• ঢাকা
  • বুধবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অবসরের সীমান্তে পা রেখেও তিনি অনবদ্য


অঘোর মন্ডল
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৭, ২০২২, ০৩:৩০ পিএম
অবসরের সীমান্তে পা রেখেও তিনি অনবদ্য

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে খুব বেশি রোমান্স খোঁজার কিছু নেই। এটা হচ্ছে রক অ্যান্ড রোল। পাওয়ারের পাশবিকতায় রোমান্স ছারখার হয়ে গেছে। শক্তি-টেকনিক্যাল স্কিল আর ফিটনেস—এই ত্রিভুজেই আটকে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট। কিন্তু করোনাকালের বিপিএলে পাওয়ার, টেকনিক্যাল স্কিল কিংবা ফিটনেস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে কোথায়! ফাঁকা গ্যালারি আর স্কোরবোর্ডের সংখ্যাগুলো নীরব সাক্ষী দিচ্ছে; এবারের বিপিএল যেন এক ক্রিকেটীয় রুগ্ন শিল্প। মহামারিকালে যার প্রণোদনা দরকার!
কিন্তু ক্রিকেটাররা যে পরিমাণ টাকাপয়সা পাচ্ছেন, তাতে আর্থিক প্রণোদনার খুব দরকার কি! যা দরকার ছিল তার নাম ক্রিকেটীয় প্রণোদনা। সেটা দিতে পারতেন ক্রিকেট বোর্ড কর্তারা। একটা টুর্নামেন্ট সফল করতে মায়াবী দর্শক চাই। সেটা পাওয়া যাবে না মহামারিকালে, সেটা সবার জানা। কিন্তু তার আগে দরকার মায়াবী ক্রিকেট। কিন্তু বিপিএলে দর্শক উত্তাপ বিচ্ছুরণের কমতি থাকবে, সেটা জানা। কিন্তু ক্রিকেটীয় বিচ্ছুরণের আরও ঘাটতি। সব মিলিয়ে খানিকটা বিপন্ন বিপিএল। ঢাকায় তার বড় কারণ মাঝখানের বাইশ গজ। যেখানে রানের রীতিমতো দুর্ভিক্ষ!
আসলে খেলাটা কতটা উত্তেজক, উচ্চাঙ্গের হবে, তা নির্ভর করে কারা খেলছেন। অনেক নাম আছে। কিন্তু তাদের যা পারফরম্যান্স এখন অবধি, তাতে টি-টোয়েন্টির সেই অ্যাটাকিং ক্রিকেটটা কোথায় দেখলাম! এন্টারটেইনার হিসেবেই-বা কোন ক্রিকেটারকে খুঁজে পেলাম! একশ বা একশর নিচে রান স্কোরবোর্ডে! সেই রান তাড়া করতে গিয়ে প্রতিপক্ষের আবার হাঁসফাঁস অবস্থা! এ রকম ম্যাচ হলে দর্শক হাতে রিমোট নিতে বাধ্য হবেন। তাদের হাতে অনেক অপশন। 
তবে হ্যাঁ, বিপিএলে চড়ে ক্রিকেট স্বর্গ সফর করা সম্ভব নয়। এটা সবাই জানেন। আর বিপিএল কোনো রূপকথার জন্ম দেবে, তা-ও নয়। তবে দু-একজন তারকা ক্রিকেটারের দু-একট চোখধাঁধানো ইনিংস দেখতে চাওয়া কি অন্যায়, যে ইনিংসে সংহার আর কবিতা একই সঙ্গে মিশে থাকবে। তামিম-সাকিব-মুশফিক-লিটন-মাহমুদউল্ল্যাহ কিংবা নাজমুল শান্ত-আফিফ-মিরাজ-সৈকত, যাদের একটা ইনিংস মানুষের মনে হবে মার্ডার এবং পোয়েট্রি! আশায় বুক বাঁধতে পারেন। কিন্তু দেখার সম্ভাবনা খুবই কম। আর টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ফেরিওয়ালা হয়ে যারা বিপিএলে খেলছেন, তাদের ক্রিকেট জীবন অস্তরাগে। মাঝেমধ্যে তাদের মায়াবী কিছু ইনিংস দেখলেও দেখতে পারেন। আসলে ফ্র্যাঞ্চাইজি-শাসিত দুনিয়ায় ওরা এক একটা দলের অলংকার হয়েই এসেছেন। যাওয়ার সময় মোটা অঙ্কের ডলার নিয়ে যাবেন।
কিন্তু ক্রিকেট জীবনের অবসরের সীমান্তে পা রাখা এক ভদ্রলোক কিন্তু দেখালেন, নিজের কাছে ছাড়া অন্যের কাছে তার আর প্রমাণ করার কিছু নেই। বিষণ্ণতা মেশানো একধরনের সমঝোতায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার দাঁড়ি পড়ে গেছে। তারপরও কেন তিনি বিপিএল-মার্কা ঘরোয়া ক্রিকেট খেলছেন কেন! কিছু টাকা আর এন্ডোর্সমেন্ট ঠিক রাখার জন্য! এমন কথা বারবার উঠেছে। আড়ালে-আবডালে অনেকে বলেছেন, জনপ্রতিনিধি হয়েও কেন তিনি একটা তরুণ ছেলের জায়গা আটকে রাখছেন একটা দলে! প্রথম তিন ম্যাচে ঢাকা দলের একাদশে তাকে না দেখে অনেকে আরও চড়া গলায় বলতে শুরু করলেন, আনফিট একটা লোককে ঢাকা কি লাগেজের মতো বয়ে বেড়াবে! না, নিজেদের চতুর্থ ম্যাচেই তিনি একাদশে। ব্যাট হাতে রান নেই। ৫ বলে ২ রান! তিনি জানেন, তার ব্যাপারে প্রশ্ন উঠবে। আরও ভালো জানেন, উত্তরটা কোথায় দিতে হয়। ওই ম্যাচেও ঠিক তাই করলেন। বাইশ গজের চেয়ে ভালো জায়গা আর কোথায় আছে একজন ক্রিকেটারের জন্য। এ ম্যাচেও সেই জায়গাটাকে বেছে নিলেন। ৪ ওভারে ২২ রান দিয়ে ২ উইকেট নিলেন। ম্যাচটা অবশ্য জেতাতে পারলেন না। কিন্তু তিনি দেখালেন, ৪০২ দিন পর ম্যাচ খেলতে নেমেও উইকেট নেওয়ার ক্ষমতায় তার মরচে পড়েনি। তিনি এখনো ব্র্যান্ড। তার ঔজ্জ্বল্য এখনো বেরিয়ে আসে পারফরম্যান্সে। ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ হয়তো এখন গতিতে লোকাল ট্রেনের মতো। কিন্তু সার্ভিসটা ঠিকই দিয়ে যাচ্ছেন। ক্রিকেট মাঠে এখনো তিনি যথেষ্ট ভালো রোল মডেল।
মাশরাফি বিন মুর্তজা টাকার জন্য খেলছেন! তার সমালোচকেরা বললে বলতেই পারেন। কিন্তু একজন পেশাদার ক্রিকেটার যদি পারফর্ম করতে পারেন, তার গ্রহণযোগ্যতা যদি মানুষের কাছে অন্যদের চেয়ে বেশি হয়, ইমেজটা স্বচ্ছ হয়, আর সে জন্য দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলো যদি তাদের পণ্যের মডেল হিসেবে তাকে বেছে নেয়, তাতে দোষের কি! বরং দেশের একজন সংসদ সদস্য হওয়ার পরও তার ক্রিকেটমগ্ন মানসিকতার জন্য কিছুটা প্রশংসার দাবিদার তিনি। তবে মানছি, ফর্মের তুঙ্গে থাকা মাশরাফির ছায়া এখন দিনে দিনে বড় হবে, এটা স্বাভাবিক। 
তারপরও ক্রিকেট প্রেসের কাছে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, বিপিএলের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল অধিনায়ক, যার ক্যাবিনেটে অনেক ট্রফি। তিনি অধিনায়কত্ব ছাড়া এবারের টুর্নামেন্টটা খেলার মোটিভেশনটা পাচ্ছেন কোথায়!
মোটিভেশন! এ দেশের হাজার হাজার ক্রিকেটারের কাছে মোটিভেশনের আরেক নামই তো ম্যাশ।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

Link copied!