• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বিশ্রাম এবং সেঞ্চুরিয়নে সাকিবের সেলিব্রেশন


অঘোর মন্ডল
প্রকাশিত: মার্চ ১৯, ২০২২, ১২:১৯ পিএম
বিশ্রাম এবং সেঞ্চুরিয়নে সাকিবের সেলিব্রেশন

চাপ সহ্য করারও একটা ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা থাকে। সাকিব আল হাসান সেই ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছেন। সেঞ্চুরিয়নে তার আরেকটা স্টেটমেন্ট দিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিমান ধরার আগে কী চাপটা তৈরি হয়েছিল তার ওপর! অথবা বলা যেতে পারে কী প্রচণ্ড চাপ তিনি নিজেই তৈরি করেছিলেন নিজের ওপর!

সত্যি কথা হচ্ছে, পরিস্থিতি আর প্রেক্ষাপট যা-ই হোক, অসম্ভব চাপ নিয়েই দক্ষিণ আফ্রিকার বিমানে চেপে ছিলেন বাংলাদেশ দলের এই বড় তারকা। কিন্তু সেঞ্চুরিয়নে সেই চাপটা তিনি কি বুঝতে দিলেন কাউকে। তার ব্যাটিংয়ে চাপের কোনো প্রকাশ ছিল না। চোখে-মুখে আতঙ্কের কোনো ছাপ ছিল না। ৬৪ বলে ৭৭ রানের যে ইনিংসটা তিনি খেললেন, সেটাই বাংলাদেশের ইনিংসকে বাড়তি গতি দিল, যা শেষ হলো ৩১৪ রানে। তার ইনিংস ক্রিকেটীয় বিচারে হয়তো তেমন কিছু নয়। কিন্তু জীবনদর্শনে অন্য এক বারতা বহন করে। আর সেটা হচ্ছে, চাপের মুখে দাঁড়িয়ে আপনি যখন আবিষ্কার করবেন আপনার চাপটা তেমন কিছু নয়, তখন নিজেকে হালকা মনে হবে।

জানি, কথাগুলো বলা খুব সহজ। করা ভীষণ কঠিন। সাকিব নিজেকে নিজে কী বলেছিলেন জানি না। তবে বড় বড় ক্রীড়াবিদদের মুখে একটা কথা শোনার অভিজ্ঞতা আছে। যে কাজটা করার দায়িত্ব তার কাঁধে, ফোকাসটা তার ওপরই রাখতে হবে। এখনই যেটা করতে হবে মনঃসংযোগ তাতেই করতে হয়। না হলে কী হবে, তা নিয়ে ভাবলে বিপন্নতা বাড়তে পারে। আতঙ্ক ছড়াতে পারে। মনকে রাখতে হবে কাজের ওপর। ফলের ওপর নয়। ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাভাবনা পরে হবে। তবে এটাও ঠিক, বর্তমানে থাকতে বলা যত সহজ, থাকা তার চেয়ে কঠিন। কিন্তু সাকিব পারেন বলেই তিনি বড় তারকা। সে কারণে তার তারকামূল্যও অন্যদের চেয়ে বেশি।

এই সিরিজে সাকিব বিশ্রাম চেয়েছিলেন। তা নিয়ে অনেক নাটক হয়েছে। সাকিব বিশ্রামে থাকলে ২০ বছর পর দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে বাংলাদেশ প্রথম জয় পেত কি না, তা নিয়ে গবেষণা হতেই পারে। ‘বিশ্রাম’ বা ‘ছুটি’-এর সঙ্গে ক্রিকেটটা মেলাতে গেলে মনে হবে খুব ফালতু বিষয়। অনেকে বলবেন, আপনি পেশাদার ক্রিকেটার। আপনার কাজ খেলা। আপনার আবার ছুটি কেন? আর এক ধাপ এগিয়ে অনেকে বলেছেন; সাকিব তো দেশের জন্য খেলেন না। টাকার জন্য খেলেন! আইপিএলের খেলা হলে কি তিনি ছুটি চাইতেন? হয়তো সাকিবের প্রতি এ দেশের মানুষের আস্থা, বিশ্বাস, ভালোবাসা বেশি, তাই তারা রাগ-ক্ষোভ-অভিমান থেকেই কথাগুলো বলেছেন।

কিন্তু সাকিব ক্রিকেটার। তার আগে মানুষ। রক্ত-মাংসের মানুষ। সাদা চোখে আমরা তাকে কাটাছেঁড়া করে ফেলি। এবং খুব সহজে! সেঞ্চুরিয়নে সিরিজের প্রথম ম্যাচের পর তাকে নিয়ে একটু অন্যভাবে চিন্তা করার সুযোগও বোধ হয় আমরা পেয়ে গেলাম। সেই ভাবনাটা ক্রিকেট এবং জীবনদর্শনকে একই সমান্তরালে রেখে ভাবা যায়। প্রথম ম্যাচ জয়ের পর বাংলাদেশ দলের সেলিব্রেশনের মধ্যমণি হিসেবে থাকার কথা সাকিবের। হয়তো ছিলেনও।
তবে তিনি যে বিশ্রাম চেয়েছিলেন, সেটাও একধরনের সেলিব্রেশন! টিমের সঙ্গে নয়। খেলার ভেতরে নয়। থাকতে চেয়েছিলেন একা। একা একা থাকাটাও একটা সেলিব্রেশন। একাকিত্বেও সেলিব্রেশন! পরের লড়াইয়ের জন্য ওই সেলিব্রশেনটাও ভীষণ জরুরি বলে মনে হয়।

ভাবুন আমরা যারা টেলিভিশনের পর্দায় দক্ষিণ আফ্রিকা-বাংলাদেশ প্রথম ওয়ানডেটা দেখলাম। কী উত্তেজনা নিয়েই না দেখলাম। সেই উত্তেজনার মশালটা আসলে জ্বালিয়ে দিয়ে যান কিন্তু সাকিব আল হাসান। অসাধারণ একটা ইনিংস। ইয়াসির আলীকে নিয়ে বলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দারুণ একটা পার্টনারশিপ। যার ওপর দাঁড়িয়ে যায় বাংলাদেশের ৩১৪ রানের বিশাল স্কোর। কিন্তু তার আগে সাকিব যখন ব্যাট করতে এলেন, তখন তো তিনি একা। রাবাদার মতো ফাস্ট বোলার দুর্মর ছুটে আসছেন। শ্বাপদের মতো ফিল্ডাররা মাঠজুড়ে ওত পেতে আছেন। সবুজ ঘাস বিছানো মাটির গ্যালারিতে প্রবাসী কিছু বাংলাদেশির চিৎকার-চেঁচামেচির আওয়াজ শুনতে শুনতে আমাদের চোখগুলোও কি চলে যায়নি ক্রিজে দাঁড়ানো ওই বাঁহাতির দিকে! বাইশ গজে ওই মুহূর্তে ওই লোকটা একা। সম্পূর্ণ একা। যা কিছু করার, যা কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার, তাকে সেই মুহূর্তে একাকীই নিতে হবে! যদি সে সফল হয় ভালো। না হলে, তার চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করার দায়িত্ব ভারত মহাসাগরের এপারে বসেও আমরা নিতাম! যদি তিনি না পারতেন, তাহলে মাথা নিচু করে প্যাভিলিয়নের দিকে হেঁটে যাওয়া মানুষটার মানসিকতার কথা কি ভাবতাম?

আসলে আমরা ক্রিকেট দেখি শুধু প্রিয় দল আর প্রিয় ক্রিকেটারের সাফল্য দেখার জন্য। সফল না হলে আমরা মূহ্যমান হয়ে পড়ি। কখনো হেরে যাওয়া মানুষটার পাশাপাশি হাঁটতে চাই না।

শুক্রবার অবশ্য ব্যর্থ সাকিবের বিষণ্নতার সঙ্গে একাত্মবোধ করতে হয়নি কাউকে। সাকিবের ’বিশ্রাম’ নামক একাকিত্বের সঙ্গে নৈকট্যবোধ করেছি।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক
 

Link copied!