিষ্যতে ট্রাস্টের কোনো প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন করতে হলে ট্রাস্টের পূর্বানুমোদন নিতে হবে। ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪৬ কোটি ৬৩ লাখ ৩০ হাজার টাকার বিশেষ অনুদান প্রদান করেন। কিন্তু এরপর এই অনুদান নিয়মিত প্রদান করা খুবই জরুরি ছিল। কারণ, এখনো বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের অবস্থা করুণ।

উল্লেখ্য, দেশের ক্লান্তিলগ্নে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় করোনাভাইরাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ৬৪ জেলার ৮ হাজার ৪৯২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) ননএমপিও ৮০ হাজার ৭৪৭ জন শিক্ষকের প্রত্যেককে ৫ হাজার টাকা হারে এবং ২৫ হাজার ৩৮ জন নন-এমপিও কর্মচারীর প্রত্যেককে ২ হাজার ৫০০ টাকা হারে মোট ১ লাখ ৫ হাজার ৭৮৫ জন শিক্ষক-কর্মচারীর জন্য ২০১৯-২০ অর্থবছরে শিক্ষাবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর “বিশেষ অনুদান” এর খাত থেকে ৪৬ কোটি ৬৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা ৬৪ জন জেলা প্রশাসকের অনুকূলে বরাদ্দ প্রদান করেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের তালিকাভুক্ত EIIN ধারী ননএমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিশালসংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারীদের হালনাগাদ তথ্যাদি ইতিপূর্বে সংগ্রহ করে ডেটাবেইস তৈরি করা হয় এবং স্থানীয় প্রাশাসনের মাধ্যমে নামের তালিকা যাচাই-বাছাই করা হয়। সেই তালিকার ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর “বিশেষ অনুদান” খাত থেকে প্রাপ্ত অর্থ জেলা প্রশাসকরা সংশ্লিষ্ট ননএমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের অনুকূলে চেক/ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ২০২০ সালের জুন মাসে বিতরণ করা হয়।

বলা বাহুল্য, করোনা মহামারির চলমান দুর্যোকালীন সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিশালসংখ্যক নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের অনুকূলে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে প্রাপ্ত বিশেষ অনুদান এবং ইতিপূর্বে গত অর্থবছরে নতুন ২ হাজার ৭৩০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তিসহ ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির আওতায় এনে তাঁদের বেতন-ভাতাসহ চাকরি সুনিশ্চিত করা শেখ হাসিনা সরকার তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। করোনাকালে রেকর্ডসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করার মধ্য দিয়ে শিক্ষাবান্ধব সরকারে পরিণত হয়েছেন শেখ হাসিনা।

২০২০ সালের ২৩ জুন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভার্চুয়াল ক্লাসরুমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানিয়েছিলেন, করোনাকালে এবং করোনা-পরবর্তী সময়ে দেশের সব বেসরকারি ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভার্চুয়াল ক্লাসরুমের ব্যবস্থা করা হবে। তাঁর মতে, ‘নতুন দক্ষতা অর্জনে শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন শিক্ষাই বড় সহায়ক।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কয়েক বছর পর অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থায় যেতেই হতো। করোনা পরিস্থিতির কারণে আগেই শুরু করতে হলো। রূপকল্প ২০৪১ ছাড়াও চতুর্থ শিল্পবিপ্লব রয়েছে, তা যদি বাস্তবায়ন করতে হয়, তাহলে আমাদের জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের নতুন দক্ষতা অর্জনের প্রয়োজন রয়েছে। ক্লাসরুমে এসে আর নতুন দক্ষতা অর্জনের সুযোগ থাকবে না। সুতরাং অনলাইন শিক্ষাই তাদের জন্য বড় সহায়ক হিসেবে কাজ করবে।’

বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক পদ্ধতিতে অনলাইনে শিক্ষার উদাহরণ রয়েছে উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘পাঠ্যবইয়ের কনটেন্ট ই-কনটেন্টে রূপান্তরিত করতে হবে। আমাদের মাইন্ড সেট পরিবর্তন করতে হবে। ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী— যাদের অনলাইনে শিক্ষার সুযোগ (অ্যাকসেস) দিতে পারছি না। কীভাবে দেওয়া যাবে, সে ক্ষেত্রে লোন দেওয়া যায় কি না, ইন্টারনেটের খরচ কমানো যায় কি না, সেটা কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং আইসিটি মন্ত্রণালয় এ নিয়ে কাজ করছে। কোভিড-পরবর্তী সময়েও এটি বহাল রাখতে হবে।’এই প্ল্যাটফর্ম আরও কত ভালো করতে পারা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে উল্লেখ করে ডা. দীপু মনি বলেন, ‘শিক্ষক প্রশিক্ষণ বড় বিষয়। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাইন্ড সেট পরিবর্তন করতে হবে।’

৭.

অনলাইনে বিজ্ঞান শিক্ষা প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘অনলাইনে বিজ্ঞান শিক্ষা কোনোভাবেই করা যাবে না, তা নয়। বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভার্চুয়াল ল্যাবরেটরি রয়েছে। এটি অসম্ভব তা নয়। যত রকমের চ্যালেঞ্জ থাকুক আমরা তা মোকাবিলা করব। আওয়ামী লীগ ও সরকারের নির্বাচনি ইশতেহারেও এটি রয়েছে। আমাদের কোথাও আটকে রাখার সুযোগ নেই। আমাদের আটকে রাখতে পারে আমাদের মাইন্ড সেট। তাই আমাদের মাইন্ড সেট পরিবর্তন করতে হবে।’ করোনাকালে শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে বা স্বল্প মূল্যে ইন্টারনেট প্যাকেজ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন দীপু মনি। তিনি বলেছিলেন, অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এতে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে অনেক শিক্ষার্থীর পক্ষেই ইন্টারনেটের ব্যয় বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য বিনা মূল্যে ইন্টারনেট দিতে অথবা স্বল্প মূল্যে ইন্টারনেট প্যাকেজ দেওয়ার আহ্বান জানান। সে সময় তিনি আরও বলেন, ‘কোভিড-১৯-এর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অনেকেই হয়তো ভর্তির ফি একসঙ্গে দিতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে তারা যেন কিস্তিতে ভর্তি ফি দিতে পারে, সে ব্যবস্থা রাখতে হবে।’

উল্লেখ্য, ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার জন্য শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের সুবিধার্থে ৩টি মোবাইল কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে স্বল্প মূল্যে ইন্টারনেট প্যাকেজের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এছাড়া তাঁর চেষ্টায় জুমে ক্লাস নেওয়ার সুযোগ ঘটেছে শিক্ষকদের।

এসএসসি ও এইচএসসির সিলেবাস কমানো হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত এখনো গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি শিক্ষাবর্ষ নিয়েও। অথচ ২০২০ সালে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, ‘করোনার কারণে চলতি শিক্ষাবর্ষ আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত বাড়তে পারে। পাশাপাশি শ্রেণিঘণ্টার সঙ্গে সমন্বয় করে কমানো হতে পারে মাধ্যমিক স্তরের বিভিন্ন শ্রেণির সিলেবাস। এমন পদক্ষেপের কারণে আগামী বছরে ঐচ্ছিক ছুটি কমিয়ে আনা হতে পারে। যেসব পরীক্ষা এখনো অনুষ্ঠিত হয়নি, সেগুলোর সংখ্যা কমিয়ে আনা যায় কি না, তা-ও ভাবছি। তবে সিলেবাস কমানোর ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর বয়স ও শ্রেণি অনুযায়ী জ্ঞানার্জন ও দক্ষতা অর্জনের ব্যাপারে কোনো আপস করা হবে না।’

আসলে সংকট পুষিয়ে নিতে গত শিক্ষাবর্ষ ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হবে কি না, না ডিসেম্বর পর্যন্ত থাকবে তা ভাবনাচিন্তা চলছিল। শিক্ষাবর্ষ বাড়ানো হলে ২০২১ সালের ঐচ্ছিক ছুটি কমানোর প্রয়োজন হবে। একটি শিক্ষাবর্ষে ১৪০-১৪২ দিন পড়ানো হয়। বাকিটা ছুটি থাকে। তাই ২০২০ সালের শিক্ষাবর্ষ বাড়াতে হলে ২০২১ সালের ছুটি কমিয়ে হলেও তা করা হবে বলা হয়েছিল। তবে এ ক্ষেত্রে বয়স ও শ্রেণি অনুযায়ী শিক্ষার্থীর জ্ঞানার্জন ও দক্ষতা অর্জনের দিকটিতে আপস করা হবে না। কারিগরি শিক্ষায় যতটুকু শিখনফল ও দক্ষতা কাম্য, সেটুকু যদি শিক্ষার্থীরা অর্জন করতে না পারে, তাহলে তাদের সার্টিফিকেট দেওয়া হবে না বলেও মন্তব্য করেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী।

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, ডিজিটাল শিক্ষার যুগে বাচ্চাদের শেখার উপকরণগুলো সহজেই বোধগম্য এবং উপভোগ্য করে তৈরি করা দরকার। তাঁর মতে, পড়াশোনা সব সময় পরীক্ষাকেন্দ্রিক হওয়া উচিত নয়, বরং নীতিবান, দায়িত্বশীল এবং সংবেদনশীল মানুষ গড়তে যেসব শিক্ষা দরকার, তার প্রয়োজনীয়তা অনেক। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘এ স্টপ মোশন অ্যানিমেশনটি শিশুদের জন্য উপযোগী মাধ্যম, ভাষা এবং স্টাইল ব্যবহার করে সংবিধানের চারটি স্তম্ভকে তুলে ধরেছে। যেসব মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক আদর্শ বাংলাদেশের সংবিধানের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, এ অ্যানিমেশন তরুণ প্রজন্মকে সেসব সম্পর্কে শিক্ষিত করে তুলবে।’

উল্লেখ্য, শিশুদের উপযোগী রঙিন রূপক এবং প্রতীক দিয়ে অ্যানিমেশনটি তুলে ধরেছে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির চারটি মূলনীতি—গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ। যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি ছোট মেয়েকে পাখির বাসা তৈরি শেখান, সঙ্গে তিনি বলে যান সেসব পেছনের গল্প, যা জাতির জন্য একটি কাঠামো পরিকল্পনায় তার নীতি-আদর্শকে প্রভাবিত করেছিল।

জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘অনলাইন ও টেলিভিশনের মাধ্যমে শতকরা প্রায় ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থীর কাছে আমরা পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছি। অনলাইনে পাঠদানে আজ নতুন একটি প্ল্যাটফর্ম চালু করা হবে। সব বিশ্ববিদ্যালয় এটি ব্যবহার করতে পারবে।’ এ সময় শিক্ষামন্ত্রী অনলাইন শিক্ষা সহজলভ্য করতে মোবাইল ও ইন্টারনেটের ওপর প্রস্তাবিত শুল্ক প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেন।

২০২০ সালে দেশের তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং এবং ২৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রো-ভিসির পদ ছাড়াও দেশের ১৯টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং ৮৩টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রো-ভিসির পদ শূন্য ছিল। এজন্য ২০২০ সালের ৯ আগস্ট শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শূন্য পদে ভিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে ভিসি পুল গঠন করা হবে। এ লক্ষ্যে ৩১ আগস্ট ২০২০ তারিখের মধ্যে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ সিনিয়র প্রফেসরদের নামের তালিকা ও জীবনবৃত্তান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে আহ্বান জানানো হয়। তিনি ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখের মধ্যে যেসব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রো-ভিসি ও কোষাধ্যক্ষের পদ শূন্য রয়েছে, সেসব শূন্য পদে নিয়োগের জন্য নাম প্রস্তাব করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণেরও আহ্বান জানান। ওই সময়ের মধ্যে তালিকা প্রেরণ করতে না করলে মন্ত্রণালয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে বলে তিনি মিটিংয়ে জানান।

অবশ্য ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মে মাসের মধ্যে ইউজিসি কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির অনিয়ম তদন্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠিয়েছে। সে বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ অদ্যাবধি দেখা যায়নি। অনিয়মের কারণে পদে না রাখার সুপারিশও মানা হয়নি। তবে ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যৌথ প্রচেষ্টায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতি এগিয়ে চলেছে। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সততা এবং ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহর দক্ষতা এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। ৪৯টি পাবলিক, ১০৭টি বেসরকারি এবং ৩টি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করার বিশাল দায়িত্ব এখন ইউজিসির কাঁধে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায় তিন লাখ শিক্ষার্থী এবং ১৫ হাজার শিক্ষক রয়েছেন।

ওয়েবসাইটে বর্ণিত ইউজিসির ইতিহাস ও কার্যক্রম হলো এ রকম—জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে একটি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তুলতে মানসম্মত উচ্চশিক্ষার গুরুত্বকে অনুধাবন করেছিলেন। সে লক্ষ্যে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পরবর্তীকালে ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ১০-এর মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিধিবদ্ধ হয়। সেই সময়ে ইউজিসির কার্যক্রম ছিল তৎকালীন ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক প্রয়োজনীয়তা ও চাহিদা নিরূপণ। সময়ের সঙ্গে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার পরিধি ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করায় বর্তমানে ইউজিসির কার্যক্রমগুলো হলো: সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ প্রদান, উচ্চ স্তরের শিখন-শেখানো পদ্ধতির মানোন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে সহায়তা প্রদান, সর্বোচ্চ উদ্ভাবনী গবেষণা ও উন্নয়নকে উৎসাহিত করা, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সুশাসনসংক্রান্ত বিষয়সমূহের উন্নয়ন ঘটানো। এছাড়া ইউজিসি উচ্চশিক্ষার নীতিমালা এবং আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছানোর লক্ষ্যে মান নিশ্চিতকরণসংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন এবং সে অনুযায়ী সরকারকে পরামর্শ প্রদান করে থাকে।’ গত ২ বছরে দেশের ১০৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে কাজ করেছে ইউজিসি। ২০২০ সালের নভেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সিলেবাস হালনাগাদ করার জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের তাগাদা দেয় ইউজিসি। উল্লেখ্য, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে প্রোগ্রাম অনুমোদনের শর্ত মোতাবেক প্রতিটি প্রোগ্রাম অনুমোদনের তারিখ থেকে প্রতি ৪ বছর অন্তর অন্তর অনুমোদিত সিলেবাসসমূহ কমিশন প্রণীত স্ট্যান্ডার্ড সিলেবাসের গাইডলাইন অনুসরণে হালনাগাদ করার জন্য ২০১৯ সালে নির্দেশনা প্রদান করা হয়। উচ্চশিক্ষার কাঙ্ক্ষিত মান অর্জনের ক্ষেত্রে আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম, বিষয়ে বৈচিত্র্য আনয়ন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নবতর জ্ঞানের দিগন্ত উন্মোচন অপরিহার্য উপাদান। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও গুণগত মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা নিশ্চিতকরণে জরুরি বলে কমিশন মনে করে। অনুমোদিত চলমান প্রোগ্রামসমূহ হালনাগাদ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এজন্যই আবশ্যক।

৮.

৪৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাদ্দের কারণে অনেক কাজ সম্পন্ন হয় না। আবার কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থের অপচয় করা হয়। এ জন্যই ২০২০ সালে বাজেট পাসের পর অক্টোবর মাসে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মদক্ষতা যাচাই করে বাজেট বরাদ্দের কথা বলা হয় বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তরফ থেকে। একই সঙ্গে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহকে সেন্টার অব এক্সিলেন্স হিসেবে গড়ে তুলতে গবেষণায় বরাদ্দের পরিমাণও বৃদ্ধি করা হবে বলে জানায় ইউজিসি। কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে বলা হয়, এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিধা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রযোজ্য নয়।

বাজেট সম্পর্কে ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেছেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক শৃঙ্খলা খুবই দরকার। আর্থিক কাজে ভুলের কোনো সুযোগ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ খাতে এক পয়সা পর্যন্ত ছাড় দেওয়া যাবে না। তবে বাজেটে বরাদ্দকৃত টাকা যাতে অলসভাবে পড়ে না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে তিনি পরামর্শ দেন। তিনি সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারের আইনকানুন মেনে এবং ইউজিসির অনুমোদন নিয়ে দাপ্তরিক কাজ সম্পাদন করার অনুরোধ করেন। ইউজিসি সদস্য প্রফেসর ড. আবু তাহেরও বলেন, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ যাতে সেন্টার অব এক্সিলেন্স হয়, শিক্ষায় গুণগত মান বজায় রেখে এগিয়ে যায় এবং বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে সম্মানজনক স্থান করে নিতে পারে, সে জন্য গবেষণায় বরাদ্ধ বৃদ্ধি করা হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আগামীর বাজেট বরাদ্দ বিষয়ে তিনি বলেন, কর্মদক্ষতা মূল্যায়ন করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বাজেট বরাদ্দের কথা ভাবছে কমিশন। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মদক্ষতা কমে গেলে সামগ্রিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিচে নেমে যায়। মনে রাখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন মানে যথেচ্ছার নয়। আর্থিক বিষয়ের জন্য অবশ্যই ইউজিসির অনুমোদন নিতে হবে। সিনেট-সিন্ডিকেটে অর্থসংক্রান্ত বিষয় পাস করার ক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারের আর্থিক বিধিবিধান ও পে-স্কেল অনুসরণ করতে হবে।

তবে এ কথা ঠিক, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। স্ট্রাটেজিক প্ল্যান ফর হায়ার এডুকেশন ইন বাংলাদেশ-২০৩০-এ শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্ধ বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। তবে খাতওয়ারি বরাদ্দকৃত টাকা প্রয়োজন অনুযায়ী খরচ করাও দরকার।

৯.

সব মিলিয়ে গত ৫০ বছরের মধ্যে করোনাকালে সবচেয়ে ক্ষতির শিকার শিক্ষা খাত। এ জন্য শিক্ষায় ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য শেখ হাসিনা সরকারের নিরলস প্রচেষ্টা যদি শিক্ষকদের সহযোগিতায় ঋদ্ধ হয়, তাহলেই উত্তরণ সম্ভব। অন্যদিকে ছাত্রছাত্রীদের হতাশার হাত থেকে রক্ষার জন্য সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়কেও এগিয়ে আসতে হবে। পাস করার সঙ্গে সঙ্গে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য তাদের পথ দেখিয়ে দিতে পারলে স্বস্তি পাবে পরিবারগুলো। সব প্রতিকূলতা জয় করে শিক্ষার পরিবেশ আশাজাগানিয়া সময়কে ফিরিয়ে আনবে বলে আমরা মনে করি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বিচারে নয় বরং মানসম্পন্ন শিক্ষাদান কেন্দ্রের পক্ষে কথা বলছি। যেসব প্রতিষ্ঠান শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মান বজায় রাখতে পারবে, তারাই বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিশ্বে উজ্জ্বল করে তুলতে পারবে।

 

লেখক: অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Link copied!