• ঢাকা
  • রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

গণমাধ্যমে গণরুচির বিকৃতির জন্য দায়ী কে?


মোহাম্মদ নূরুল হক
প্রকাশিত: মার্চ ২৪, ২০২২, ১১:১৮ এএম
গণমাধ্যমে গণরুচির বিকৃতির জন্য দায়ী কে?

গণমাধ্যম কেবল তথ্যভান্ডার নয়, জ্ঞানাগারও। তাই পত্রিকা-নিউজ পোর্টাল-টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে কেবল সংবাদ প্রকাশ করলেই চলে না, সমাজে সেই সংবাদের বিরূপ প্রভাবের বিষয়টিও ভাবতে হয়। না হলে গণমাধ্যম মুনাফালোভী, কাটতি-হিট-টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট (টিআরপি)কামী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেই পর্যবসিত হতে বাধ্য। রুচিশীল সংবাদকর্মী-পাঠক-সুশীল সমাজ যতই এসব নৈতিকতা-আইন লঙ্ঘন ও রুচির বিকৃতির প্রতিবাদ জানায়, কতিপয় গণমাধ্যম তাতে কেয়ারই করে না। তাদের ভাবখানা এমন যে, ‘তারা কারও খায় না, কারও পরেও না’। সুতরাং তাদের পরিবেশিত সংবাদের কারণে সমাজের কোথায় কার সম্মান গেল, কে প্রাণ হারাল, তাতে কিছু আসে-যায় না। তাদের দরকার কাটতি-হিট-টিআরপি। এজন্য কতিপয় গণমাধ্যম বস্তুনিষ্ঠতা-জনস্বার্থশ্লিষ্টতার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার ভাইরাল কনটেন্টে। যা কিছু ভাইরাল, তার সঙ্গেই কতিপয় গণমাধ্যমের হরিহর আত্মা-সম্পর্ক।  

শুরুতেই বলেছি, গণমাধ্যমে কেবলই তথ্যভান্ডারই নয়। যদি শুধুই তথ্যভান্ডার হতো, তাহলে তথ্য অর্থাৎ যেকোনো বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করলেই তার দায় শেষ হতো। কিন্তু গণমাধ্যমকে কেবল তথ্য প্রকাশ করলেই চলে না; তাতে সমাজের উপকারিত কতটুকু হচ্ছে, অবিচার-অনাচার কতটা দূর হবে, তা-ও ভেবে দেখতে হয়। একই সঙ্গে পাঠককে ধর্ম-দর্শন-বিজ্ঞানের জ্ঞানও দেওয় সংবাদপত্র। এ কারণেই গণমাধ্যমে জ্ঞানভান্ডার বলা হয়। গণমাধ্যম যদি জ্ঞানভান্ডার হয়েই থাকে, তাহলে তাকে জ্ঞান বিতরণের বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন অবশ্যই করতে হবে। কোন তথ্য কতটুকু প্রকাশ করবে, কোন তথ্য এড়িয়ে যাবে, তা-ও ঠিক করতে হয় তাকে। যারা এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ, তাদের কোনোমতেই দায়িত্বশীল গণমাধ্যম বলা যায় না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই গণরুচির বিকৃতি? এর উত্তর খুঁজতে গেলে বেশ কয়েকটি কারণ সামনে চলে আসবে। এগুলো হলো:

১। প্রচার-হিট-টিআরপিতে সবার চেয়ে এগিয়ে থাকার প্রতিযোগিতা
২। স্থূল রুচির জোগান দেওয়া
৩। বিশেষ ব্যক্তি-গোষ্ঠীর প্রত্যাশা পূরণ কিংবা নির্দেশ পালন
৪। শ্রেণিবিদ্বেষ ও কুরুচিপূর্ণ ব্যক্তি-গোষ্ঠীর লালসাপূরণ
৫। আইন-নৈতিকতা-সুরুচির প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন
৬। মানুষের প্রতি সম্মানবোধ না থাকা

কোনো কোনো নিউজ পোর্টাল জনদুর্ভোগের মতো জনস্বার্থশ্লিষ্ট কনটেন্ট প্রকাশের চেয়ে কোন নায়িকা বাসরঘরে তার স্বামীকে কী বলেছিলেন, কিংবা কোন নায়িকা গোসলের ভিডিও ভাইরাল হলো, সেই কনটেন্ট ভিডিওসহ প্রকাশ-প্রচারের দৌড়ে শামিল হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে একশ্রেণির পাঠক-দর্শকের স্থূল রুচির জোগান দিচ্ছেন তারা। এতে হিট-টিআরপি বাড়ার প্রতিযোগিতায় এগিয়েও থাকছেন। এভাবে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার জন্য কতিপয় গণমাধ্যম নায়িকার বেডরুমের রগড় বর্ণনার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সংবেদনশীল বিষয়কেও প্রতিবেদন আকারে উপস্থিত করছে।

এবার আসা যাক, সমাজের বিশেষ শ্রেণির ব্যক্তি-গোষ্ঠীর প্রভাব-প্রত্যাশা। তাদের ইচ্ছার কাছে অনেক সময় গণমাধ্যমকে নতি স্বীকার করতে হয়। এর মধ্যে এনজিও, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-সংগঠন, বিজ্ঞাপনদাতা গোষ্ঠীও রয়েছে। তাদের রুচির জোগান দেওয়া ও তাদের স্বার্থরক্ষার জন্যও অনেক সময় গণমাধ্যমকে নৈতিকতার সীমা লঙ্ঘন করতে হয়। যেমন, কোনো ধর্ষণ মামলার প্রতিবেদনে কোনো প্রভাবশালী ধণিক শ্রেণির পুরুষের নামে অভিযোগ উঠলে তখন অভিযুক্ত ব্যক্তির ইচ্ছার কাছে গণমাধ্যমকে নতি স্বীকার করে ধর্ষণের শিকার নারীর বিরুদ্ধেই প্রতিবেদন ছাপতে দেখা যায়। এসব প্রতিবেদনে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে যতটা দানবীর, দয়ালু, ধর্মভীরু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, ঠিক ততটাই ধর্ষণের শিকার নারীকে চরিত্রহীনা, প্রতারকচক্রের সদস্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এ ক্ষেত্রে স্বার্থান্বেষী মহল প্রভাবশালী-ধনিক শ্রেণির হওয়ায় তাদের নির্দেশে গণমাধ্যম মেনে চলে। বিষয়টির সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক জড়িত থাকতে পারে। এই ক্ষেত্রে ‘অর্থ যার, ইচ্ছা তার’ নীতিই প্রাধান্য পায়।

এরপর আছে শ্রেণিবিদ্বেষ ও ব্যক্তি-গোষ্ঠীর লালসা পূরণের বিষয়টি। বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠী প্রায় নিজের ক্রোধ-আক্রোশ মেটাতে গিয়ে বিশেষ শ্রেণির ওপর চড়াও হয়। তারা কোনো সাধারণ শ্রেণির মানুষকে কিংবা নিজের প্রতিপক্ষকে কাবু করতে চাইলে আগে থানা-পুলিশ ও মামলাকে হাতিয়ার করত। এখন ব্যবহার করে গণমাধ্যমকে। কাউকে সামাজিকভাবে হেনস্তা করতে চাইলে তার বিরুদ্ধে কল্পিত অভিযোগের প্রতিবেদন প্রকাশই হয়ে ওঠে মোক্ষম অস্ত্র। গণমাধ্যমে কোনো না কোনো উপায়ে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে সংবাদ প্রকাশ করাই তখন তাদের লক্ষ্য হয়ে ওঠে। আর এই ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশে কোনো কোনো গণমাধ্যমকে দায়সারা ভাব নিতেও দেখা যায়। 

এসব কাজে স্বার্থান্বেষী মহলের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অতি উৎসাহী হতে দেখা যায়। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে কিংবা বিশেষ অভিযানে কাউকে আটক করলে সেই ব্যক্তিদের নিয়ে প্রেস ব্রিফিং করে তারা। একজন মানুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠা আর তার অপরাধ প্রমাণিত হওয়া এক কথা নয়। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেই তাকে অপরাধী হিসেবে গণমাধ্যমে পরিচয় করিয়ে দেওয়া কতটা নৈতিক ও আইনসম্মত? শুধু পরিণত বয়সের অভিযুক্তদের ক্ষেত্রেই নয়, কিশোর-কিশোরীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেও তাদের অপরাধী হিসেবে মিডিয়ার সামনে উপস্থিত করে ব্রিফ করে আইনশৃ্ঙ্খলা বাহিনী। সেই ব্রিফকে ধ্রুব জ্ঞান করে গণমাধ্যম প্রতিবেদন প্রকাশ করে।  

এমনই একটি ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি। দেশের দুই জেলার দুই সমপ্রেম এক কিশোরীর টানে আরেকজন বাড়ি ছেড়েছে। বিষয়টিকে ইস্যু করে কয়েকটি গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করেছে। এমনকি কোনো কোনো অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও টিভি চ্যানেল ওই কিশোরীদের নামপরিচয়সহ ছবিও প্রকাশ করেছে। সঙ্গে দিয়েছে ভিডিও সাক্ষাৎকারও। অথচ এই ধরনের সংবাদ প্রকাশ সম্পূর্ণরূপে আইন ও নৈতিকতা পরিপন্থী। প্রথমত মূল ঘটনাটি সংবেদনশীল, দ্বিতীয়টি সংশ্লিষ্ট দুজনই কিশোরী। আমাদের মনে রাখতে হবে, কিশোর অপরাধ নামে আইন আছে, এটা সত্য। বাস্তবতা হলো, কিশোররা অপরাধ করে না, তারা ভুল করে। অপরাধের জন্য শাস্তি দিতে হয়, কিন্তু ভুলের জন্য নয়। ভুলের প্রতিকার শাস্তিতে নয়, সংশোধনেই। এর মধ্য দিয়ে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনমুখী করে তুলতে হয়। এই কিশোরীদের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। এই কিশোরীদের যথাযথভাবে কাউন্সেলিং করলে তারা স্বাভাবিক জীবন-যাপনে ফিরেও আসতে পারে। দুজনেই দুজন পুরুষ সঙ্গীও বেছে নিতে পারে। আর দশজন নারীর মতো তারা ঘরও বাঁধতে পারে। এর আগেই, কিশোরীদের নামধাম-ছবিসহ সংবাদ প্রকাশের কারণে সমাজ তাদের বিদ্রূপ করতে পারে। সমাজে ধর্মান্ধ ও উগ্রপন্থীদের কোপানলে পড়তে এই কিশোরীরা। গণমাধ্যম দুই কিশোরীর নামধামসহ ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করায় তাদের ভবিষ্যৎ জীবনকে ঝুঁকিতে পড়তে পারে। বিষয়টি গণমাধ্যমের কর্তাব্যক্তিদের মনে রাখা উচিত ছিল। 

মনে রাখতে হবে, কাউকে তার কর্মের জন্য দোষী সাব্যস্ত করতে হলে আগে তার শারীরিক ও মানসিক বয়সের দিকটি দেখতে হয়। শিশু-কিশোররা শারীরিকভাবে যেন অপরিণত বয়সী, তেমনি মানসিকভাবেও পরিপক্ব। অপরিণত বয়সী ও অপরিপক্ব মানসিকতার ব্যক্তির ভুল পরিণত বয়সের পরিপক্ব মানসিকতার ব্যক্তির অপরাধের সঙ্গে এক করে বিচার করা যায় না। পরিণত বয়সীদের যে কাজটি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়, সেই একই কাজকে অপরিণতদের জন্য ভুল হিসেবে দেখা হয়। তাই অপরাধের জন্য পরিণত বয়স ও পরিপক্ব মানসিকতার ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া হয়, আর অপরিণত বয়সী ও অপরিপক্বদের সংশোধনাগারে পাঠানো হয়। ঘটনা একই হলেও শাস্তি প্রতিকারের ধরন একই হয় না। তাই অপরিণত বয়সীদের নামধাম-ছবি প্রকাশ করে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার পথ রুদ্ধ করে দেওয়া গণমাধ্যমের উচিত হবে না। একই সঙ্গে ধর্ষণের শিকার নারী-শিশুর প্রতিও সংবেদনশীল আচরণ করা উচিত। কিন্তু বর্তমান কয়টি গণমাধ্যম সেই সংবেদশীল আচরণ করছে, সময় এসেছে সেই বিচার করার। 

গণমাধ্যমগুলোয় রুচির বিকৃতি ঘটার রয়েছে আইন-নৈতিকতা-সুরুচির প্রতি অবজ্ঞা। এছাড়া, মানুষের প্রতি সম্মানবোধ না থাকাও এই ধরনের সংবাদ প্রকাশের বড় কারণ। এসব গণমাধ্যম হয়তো স্বীকার করে না, মানুষকে সম্মান দিলে নিজের সম্মান বাড়ে। অন্যকে অসম্মান করলে, নিজেকেই অপমানিত করা হয়। ক্রমাগত মানুষকে অসম্মান-অপমান করতে থাকলে একদিন নিজের জন্যই শোচনীয় পরিণতি ঠেকানো যাবে না। আর ওই পরিণতি ঠেকাতে হলে গণরুচির বিকৃতির জন্য দায়ীদের শনাক্ত করতে হবে। এসব অনৈতিকতার জন্য দায়ীদের শনাক্ত করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।

Link copied!