মরিয়ম বেগম (৩২) থাকেন নারায়ণগঞ্জে। বিয়ের ১০ বছরেও বাচ্চা হয়নি। তাই সন্তান লাভের আশায় নিয়ত করেছেন ল্যাংটা বাবার মাজারে। সেখানে গিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে মনের বাসনা পূর্ণ করবেন। যেই ভাবা সেই কাজ।
শুক্রবার (১ এপ্রিল) রাত এসে ল্যাংটা বাবার মাজারের সামনে খোলা মাঠে মোমবাতি জ্বালিয়ে ছেলেসন্তানের আশায় মোনাজাত করেন। এমনকি গোলাপজল ছিটানোসহ আগরবাতিও জ্বালাচ্ছেন মানতকারীরা।
বলছিলাম চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলার সাদুল্যাপুর ইউনিয়নের বদরপুরের বেলতলীতে সপ্তাহব্যাপী শুরু হয়েছে হযরত শাহ্ সোলেমান ল্যাংটা পাগলের মেলা।
মরিয়ম বেগম সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আমার বিয়ে হয়েছে ১০ বছর। এত দিন কোনো সন্তান হয়নি। অনেকের মুখে শুনে এখানে এসেছি। শুনেছি, এই ল্যাংটা বাবার মাজারে এলে নাকি নিয়ত পূরণ হয়। আমি ছেলেসন্তান চাইলাম।”
মরিয়ম আরও বলেন, “নিয়ত করে এসেছি। ল্যাংটা বাবার উছিলায় যদি কিছু হয়।”
এদিকে তার মতো অনেকেই দেশের বিভিন্ন জেলা কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, যশোর, নরসিংদী, রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর থেকে সন্তান লাভের আশায় এই মাজারে এসেছেন। দিনে-রাতে সব সময়ই এই মোমবাতি প্রজ্বালন করেন।
লাল মিয়া নামের একজন বলেন, “আমার দুটি মেয়ে ছিল। এরপর কয়েক বছর ছেলেসন্তান হয়নি। এই ল্যাংটা বাবার মাজারে এসে মোমবাতি জ্বালিয়ে ছিলাম। এ কারণে আমার ছেলেসন্তান হয়েছে। তাই প্রতিবছরই আমি এখানে আসি।”
পারভীন বেগম নামের যশোর থেকে আসা একজন বলেন, “এই বাবার মাজারে এলে সব আশা পূরণ হয়। আমার স্বামী পাগলের মতো ছিল। ল্যাংটা বাবার মাজারে এসে মোমবাতি জ্বালিয়েছিলাম। তারপর উনি সুস্থ হয়ে গেছেন।”
এদিকে তরুণরাও মনের বাসনা পূর্ণ করতে এই মাজারে আসেন। তাদের অনেকেই জানান, কেউ পরীক্ষা পাস করার জন্য এসেছেন, আবার কেউ কেউ নিজের পছন্দের মানুষটিকে পাওয়ার জন্য এসেছেন।
স্বপন মিয়া নামের একজন সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “তার সামনে এসএসসি পরীক্ষা। তাই মাজারে মানত পূরণ করার জন্য এসেছেন।”
স্বপন আরও বলেন, “এর আগে যত মানত করে এই মাজারে এসেছেন, তা পূরণ হয়েছে। তাই প্রতিবছর আসেন।”
সরেজমিনে দেখা যায়, যারা মানত করে মোমবাতি জ্বালাচ্ছেন তাদের থেকে টাকা নিচ্ছে ল্যাংটা বাবার ভক্তরা। আবার অনেকের মাথায় গোলাপজল দিয়ে টাকা চাচ্ছেন তারা।
বৃহস্পতিবার (৩১ মার্চ) থেকে শুরু হয়ে আগামী ৫ এপ্রিল মঙ্গলবার পর্যন্ত এই আয়োজন চলার কথা ছিল। তবে আসন্ন রমজান উপলক্ষে শনিবার (২ এপ্রিল) শেষ হবে মেলা।
মাজার সূত্রে জানা যায়, আগামী ৮ এপ্রিল পুরো মাজারকে পানি দিয়ে পরিষ্কার করার মাধ্যমে এবারের কার্যক্রম শেষ হবে। করোনার কারণে গত দুই বছর মেলা অনুষ্ঠিত হয়নি।
শাহ্ সোলায়মান শাহ ল্যাংটার ওফাত দিবস উপলক্ষে ১০৩ বছর ধরে উদযাপিত হয়ে আসছে সাত দিনব্যাপী এই মেলা।
স্থানীয়দের মতে, বেলতলীর বদরপুর গ্রামে সোলেমান শাহ্ নামে এক ফকিরের মাজার আছে। এই মাজারই ‘ল্যাংটা ফকিরের মাজার’ হিসেবে পরিচিত।
কথিত আছে, সোলেমান শাহ্ জীবদ্দশায় এক টুকরো কাপড় দিয়ে লজ্জাস্থান ডেকে রাখতেন বলে, তাকে ল্যাংটা পাগল ডাকত সবাই। নামে ল্যাংটা হলেও আদতে এখানে আসা পাগলেরা কেউই ল্যাংটা নন। তারা ভাবের পাগল। সোলায়মান শাহের জন্মস্থান কুমিল্লা জেলার বর্তমান মেঘনা থানার গোবিন্দপুর ইউনিয়নের আলীপুর গ্রামে। তার বাবার নাম আলা বঙ্গ ভূঁইয়া। জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন মতলবের বদরপুরের এ বেলতলীর তার বোনের বাড়িতে। সেখানে থেকে নারায়ণগঞ্জের বক্তাবলী গ্রামে তিনি বিয়ে করেন। অনেকেই দাবি করেন, তার বংশধর এখনো আছে। তবে সোলেমান শাহ্ কাউকে মুরিদ করেননি।
বাংলা ১৩২৫ সালের ১৭ চৈত্র সোলায়মান শাহ বেলতলীর বদরপুর তার বোনের বাড়িতে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। বাংলা ১৮ চৈত্র তাকে বদরপুরের এই বেলতলীতে (যেখানে মাজার) সেখানে তাকে দাফন করা হয় বলে মাজার পরিচালনায় দায়িত্বে থাকা খাদেম মো. দেলোয়ার হোসেন মোল্লা জানান। তারপর ভক্তরা তার বোনের বাড়িতে মাজার প্রতিষ্ঠা করেন। এর পর থেকেই শুরু হয়ে যায় সপ্তাহব্যাপী ল্যাংটা পাগলের মেলা।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছোট-বড় লঞ্চ, ট্রলার, বাস, মিনিবাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার, অটোরিকশাযোগে ওরশে আসেন কয়েক লাখ মানুষ। একই সঙ্গে তারা নিয়ে আসেন গরু, মহিষ, ছাগল, মোরগ, ডিম, ডাল, চাল, অর্থসহ বিভিন্ন মানতি জিনিসপত্র।
এ বিষয়ে জেলার নওগাঁ রাশেদিয়া ফাজিল মাদ্রাসার সাবেক প্রিন্সিপাল আ ই ম যাকারিয়া চৌধুরী আল মাদানি সংবাদ প্রকাশকে বলেন, ‘‘মাজারে মোমবাতি জ্বালিয়ে সন্তান চাওয়াটা শরিয়তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। কোনো মানুষ কিছু দিতে পারে না; দেওয়ার মালিক আল্লাহ তালাহ্।’’
যাকারিয়া চৌধুরী আল মাদানি আরও বলেন, ‘‘যারা আল্লাহর ওলি, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবে-তাবেয়িন ছিলেন, তাদের উছিলা দিয়ে প্রার্থনা করা যাবে আল্লাহর কাছে। তবে মোমবাতি জ্বালানোর সঙ্গে শরিয়তের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’’
এ সম্পর্কে কথা বলার জন্য মতলব উত্তর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গাজী শরিফুল হাসানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সেটি ধরেননি।