পরিবেশ দূষণকারীদের কাছে ‘নেট জিরো’ কথাটি বেশ জনপ্রিয়। কারণ কার্বন নির্গমন বন্ধ কিংবা এর উপর কর আরোপের চাইতে “বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ শূন্যে নামিয়ে আনার” আশ্বাস দেয়াটা বেশি সহজ।
“দুনিয়ায় টাকার কোন অভাব নাই তবে সেটা উপযুক্ত খাতে ব্যবহারের উদ্যোগের অভাব আছে।” - জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক দূত ও ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের সাবেক গভর্নর মার্ক কার্নি। ১৩০ লক্ষ কোটি ডলার মূল্যের সম্পদের মালিক দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি।
বিশ্ববাসী এখন কি চায়? বিশ্বের সবাই মিলে যদি একটা গণভোট আয়োজন করা যেত, তাহলে নিঃসন্দেহে একটাই সিদ্ধান্ত পাওয়া যেত। আর সেটা হল: “যেকোন মূল্যে এই মুহূর্তে কার্বন নিঃসরণ বন্ধ করুন।”
অথচ আমরা সবাই মিলে এই একটা সিদ্ধান্তই নিতে পারছি না। জাতিসংঘের কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলনের এমন ব্যর্থতা যেন আটলান্টিক মহাসাগরের চারপাশের দেশগুলোর ব্যর্থ গণতন্ত্রেরই প্রতিফলন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন যখন স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে করছিলেন, তখন ওয়াশিংটনে কংগ্রেসের সিনেটররা কার্বন নিঃসরণ বন্ধ করা আর নবায়নযোগ্য জ্বালানীতে বিনিয়োগের অবকাঠামোর বিল পাশ কোরানোর চেষ্টায় আছেন। রাস্তাঘাট ও বিমানবন্দরের অবকাঠামো নির্মাণের মত কার্বন নির্গমনকারী প্রকল্পে অর্থায়ন সীমিত করতে এই পদক্ষেপ কাজে আসবে।
এদিকে পরিবেশ রক্ষায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে ‘আশাব্যঞ্জক’ হিসেবে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করলেও বাস্তবে এসবের কোন কার্যকারিতাই নেই। আজ নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্পকে সবুজ সংকেত দিয়ে রাশিয়ার কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক গ্যাস কিনতে উন্মুখ হয়ে আছে জার্মানি। অথচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচিত ছিল ইউরোপের সব দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার শুরুর উদ্যোগ নেওয়া। কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে আমাদের নেতাদের কোন কথাই বলতে দেখি না।
কপ-২৬ এর ব্যর্থতার পেছনে মূলত ৩টি কারণ রয়েছে। প্রথমটি হল বিশ্বব্যাপী যৌথ উদ্যোগের নামে যার যেমন খুশি তেমন চলা। বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আর ধনী দেশগুলোও যেমন সেন্ট অগাস্টিনের প্রার্থনার মতো বলছে, “প্রভু, দয়া করে আমাকে পবিত্র রেখো, তবে শুধু এবারের মতো ক্ষমা করে দাও।”
পৃথিবীতে আর কেউ যেন অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ না করে - এটা সবাই চায়। কিন্তু কার্বন নিঃসরণ বন্ধের প্রকল্পের জন্য যে অর্থ খরচ করতে হবে সেখানে সবাই তড়িঘড়ি করছে, যাতে করে কোনভাবে এর দায় থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
পৃথিবীর সবাই যদি সঠিক কাজ করে, তাহলেই গ্রহটিকে রক্ষা করা সম্ভব। তখন কেউ একজন যদি স্বার্থপরভাবে নিজের এলাকার পরিবেশ বাঁচাতে না চায়, তাতেও কিছু আসে যায় না। কিন্তু কেউই যদি সঠিক কাজটি না করে, তাহলে একজনই বা কেন করবে?
দ্বিতীয় কারণটি বিশ্বব্যাপী সমন্বয়ের অভাব। কার্নি যেমনটা বলেছিলেন: বিশ্ব অর্থনীতিতে পাহাড় সমান নগদ অর্থ অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। এর মালিকরাও কার্বন নিঃসরণ সমানোর জন্য বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। কিন্তু ব্যক্তিগত বিনিয়োগের মাধ্যমে কার্বনের পরিবর্তে গ্রীন হাইড্রোজেন উৎপাদন করে লাভবান হওয়া সম্ভব নয়। যখন অন্য বিনিয়োগকারীও এতে অংশ নেবে তখনই সবাই লাভবান হবে। তাই বিনিয়োগকারীরা কে আগে বিনিয়োগ করবে সেই অপেক্ষাতেই বসে আছে।
সেকারণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আর রাষ্ট্রগুলোও একই অপেক্ষায় আছে। যতক্ষণ না বড় কোন বিনিয়োগকারী এগিয়ে আসে, ততক্ষণ কেউই কার্বন নিঃসরণ বন্ধের ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। দুঃখজনকভাবে কোন আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর একার পক্ষে এসব প্রকল্পের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ, প্রযুক্তি ও অবকাঠামোগত সুবিধা প্রদান করা সম্ভব না।
সহজভাবে বলতে গেলে, তৃতীয় কারণটি হচ্ছে পুঁজিবাদ। অনেক আগে থেকেই পুঁজিবাদ সবকিছুকে ভোগ্যপণ্যে পরিণত করেছে। জমিজমা, শ্রম কিংবা প্রযুক্তি থেকে শুরু করে জিনগতভাবে পরিবর্তিত প্রাণী, কৃত্রিম মাতৃগর্ভ এমনকি উল্কাপিণ্ডও এখন পণ্য। পুঁজিবাদের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে মূল্যহীন জিনিসও দামী পণ্যে পরিণত হয়েছে। উনিশ শতকের শ্রমজীবী শ্রেণী যত বেশি কাল্পনিক ভোগবাদের দিকে অগ্রসর হয়েছে, প্রযুক্তি সেবা দানকারী আর পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তত বেশি লাভ করেছে।
যেকোন ভালো জিনিসই আজ পণ্য। আমাদের মানবতাও অনেকটাই তাই। আর আমাদের এই ভোগবাদের উচ্ছিষ্টই ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে বায়ুমণ্ডলে। পুঁজিবাদীদের জ্বালানি যোগাতেই ভূপৃষ্ঠের নীচে হাজার হাজার বছর ধরে জমে থাকা জীবাশ্ম উত্তোলন করা হচ্ছে। দুই শতাব্দী ধরে অঢেল সম্পদ আর মানুষের দুর্ভাগ্য তৈরি হয়েছে বিনামূল্যের প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন করে, বিশেষ করে কার্বনকে নির্গমনের মাধ্যমে। আর এখন প্রকৃতিকে ধ্বংসের মূল্য দিতে হচ্ছে সারা বিশ্বের শ্রমিকদের। কিন্তু পুঁজিবাদীরা কখনোই এর দায় নেয়নি।
মুক্ত-বাণিজ্যের প্রতিনিধিরা আমাদেরকে বিশ্বাস করাতে চায় ব্যবসা-বাণিজ্য আজ বিজ্ঞানের মত উৎকর্ষতায় পৌঁছেছে। সরকারের অবর্তমানে তারাই যেন সরকারের দায়িত্ব পালন করে।
এক মুহুর্তের জন্যেও এমনটা বিশ্বাস করা ঠিক না। কার্নি ঠিকই বলেছেন, সবুজায়নের জন্যে যে অর্থ প্রয়োজন সেটা আমাদের আছে, অঢেল আছে। নিঃসন্দেহে যারা এর মালিক, তারা জলবায়ু রক্ষায় বিনিয়োগ করবে, যদি আমরা তথা আমাদের সমাজ তাদেরকে বাধ্য করে। কিন্তু একইভাবে তারা কার্বন নির্গমনকারী শিল্প প্রকল্পগুলোও স্বেচ্ছায় বন্ধ করবে না।
আর সেকারণেই পরিবেশ দূষণকারীরা ‘নেট জিরো’ বা কার্বন নির্গমন শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যকে স্বাগত জানায়। কেননা নির্গমন ‘বন্ধ’ না করার জন্য এই আশ্বাসকেই অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা যায়। যতক্ষণ না তাদের আয় মূলধনকে ছাড়িয়ে যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা পৃথিবীর অবশিষ্ট জীবাশ্মকে লুট করবে।
‘নেট জিরো’ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের মাধ্যমে দূষণকারীদের জন্য কপ-২৬ একটা ঢাল ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি। কপ-২৬ এর আড়ালে ‘পরিবেশ পুনরুদ্ধারের জন্যে আমাদের পর্যাপ্ত অর্থ আছে’ এই সত্য কথাটি বারবার বলে তারা নতুন প্রজন্ম, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ এমনকি নিজেদের কাছেও মিথ্যাচার করছে।
তাহলে আমাদের কি করা প্রয়োজন? আমরা অন্তত দুটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি। প্রথমত, সব কয়লাখনি, নতুন তেল ও গ্যাসক্ষেত্র সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে। সরকার যদি মহামারি থেকে বাঁচাতে লকডাউন জারি করে আমাদের ঘরে আটকে রাখতে পারে, তাহলে সমগ্র মানবজাতিকে বাঁচাতে জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহারও বন্ধ করেতে পারবে।
দ্বিতীয়ত, সারা বিশ্বের জন্য কার্বন ট্যাক্স নির্ধারণ করতে হবে। যে দেশ যত বেশি কার্বন নিঃসরণ করবে তারা সেই আনুপাতে দরিদ্র দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিবে।
মানবজাতি যে মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে, তার মোকাবেলা করতে আমাদের আগে জীবাশ্ম জ্বালানী উৎপাদনকারী ও এর অর্থদাতাদের জবাবদিহি করতে হবে। এই পদক্ষেপটি আমাদের ভবিষ্যতকে সুরক্ষিত না করলেও, অন্তত ভবিষ্যতে বেঁচে থাকার জন্য আমাদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখবে।
ইয়ানিস ভারুফাকিস
(সহ-প্রতিষ্ঠাতা, ডেমোক্রেসি ইন ইউরোপ মুভমেন্ট)
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান
অনুবাদ: অনন্যা পাল