ইউরেশিয়ায় নতুন কৌশলগত বাস্তবতা স্থাপন করেছে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন। নিজ স্বার্থের জন্য রাশিয়া অনেক দূর যেতেও ইচ্ছুক, এটা স্পষ্ট। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার পিছপা হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। রাশিয়ার পরবর্তী লক্ষ্য কে হবে তা ভেবে মধ্য এশিয়া নিঃশ্বাস ফেলছে আর অপেক্ষা করছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর বর্তমান নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে দুর্বল করতে চায় রাশিয়া। একই সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী শর্ত সংশোধন করে সোভিয়েত ইউনিয়নের হারিয়ে যাওয়া মহান শক্তির মর্যাদা ফিরে পেতে চায় রাশিয়া।
জাতিগতভাবে রুশদের রক্ষা করার জন্য অবশ্যই সামরিক শক্তি ব্যবহার করতে হবে বলে বারবার দাবি করেন ভ্লাদিমির পুতিন। যা রাশিয়ার অন্যান্য প্রতিবেশীদের জন্য, বিশেষ করে মধ্য এশিয়ার সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোর জন্য সতর্কবার্তা। এসব অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য রাশিয়ান ভাষাভাষী বা জাতিগতভাবে রুশ জনসংখ্যা রয়েছে। রাশিয়ার সাবেক গৌরব পুনরুদ্ধারের আকাঙ্ক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞরা এখন দেশটির পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে আন্দাজ করছেন।
অনেকে যুক্তি দেন, রাশিয়া তার দক্ষিণ প্রতিবেশীকে নিকটবর্তী আকর্ষণীয় ও কম ঝুঁকিপূর্ণ লক্ষ্য হিসেবে দেখতে পারে। কাজাখস্তান হতে পারে সোভিয়েত ইউনিয়নের গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য পুতিনের প্রচেষ্টার একটি সম্ভাব্য লক্ষ্য। যাকে (সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন) তিনি বিংশ শতাব্দীর ‘সর্বশ্রেষ্ঠ ভূ-রাজনৈতিক বিপর্যয়’ বলেছেন। প্রাথমিকভাবে রাশিয়ার সঙ্গে উত্তর ও পূর্ব সীমান্তে কেন্দ্রীভূত অঞ্চলে বৃহৎ রাশিয়ান সংখ্যালঘু রয়ছে। যা কাজাখস্তানের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। অধিকন্তু, পুতিন বারবার কাজাখস্তানকে রাশিয়ান বিশ্বের একটি অংশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
ইউক্রেনে আগ্রাসন আশ্চর্যজনক মনে হতে পারে। অনেকে মূল্যায়ন করেছিলেন রাশিয়া সামরিক আক্রমণের অন্তর্নিহিত বিপদ ও খরচ করতে ইচ্ছুক হবে না। যাহোক, বলা হচ্ছিল, রুশ জনগণকে রক্ষা করার জন্য ইউক্রেনের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে। রাশিয়ার প্রতিবেশী, বিশেষ করে কাজাখস্তানের মধ্যে রাশিয়ার স্বদেশী নীতির যথেষ্ট সন্দেহ জাগিয়েছে।
কেবল জাতিগত রাশিয়ানদেরই নয়, সীমানার বাইরে রাশিয়ান ভাষাভাষী ও স্বদেশীদেরও সুরক্ষা দেওয়া কর্তব্য বলে দাবি করে রাশিয়া। সোভিয়েত ইউনিয়নে জন্মগ্রহণকারী যারা এখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল এমন অঞ্চলে বসবাস করে তারা রাশিয়ার ‘বিদেশে স্বদেশী’ আইনের অন্তর্ভুক্ত।
রাশিয়া প্রায়ই কাজাখ সরকারকে জাতিগত কাজাখদের পক্ষে জাতীয় স্তরবিন্যাসের ব্যবস্থা পুনর্গঠনের প্রচেষ্টার জন্য দোষারোপ করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন, কাজাখস্তান যদি শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রী আসখাত আইমাগাম্বেতভের বাস্তবায়িত ভাষাগত নীতি চালিয়ে যেতে থাকে তবে কর্তৃপক্ষ ও রাশিয়ান ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক আস্থা ক্ষুণ্ন হতে পারে। যদি এটি ঘটে থাকে তবে রাশিয়ানদের সুরক্ষা দিতে কথিত সামরিক হস্তক্ষেপ করতে পারেন পুতিন।
ইউক্রেনে আগ্রাসন নিয়ে কাজাখস্তানের প্রতিক্রিয়া দেশটির বর্তমান বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে। কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট কাসিম জোমার্ট টোকায়েভ রাশিয়ান আগ্রাসনের সরাসরি নিন্দা করা থেকে বিরত রয়েছেন। আলোচনার মাধ্যমে ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষার করার জন্য তিনি আহ্বান জানিয়েছেন। টোকায়েভের অধীনে কাজাখস্তান একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য ভালো কাজ করেছে।
টোকায়েভের সরকার মস্কোর প্রত্যাশার চেয়ে বেশি স্বাধীনতা দেখিয়েছে। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে। ইউক্রেনে লড়াইয়ের জন্য কাজাখ সৈন্যদের যোগদান করতে রাশিয়ান অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের মধ্যে নিজেকে দূরে রাখা ও শক্তিশালী মিত্র এবং প্রতিবেশীকে বিরক্ত না করার মধ্যে ভারসাম্য খুঁজছে কাজাখস্তান।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে যেকোনো ‘প্রতিবাদ’ রাশিয়াকে কাজাখস্তানের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সত্যিকার অর্থে আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ দিতে পারে। উত্তর কাজাখস্তানের রাশিয়ান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে যদি অশান্তি বিক্ষোভের সূত্রপাত হয় তবে জাতিগত রাশিয়ানদের সুরক্ষার অজুহাতে হস্তক্ষেপ করার যৌক্তিকতা দেখাতে পারে রাশিয়া।
বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন, কাজাখস্তানে রাশিয়ার আক্রমণ যেকোনো সময় হতে পারে। কারণ কাজাখস্তানের সীমিত সামরিক বাহিনী রাশিয়াকে উল্লেখযোগ্য প্রতিরোধ করতে অক্ষম হবে। ভৌগলিক বাস্তবতা তর্কাতীতভাবে কাজাখস্তান এমনিতেই সুরক্ষিত নয়। ন্যাটো কাজাখস্তানকে সামরিকভাবে সমর্থন করবে, তাও বাস্তব নয়।
আক্রমণের সম্ভাবনা থাকলেও কাজাখস্তানে রাশিয়ার আক্রমণ অসম্ভব বলেও মনে করা হচ্ছে। কারণ ইউক্রেন ও কাজাখস্তানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বৈপরীত্য রয়েছে। ইউক্রেনকে ক্রমবর্ধমানভাবে তথাকথিত ‘রাশিয়ান স্বার্থের’ জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছিল। ক্রিমিয়া ও ইউক্রেনের প্রতীকি এবং ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্য ব্যতীত কাজাখস্তানের ক্ষেত্রে রাশিয়ান চেতনায় তেমন কোনো গতিশীলতা নেই।
গবেষণায় দেখা গেছে, কাজাখস্তানে জাতিগত রাশিয়ান ফেডারেশনের পুনর্বাসিত ভাষাভাষীদের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। তরুণ রাশিয়ান ভাষাভাষীদের মধ্যে কাজাখ ঐতিহ্যের ক্রমবর্ধমান গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। যা ঘনিষ্ঠ আন্ত-জাতিগত যোগাযোগের মাধ্যমে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। টোকায়েভের নীতিগুলো এখন পর্যন্ত রাশিয়ান সংখ্যালঘুদের প্রান্তিকতা এড়াতে সক্ষম হয়েছে।
কাজাখস্তানে জাতিগত রাশিয়ান জনসংখ্যাকে ‘হাইব্রিড’ কার্যকলাপের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করায় রাশিয়ার ক্ষমতা সীমিত বলে মনে হচ্ছে। কারণ জাতিগত রাশিয়ান জনসংখ্যা কাজাখ জাতীয় পরিচয় গ্রহণ করতে ইচ্ছুক।
কাজাখস্তানের গতিশীলতার বিপরীতে রাশিয়ান অর্থনীতি বর্তমানে কঠোর নিষেধাজ্ঞার অধীনে ভুগছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে ভবিষ্যতের যেকোন রুশ সামরিক দুঃসাহসিক অভিযানকে ব্যয়বহুল করে তুলবে। ইতোমধ্যে কাজাখস্তানে প্রধান খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে চীন। প্রধানত মধ্য এশিয়ার গ্যাস ও তেলের গ্রাহক হিসেবে। বর্তমানে চীনের প্রায় ২০ শতাংশ গ্যাস কাজাখস্তান থেকে আসে। বেইজিং দেশটিকে যথেষ্ট ঋণ প্রদান করেছে। কাজাখস্তানের সঙ্গে অনেক যৌথ উদ্যোগ স্থাপন করেছে চীন। যদিও মধ্য এশিয়ায় চীনের উপস্থিতি এই অঞ্চলে রাশিয়ার স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়।
কাজাখস্তানের বিরুদ্ধে যেকোন আক্রমনাত্মক কাজ এই অঞ্চলে চীনা স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ইউক্রেন সংকটের সময় পুতিনের প্রতি চীনের সমর্থনের আলোকে রাশিয়ার জন্য যেকোনো অনুভূত হুমকির চেয়ে খরচ-সুবিধা বিশ্লেষণ চীনা স্বার্থের জন্য বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। যদি না রাশিয়া কাজাখস্তানে নিজ স্বার্থের জন্য একটি অনস্বীকার্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি না হয়, যা বিদ্যমান সীমানাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। পুতিন কাজাখস্তানের বিরুদ্ধে যেকোন আক্রমনাত্মক পদক্ষেপ নিলে আরো সংকটে পড়তে পারেন।
লেখক: প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির নিরাপত্তা অধ্যয়ন বিভাগের পিএইচডি স্কলার, ভারতের সুসজ্জিত পুলিশ অফিসার ও গোয়েন্দা এবং সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে অভিজ্ঞ।
(কলাম স্বত্ব : ন্যশনাল ইন্টারেস্ট। প্রকাশিত তারিখ ১৮ এপ্রিল ২০২২। অনুবাদ : গোলাম আনোয়ার সম্রাট)