পৃথিবীর জনবহুল দেশগুলোতে রেলপথের ভূমিকা বিরাট। কারণ, একটি ট্রেনে একসঙ্গে অনেক যাত্রী চলাচল করতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের নিজস্ব ভৌগোলিক অবস্থা, জনসংখ্যা, অর্থনীতি, কৃষ্টি, সংস্কৃতি অথবা ভৌগোলিক সুবিধা অনুযায়ী বিদ্যমান যোগাযোগ বিকল্পগুলোর মধ্য থেকে অগ্রাধিকার নির্বাচন করে। অবশেষে বিদ্যমান ব্যবস্থাগুলোকে বহাল রাখার পাশাপাশি স্থানীয় বাস্তবতায় সর্বাধিক মানানসই ও লাভজনক বিকল্পটির যথাসাধ্য উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে দেশের সর্বোচ্চ মনোযোগ ও সামর্থ্য বিনিয়োজিত হয়। যোগাযোগের মাধ্যম নির্ণয়ের ক্ষেত্রে খেয়াল করতে হবে কোন মাধ্যমটি তুলনামূলক দ্রুত, কম খরচ ও কম দুর্ঘটনাপ্রবণ মাধ্যম। আমাদের চার ধরনের প্রধান যোগাযোগব্যবস্থা—সড়কপথ, জলপথ, আকাশপথ ও রেলপথ। সবচেয়ে কম ভাড়া দিতে পারে জলপথ, কিন্তু তার গতি খুব স্লো। সবচেয়ে বেশি গতি দিতে পারে আকাশপথ, কিন্তু খুবই ব্যয়বহুল। সবচেয়ে সহজপ্রাপ্য সড়কপথ, কিন্তু তা কিছুটা ব্যয়বহুল ও দুর্ঘটনাপ্রবণ। একমাত্র রেলওয়ে কম খরচে গতি দিতে পারে। দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা সবচেয়ে কম রেলওয়েতে। রেলওয়ে সবচেয়ে বেশি পরিবেশবান্ধব। আবহাওয়া এবং ট্রাফিক জ্যামে সড়কপথে পণ্য পরিবহন যত ক্ষতিগ্রস্ত হয়, রেলওয়ে ততটা হয় না। সুতরাং বর্ধনশীল জনসংখ্যা, বিকাশমান অর্থনীতি, জমির দুষ্প্রাপ্যতা আর অন্যদিকে আকাশপথের টিকিট কেনার অক্ষমতা, নৌপথের সীমাবদ্ধতা, নদীর নাব্যতা হ্রাস, সড়ক অব্যবস্থাপনা ও সীমাহীন দুর্ঘটনা আমলে নিলে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় রেলসেবার গুরুত্ব ও কার্যকারিতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এমন না যে আমাদের রাষ্ট্রের পক্ষে রেলের উন্নয়ন করা সম্ভব না। আমরা মহাকাশে উপগ্রহ পাঠাচ্ছি, সড়কে বিপুল বিনিয়োগ করছি, সমরাস্ত্র কিনছি, লাখ কোটি টাকা পাচার হচ্ছে আর অন্যদিকে কোটি মানুষের প্রিয় দরকারি বাহন রেলের এই অবস্থা কেন? যে দেশে জনসংখ্যা বেশি, জমি কম ও দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে, সেখানে রেলব্যবস্থা জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকার কথা। কিন্তু তা না, গুরুত্ব পেয়েছে হাইওয়ে এবং ব্যক্তিগত গাড়ি।
আমাদের দেশে রেল খাত একসময় লাভজনক ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখন তা লোকসানি খাত। সীমাহীন দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় অবহেলা, মেয়াদোত্তীর্ণ রোলিং স্টক, জীর্ণ কারখানা, লোকবল–সংকট, সময়ানুবর্তিতার অভাব, চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ, টিকিট কেনায় দুর্ভোগ, অপরিছন্ন বগি হলো বর্তমান রেলওয়ের বৈশিষ্ট্য। ব্রিটিশদের পর রেল খাতের উন্নয়ন মোটাদাগে বলতে গেলে হয়নি। অর্ধেকের বেশি জেলায় বলতে গেলে রেল নেটওয়ার্ক নেই। ১৯৪০ সালে বাংলায় যে সড়ক ছিল, বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৫ গুণ। অন্যদিকে রেলওয়ে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত ছিল ২ হাজার ৮৫৮ কিলোমিটার, পরে ১০০ কিলোমিটারের মতো বেড়েছে। আমরা বৈদেশিক ঋণ যা পাই, তা শুধু সড়ক নির্মাণের জন্য। কারণ, সড়কের সঙ্গে যুক্ত আছে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির বাস, ট্র্যাক, নানান ধরনের গাড়ি বিক্রির ব্যবসা। এখন তো প্রতিটি জেলা ও উপজেলা শহর থেকেই ক্ষমতাসীনদের দূরপাল্লার বাস সার্ভিস আছে। তারা কীভাবে চাইবে রেলওয়ের উন্নয়ন!
অন্যদিকে তিলে তিলে আজ মহীরূহ হয়েছে ভারতীয় রেলওয়ে। প্রায় সাত হাজারের বেশি স্টেশন, ১ লাখ ২৬ হাজার ৩৬৬ কিলোমিটারের বেশি রেলপথ, সাড়ে ৭ হাজার ইঞ্জিন, ২ লাল ৮০ হাজারের বেশি কোচ ও মালবাহী বগি নিয়ে প্রতিদিন দেড় কোটি যাত্রী পরিবহন করে ভারতীয় রেলওয়ে। ভারতীয় রেলওয়েকে কেন প্রায় ১৬ লাখ লোককে চাকরি দেওয়ার প্রয়োজন হয়, যা পৃথিবীর যেকোনো কোম্পানির চেয়ে বৃহত্তম কর্মব্যবস্থা। সত্যিই, এক বিশাল কাঠামো! পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী, মরুভূমি, সমুদ্র, গিরিখাত, জঙ্গল সর্বত্র ভারতীয় রেলের জাল ছড়িয়ে আছে। ভারতীয় রেলওয়ে দাবি করে, ‘কোনো কিছু দিয়ে আমরা ভারতীয়দের এক করতে পারিনি, কিন্তু রেলওয়ে দিয়ে পেরেছি।’ সাধারণ রেলট্রাকের বাইরেও ভারতীয় রেলওয়ে তৈরি করেছে দৃষ্টিনন্দন রেলট্রাক। প্রকৃতি ভ্রমণপিপাসু, ধর্মীয় স্থান ভ্রমণপিপাসু এমনকি বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণপিপাসুদের জন্য আলাদা আলাদা রেল ট্যুরের ব্যবস্থা করেছে ভারতীয় রেলওয়ে। যদি সিমলা যেতে চান, তাহলে প্রায় ৫ ঘণ্টারর যাত্রাপথে আপনাকে ১০২টি সুড়ঙ্গ এবং ৮২টি সেতু অতিক্রম করতে হবে। চা-পাতার মিষ্টি গন্ধ আর জঙ্গল পাহাড়ের বুক চিরে ট্রয়ট্রেন আপনাকে নিয়ে যাবে দার্জিলিংয়ে। আকাশ পরিষ্কার থাকে তবে কাঞ্চনজঙ্ঘাও আপনাকে হাতছানি দেবে। গোয়া থেকে কর্ণাটক পর্যন্ত ট্রেনের এই যাত্রাপথটি বিপুল পর্বতমালার বুক চিরে বেরিয়েছে। সেখানে দুধসাগর জলপ্রপাত তো একদম স্টেশনের সঙ্গেই। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যত উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে, গোয়ার সবুজঘেরা শস্যশ্যামলা গ্রাম ছাড়িয়ে আপনি পর্বত ও ঝরনার মাঝে এসে পড়বেন কর্ণাটকে। আপনি যদি চান, তাহলে হিমালয় পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত জম্মুতে একটা ট্রেনে চড়তে পারেন বা ভারতের একেবারে দক্ষিণে কন্যাকুমারীতে যেতে পারেন, যেখানে আরব সাগর, ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর মিলিত হয়েছে। আমাদের পাশেই ধর্মনগর থেকে আগরতলা যেতে দেখতে পাবেন লংতরাই, আঠারোমুড়া, বড়মুরাসহ বিচিত্র পাহাড়ের সৌন্দর্য। পাহাড়ের ভেতর দিয়েই যাবে ট্রেন। চারদিকে দেখতে পাবেন ত্রিপুরার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। একদিকে যেমন দীর্ঘতম রুট ডিব্রুগড় থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত ৪ হাজার ২৭৩ কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করে বিবেক এক্সপ্রেস। সেই সঙ্গে নাগপুর থেকে আজনি এই মাত্র ৩ কিলোমিটারের জন্য রেল পরিষেবা রয়েছে। মূলত অজনী ওয়ার্কশপে যারা কাজ করেন, তাদের নাগপুর থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্যই এই রেল পরিষেবা। শিগগিরই চলবে আহমেদাবাদ-মুম্বাই রুটে বুলেট ট্রেন।
আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দ্বিমত করতে হয়েছে ভারতীয় রেলওয়েকেও। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে নতুন নতুন রেললাইন নির্মাণ করেছে, যাত্রীভাড়া কমিয়েছে, রেলওয়েতে ছাঁটাইয়ের পরিবর্তে ব্যাপক কর্মসংস্থান করেছে। বেসরকারীকরণের পথে না গিয়ে নিজস্ব প্রযুক্তিতে রেল ইঞ্জিন, বগিসহ যাবতীয় সরঞ্জাম তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা পশ্চিমবঙ্গে গেলেই দেখতে পারি সেখানকার লোকাল ট্রেন জনপরিবহন ব্যবস্থার হৃৎপিণ্ড। ধনী থেকে দরিদ্র সবাই এই সস্তা পরিষেবার ওপর বরাবরই নির্ভরশীল। তবে ভারতীয় রেলওয়েরও সীমাবদ্ধতা আছে। ভারতের রেল নেটওয়ার্ক বিশাল হলেও তার সময়ানুবর্তিতায় ঘাটতি আছে। আর উন্নত বিশ্বের রেলের গতির তুলনায় ভারতীয় রেলের গতি খুব কম। সব সীমাবদ্ধতাকে পাশ কাটিয়ে তারা এগিয়ে যাচ্ছে।
ভারতীয় রেলওয়ে প্রতিদিন গড়ে ২ কোটি ৪০ লাখ যাত্রী পরিবহন করে। এ সংখ্যা নিউজিল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড এসব দেশের জনসংখ্যার থেকেও বেশি। ভারতীয় রেলওয়ে এত বড় একটি সংস্থা, যে সংস্থা দিনে ১১ হাজার ট্রেন পরিচালনা করে থাকে। আমরা তো ভারতের অনেক কিছু অনুসরণ করি, ভারতের রেলওয়ের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর চেষ্টা করলে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার কয়েক ধাপ উন্নতি হবে। হাওড়া শিয়ালদহের নাম আপনি নিশ্চিত বলতে পারবেন, কিন্তু কলকাতার কোনো বাসস্ট্যান্ডের নাম বলতে পারবেন? না, কারণ ভারতের দূরপাল্লার বাস মার খেয়ে গেছে রেলওয়ের হাতে। কিন্তু বাংলাদেশে- সায়েদাবাদ গাবতলীর তুলনায় আমাদের কমলাপুর এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ। ভারতে যদি রেলের এই উন্নতি সাধন সম্ভব হয়, তাহলে বাংলাদেশের পক্ষেও সম্ভব। রাষ্ট্র চাইলে আমাদের মুমূর্ষু রেলওয়ের উন্নতি সাধন করে আমাদের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হতে পারে। সে জন্য বাজেটে রেলওয়েকে গুরুত্ব দিতে হবে, বিদ্যমান সম্পদ ও অবকাঠামোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
আসন্ন বাজেটে রেল খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি হোক। প্রতিটি জেলা রেলওয়ের আওতাভুক্ত করা হোক। দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে রেল চলাচলের উদ্যোগ নেওয়া হোক। গুরুত্বপূর্ণ রুটগুলো ডাবল লাইন করা হোক। যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি মালামাল পরিবহনের সুযোগ বাড়াতে হবে। চট্টগ্রাম বিভাগের জেলা শহরগুলোর সঙ্গে রাজশাহী, রংপুর, বরিশাল, খুলনা বিভাগের সরাসরি রেল চলাচলের উদ্যোগ নেওয়া হোক। রেলের দুর্নীতি নির্মূলে সরকারকে কঠোর হতে হবে। ট্রেনের সময়সূচি ও উন্নত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। রেলওয়ের উন্নতি কেবল যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনবে না; অন্যান্য খাতগুলোতেও প্রভাব ফেলবে।
স্বপ্ন দেখি টেকনাফ থেকে রাতে ডিনার করে ট্রেনে উঠব সকালে নামব তেঁতুলিয়ায়। এক বিভাগীয় শহর থেকে আরেক বিভাগীয় শহরে পৌঁছাব ৩-৪ ঘণ্টায়। আমার নিজ শহরে ট্রেনে উঠে মোবাইল স্কিনে চোখ বুলিয়ে দেখব পাশের জেলা শহর। বুলেট ট্রেনের দরকার নেই, মাঝারি গতির ট্রেনেই সম্ভব। রেলওয়ে আমার মৌলিক অধিকার। আমার খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা চিকিৎসা করার জন্য দরকার যোগাযোগব্যবস্থা। রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত আমার ভ্রমণ অধিকার, আমার বৈচিত্র্য গ্রহণের অধিকার, আমার হাওয়াবদলের অধিকার, আমার কর্মসংস্থানের অধিকার, আমার নিরাপদ যাতায়াতব্যবস্থার অধিকার। কেবল বাজেটে আমাদের রেল খাতকে গুরুত্ব দিলেই হবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।