• ঢাকা
  • সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কলকারখানা খোলা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ কেন?


ফিরোজ আহমেদ
প্রকাশিত: আগস্ট ১, ২০২১, ০৮:০৯ পিএম
কলকারখানা খোলা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ কেন?

১.

নৃশংসতার শিকার ছাড়া আর কী বলবেন গ্রাম থেকে শহরমুখী মানুষের এই দৃশ্যগুলোকে! একবার বলা হলো, ৫ আগস্ট পর্যন্ত কঠোরতম লকডাউন, তারপর হুট করে ১ তারিখ থেকে পোশাক কারখানা খুলে দেওয়ার ঘোষণা এলো, এই কথার কী দাম থাকতে পারে? এটা এই কোভিডের মরণ সময়েও বহুবার ঘটল, একবার কারখানা বন্ধ, মানুষজন হুড়মুড় করে গ্রামে গেল, আবার কারখানা খোলা, পাগলের মতো মানুষ ফিরে এলো—এটা স্রেফ পাগলামি। মহামারি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত ‘জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি’ নামের পর্ষদটিও লকডাউনকে আরও কিছুদিন বাড়ানোর প্রস্তাব করছিলেন, সরকারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও যখন সমর্থনসূচক বক্তব্য দিয়েছেন, গণমাধ্যমেও যখন তেমনই বার্তা এসেছে সরকারের দিক থেকেও, তখন হুট করে জানিয়ে দেওয়া হলো কারখানা খোলার এই সংবাদ। দুটো বিষয় এখানে দেখার মতো:

ক. মহামারি দেশে যখন তীব্রতম, তখন কারখানা খোলার এই সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী হলো কি না।

খ. কারখানা যদি খুলতেই হবে, তাহলে কেন পরিবহন খোলা হলো না আগে?

সব দেখে পরিষ্কারভাবেই বোঝা যায়, এটি নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর কাছে আত্মসমর্পণ। নানান বিশেষজ্ঞরা নানান কিছু ভাবতেই পারেন, কিন্তু শেষ ভাবনাটা পোশাক কারখানার মালিকরাই রাষ্ট্রের হয়ে ভেবে দেন, সেটা আরেকবার প্রমাণিত হলো মাত্র। ব্যক্তিগতভাবে পোশাক কারখানার মালিকরা হয়তো সর্বেসর্বা নন, কিন্তু গোষ্ঠী হিসেবে তাদের সঙ্গে তুলনীয় এই রাষ্ট্রে আর কেউ নেই। বাকিরা সবাই তাদের স্বার্থ রক্ষাটাকেই একমাত্র কর্তব্য হিসেবে জ্ঞান করেন।

 

২.

পোশাক কারখানা যদি খোলা থাকতে পারে, তাহলে শিক্ষার দোষটা কী? বাংলাদেশে পুরো করোনার সময়টাতেই পোশাক কারখানা খোলা ছিল। শ্রমিকদের কারখানায় যেতে হয়েছে, আসতে হয়েছে, খেতে হয়েছে। এখন পোশাক কারখানা খোলা, এখনো তাই হবে।

তাহলে জনগণের বড় অংশের মধ্যে কার্যত কোনো লকডাউনের অস্তিত্ব থাকছে না। বিশেষ করে যেভাবে গাদাগাদি করে তারা শহরে আসতে বাধ্য হলেন, এবং সেটা মহামারির এই রকম উত্তুঙ্গ পর্যায়ে, তারপর আর জনগোষ্ঠীর এই অংশের মাঝে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা, না রক্ষায় কিছু আসে যায় কি না, সেটা বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন। আমাদের কাণ্ডজ্ঞান বলছে, আসে যায় না।

তাহলে জনগণের এত বিপুল অংশ যদি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে ব্যর্থ হন, তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে রাখার কী তাৎপর্য থাকতে পারে?

বিদ্যালয় খুলে রাখলে শিক্ষার্থীর কাছ থেকে পরিবারের অন্যরা সংক্রমিত হতে পারেন, তেমনি কারখানা খোলা রাখলে শ্রমিকের কাছ থেকে পরিবারের সদস্যরা একই নিয়মে সংক্রমিত হতে পারবেন।

আমরা দেখলাম পাঁচশ দিনেরও বেশি সব বিদ্যালয় বন্ধ, এটা কি অনিবার্য ছিল? না, দুনিয়ার সভ্য কোনো দেশেই করোনার পুরো সময়টা এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখেনি। করোনাতে মৃত্যুর হার আমাদের চাইতে বহুগুণ বেশি, এমন প্রায় সব কটি দেশই সংক্রমণ কমামাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে, বাড়া মাত্র বন্ধ করেছে। অর্থাৎ যাকে বলা যায়, নমনীয় থেকেছে। যেমনটা বলেছেন ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ১২ জুনের একটা  বিবৃতিতে: ‘বিদ্যালয় বন্ধ করা উচিত সবার শেষে, শুরু করার উচিত সবার আগে’।

কিন্তু এই নমনীয় থাকার পদ্ধতি বহু সরকার গ্রহণ করেনি। যেমন পানামার বিষয়ে এ বছরের মার্চে একটা ধিক্কার ছিল অন্তর্জালজুড়ে : ‘জুয়ার আখড়া খোলা, বিদ্যালয় বন্ধ।’

কেন এই নমনীয়তা কোনো কোনো সরকার দেখাতে পারেনি? প্রধানত দেখা যাবে চরমভাবে অদক্ষ ও আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোই এই কাজে ব্যর্থ হয়েছে। কীভাবে?

সংক্রমণ বৃদ্ধি পরিমাপের জন্য প্রয়োজন পরিকল্পিত উপায়ে পরীক্ষা, জনগোষ্ঠীকে একেকটা বর্গ বা সম্প্রদায় ধরে তাদের মধ্যে করোনার মাত্রা পরীক্ষা করা। এই বর্গগুলো হতে পারে পুলিশ, দোকানদার, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, পরিবহনশ্রমিক, পোশাকশ্রমিক ইত্যাদি। তারপর তাদের মধ্যে করোনার প্রাদুর্ভাবের মাত্রা জানলেই বোঝা যাবে কখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যাবে, কখন তা বন্ধ করতেই হবে।

যেমন এখন করোনার সংক্রমণ তীব্র। এখন প্রয়োজন ছিল সর্বব্যাপী যে লকডাউন দেওয়া হয়েছে, সেটাকে অন্তত আরও কিছুদিন কার্যকর রাখা, জনগণের খাদ্য ও আন্যান্য রসদের জোগান দিয়েই।  কিন্তু এখনই খুলে দেওয়া হলো সবকিছু।

অন্যদিকে ভারতীয় ডেলটা সংস্করণটি দেশে প্রবেশের আগে দেশের অধিকাংশ স্থান ছিল তীব্র প্রাদুর্ভাবমুক্ত। বলা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদ দিয়ে সবকিছুই খোলা ছিল। তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে পরিকল্পিত উপায়ে খোলা রাখলে সংক্রমণ বৃদ্ধির উনিশ-বিশ হতো, এমনটা বলার কোনো উপায় নেই।

অথবা, একেকটা জেলা বা অঞ্চলওয়ারি করোনার বৃদ্ধির সময়ে সেখানটাতে সবকিছুকে আক্ষরিক অর্থেই বন্ধ করে দিয়ে এবং সেখানকার দরিদ্র/অক্ষম মানুষকে যথাবিহিত খাদ্যসহায়তা দিয়ে বাকি দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা যেত।

অর্থাৎ মোদ্দা কথা হলো, গোটা দেশে একসঙ্গে একবারে লকডাউন দিয়ে করোনা ঠেকানো যায়নি, মানুষের সঞ্চয় ও জীবিকা ধ্বংস হয়েছে, শিক্ষার্থীদের অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অথচ পরিকল্পিত লকডাউন দিলে করোনার ডেলটা সংস্করণকে বাংলাদেশে আসা বন্ধ করা যেত, যেত সেগুলোকে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে সীমিত রাখা, এবং সেখানে নিয়মিত খাদ্যসাহায্য দিয়ে কার্যকর লকডাউন নিশ্চিত করে দ্রুত সংক্রমণের সময়টা অতিক্রম করাও সম্ভব হতো। এই সময়টাতে বাকি দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু রাখতে না পারারও কোনো কারণ ছিল না। বরিশাল বিভাগের কোনো কোনো জেলাতে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে যখন পার্শ্ববর্তী খুলনা বিভাগে তীব্র সংক্রমণ চলছিল।

 

৩.

শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো আমরা সবাই জানি ও বুঝি। বিদ্যালয়ে না যেতে পারার দরুন অনেক শিশুই অক্ষরজ্ঞান ভুলে গেছে। সবারই শিক্ষাজীবন পিছিয়ে গেছে। তাদের সামাজিক দক্ষতায় বিপুল ঘাটতি তৈরি হবে, কেননা, বিদ্যালয় এই কাজটা করে। বহু শিশুর মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা তৈরি হওয়ার কথা। অনলাইনে যে ভাগ্যবান শিশুরা পড়েছেন, তারাও এই সমস্যাগুলো থেকে সর্বাংশে মুক্ত নয়।

ওদিকে শিক্ষকরা? কিছু বাছাই করা বিদ্যালয় বাদ দিলে শিক্ষকদের পরিস্থিতি ভয়াবহ। একদিকে আছে মর্মযাতনা, দায়িত্ব পালন করতে না পারার। তার সঙ্গে বিপুল অংশের বেসরকারি শিক্ষক সমাজ তাদের পেশা ও জীবিকা থেকে বঞ্চিত হয়ে দুঃসহ জীবন যাপন করছেন, অনেকেই পেশা বদলেছেন। এর বড় কারণ বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়নি এবং ভর্তি হওয়াদেরও একটা বড় অংশ মাসিক বেতন পরিশোধ করছে না বা অভিভাবকদের আর্থিক দৈন্য দশার কারণে পরিশোধ করতে পারছে না। পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা যে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে, সেই পিইসি পরীক্ষায় দুই লাখের বেশি অংশগ্রহণকারী কমেছে, এমনটা দেখলাম একটা প্রতিবেদনে। মোট হ্রাস পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা যে বিপুল, তা এই একটি দৃষ্টান্ত থেকেই বোঝা যায়।

আমি ব্যক্তিগতভাবে এমন শিক্ষকদের অনেককে চিনি, অনেকের কথা জানি। তাঁরা অনলাইনে শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন এবং মোবাইলের ডেটা কেনার পয়সাটাও বহু কষ্টে জোগাড় করছেন। কারণ, শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার অজুহাতে প্রতিষ্ঠানগুলো বেতন দিচ্ছে না, বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্ধেক বেতন দিচ্ছে, কোনো ক্ষেত্রে নামমাত্র বেতন দিচ্ছে। বহু বেসরকারি বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাদের শিক্ষকরা কে কীভাবে বেঁচে আছেন, কেউ জানে না। অথচ ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে পোশাকমালিকদের জন্য।

কিন্তু বিপুলসংখ্যক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জন্য বেঁচে থাকার ন্যূনতম রসদের জোগান নিয়ে সরকারের কোনো ভাবনা আমরা দেখতে পেয়েছি কি? পেয়েছি। গত বছর তাদের পাঁচ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, এর জন্য সরকার বরাদ্দ করেছিল মাত্র ৪৬ কোটি টাকা! বিপুল, তাই না? এ বছরও তেমনি একটা বড় অঙ্কের বরাদ্দের খবরও আছে।

 

৪.

কেউ কিন্তু রাতারাতি বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার সুপারিশ করছেন না। প্রথমত দেখতে হবে কোভিডের সংক্রমণ একটা জেলা/উপজেলা বা অঞ্চলে কোন স্তরে আছে। এর জন্য দরকার হবে নিরাপদ সময়ে নিয়মিত পরীক্ষা।

দ্বিতীয় স্তরে কাজটা হবে, সংক্রমণ কম থাকা অবস্থায়, সীমিত আকারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া। শিক্ষার্থীদের ভাগ করে একেক দিন একেকটা অংশের জন্য বিদ্যালয় খোলা রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাদের উপস্থিতির সময়ও কমিয়ে আনা যেতে পারে। এভাবে শিক্ষার্থীদের ঘনত্ব হ্রাস করা এবং দীর্ঘ সময় মাস্ক পরে থাকার মতো কঠিন কাজ এড়ানো সম্ভব।

তৃতীয়ত, বিদ্যালয় খোলার সিদ্ধান্ত নিলে সব সুরক্ষা সরঞ্জাম ( যেমন মাস্ক, হাত ধোয়ার উপকরণ ইত্যাদি) নিশ্চিত করতে হবে।

চতুর্থত, জরুরি পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যে শিক্ষার্থীরা কোনো শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন, যেটাতে তাদের সংক্রমণ ঘটলে ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে, তাদের জন্য বিদ্যালয়ে যাওয়ার বিষয়টাকে বাদ দিতে হবে।

পঞ্চমত, কোনো অভিভাবক ঝুঁকিপূর্ণ মনে করলে বিদ্যালয়ে সন্তানকে নাও পাঠাতে পারেন, তেমন সুযোগ রাখা। সে ক্ষেত্রে অনলাইন সম্প্রচারের মাধ্যমে এদেরকে বাকিদের সঙ্গে যুক্ত রাখা সম্ভব।

মনে রাখতে হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বল্প সময়ের জন্য খোলা থাকলে, শিক্ষার্থীরা সঠিক উপায়ে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করে কীভাবে যথাসম্ভব কাজকর্ম করা যায়, সে বিষয়েও ব্যক্তিগত সুরক্ষার প্রশিক্ষণটা বিদ্যালয় থেকে পেতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও অন্যান্য কর্মচারী, বিশেষ প্রশিক্ষণ পেয়ে এটা শিখতে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করতে পারেন। এটা সুশৃঙ্খল জাতি তৈরি করার একটা ভিত্তিও হতে পারে। কিন্তু একটা পরিকল্পনা তো থাকতে হবে। একের পর এক ছুটি ঘোষণা করা ছাড়া, ছুটি বাড়িয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো চিন্তাভাবনা-পরিকল্পনার ছাপ মিলেছে কী?

 

৫.

শুধু একটা কথাই বলতে চাই, কারখানা যখন সরকার খুলে দিয়েছে সব সতর্কবাণী উপেক্ষা করে এবং এর মাধ্যমে করোনার সামাজিক সংক্রমণ বিস্তারের সুযোগ এখন সর্বোচ্চ, তখন শুধু শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে রাখার দরকারটা কী? অবিলম্বে সেগুলো খুলে দিন।

 

লেখক: প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক কর্মী

Link copied!