• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বন্যা নিয়ে গুজব, গুজবের ‘বন্যা’


নূর মামুন
প্রকাশিত: জুন ২২, ২০২২, ০৬:০৮ পিএম
বন্যা নিয়ে গুজব, গুজবের ‘বন্যা’

তথ্যপ্রযুক্তির সময়। তাই কোনো কিছু ঘটলে তা মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এতে নানা আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়। এসব ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষ করে ফেসবুকে দ্রুত ছড়াতে তৈরি হয় প্রতিযোগিতা। কার আগে কে দিতে পারে, তা নিয়ে অনেক সময় সত্য ঘটনাটি চাপা পড়ে। আর এতেই তৈরি হয় গুজব।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ কোনো কিছু যাচাই না করেই তা বিশ্বাস করে। এতে তাদেরও তেমন দোষ নেই। কারণ, গুজবগুলো এমনভাবে সাজানো হয়, যা সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়। তবে এখানে সচেতনতার অভাব আছে।

দেশের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি। ওই সব অঞ্চলের পশুপাখি, বন্য প্রাণী বা গৃহপালিত প্রাণীগুলোও পড়েছে বিপাকে। অনেক প্রাণী পানির স্রোতে অন্য অঞ্চলে চলে গেছে বা মরে গেছে। অপর দিকে কোনো উপায় না পেয়ে অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গা নিয়েছে। সেখানে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন গৃহপালিত প্রাণী।

অপর দিকে জঙ্গলে বসবাস করা প্রাণীগুলো বাধ্য হয়ে পানিতে ভাসছে। কোথাও কোথাও এমন চিত্র দেখা গেছে। অনেকেই সেগুলো স্থিরচিত্র বা ভিডিও চিত্রে তা সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করছেন।

সোশ্যাল মিডিয়ার সেই ভিডিও দেখে অনেকেই দুঃখ প্রকাশ করছেন। অন্যদের দেখাতে সেগুলো ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে ছেড়ে দিচ্ছেন। শেয়ারের পাশাপাশি নিজেদের মতো ইমোশনাল লেখা লিখছেন। আর এসব লেখা, ছবি ও ভিডিওগুলো অনেকে যাচাই না করেই সরাসরি শেয়ার করছেন। এ অবস্থায় নিজেদের ভিউ-ফলোয়ার্স বাড়াতে একটি চক্র ধোঁকা দিচ্ছে সাধারণ মানুষকে।

চক্রটি নিজেদের মতো করে সমসাময়িক ইস্যু নিয়ে তৈরি করছে ভিডিও বা অন্যান্য কন্টেন্ট। যেগুলো বর্তমান সময়ের না। কিন্তু সেগুলো এমনভাবে তৈরি করা, যা বর্তমান সময়ের বলেই মনে হয়।

সম্প্রতি দেশে বেশ কয়েকটি ভিডিও ও ছবি ভাইরাল হয়েছে। যেগুলোর কয়েকটি অনেক আগের। কিন্তু তা অনেকেই বুঝতেই পারেননি।

একটি ভিডিওতে দেখা যায়, পানিতে মাঝিবিহীন একটি নৌকা ভাসছে। এতে আরোহী বলতে দুটো বানরছানা। এদের একটিকে আক্রমণ করছে পানিতে ভেসে আসা দুটি কুকুর। কুকুরের আক্রমণ থেকে ছানাকে রক্ষার জন্য প্রাণান্ত লড়াই করছে সঙ্গে থাকা আরেকটি বানর। অনেকেই তাকে ‘মা’ উল্লেখ করেছেন।  

দেশে চলমান ভয়াবহ বন্যার মধ্যে এই ভিডিওটি যারা দেখেছেন, সবাই আবেগতাড়িত হয়েছেন। অনেকে আঁতকে উঠেছেন। অনেকে আক্ষেপ করে বলছেন, “বন্যায় মানুষের জীবনের সঙ্গে সঙ্গে পশুপাখির জীবনেও নেমে এসেছে বিপর্যয়।” কেউ কেউ এই ভিডিওটি না করে বরং বানর দুটিকে বাঁচানোর চেষ্টার ওপর জোর দিচ্ছেন। কেউ কেউ সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসার কথা বলেছেন।
কিন্তু এখানেও ধোঁকা। এই ভিডিওটি নিয়েও গুজব ছড়ানো হয়েছে।

জানা গেছে, ভাইরাল হওয়া ওই ভিডিওটি বর্তমান সময়ের নয়। এমনকি পুরো দৃশ্যায়নটি অভিনয়ের অংশ। ভিডিওতে থাকা দুই কুকুর ও দুই বানর অভিনয় করেছে। যে দুটি বানর এই অভিনয়ে অংশ নিয়েছে, ওদের নাম ‘লোরা’ ও ‘কাকা’। ‘মাঙ্কি ড্রিম’ নামে একটি ফেসবুক পেজে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
পেজে দেখা যায়, এক নারী ওই কুকুর আর বানরগুলোকে সঙ্গে নিয়ে বেশ কয়েকটি ভিডিও তৈরি করেছেন। যার মধ্যে বাংলাদেশে ভাইরাল হওয়া সেই ভিডিওটিও আছে। ৮ মিনিট ২৪ সেকেন্ডের ওই ভিডিওটি গত বছরের ৩ মে সকাল ১০টা ৫৬ মিনিটে আপলোড করা হয়।

বুধবার (২২ জুন) বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ভিডিওটি ৩৩ মিলিয়ন ভিউ হয়েছে। এতে রিঅ্যাক্ট পড়েছে ৬ লাখ ৬৫ হাজারের বেশি। অসংখ্য শেয়ারের পাশাপাশি কমেন্ট পড়েছে ২৮ হাজারের বেশি।

অন্যান্য ভিডিও দেখে বোঝা যায় পেজ পরিচালনা করা ওই নারী একজন প্রাণীপ্রেমী। পেজে দেখা গেলেও ওই নারীর নিজের নাম-পরিচয় কিছু জানা যায়নি। তবে যোগাযোগের যে নম্বর তিনি দিয়ে রেখেছেন, সেটা দেখে আন্দাজ করা যায় তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ কম্বোডিয়ার নাগরিক। তার শারীরিক গঠন ও চেহারাও তার জানান দিয়েছে।

অপর একটি ভিডিওতে জানানো হয়- ফারাক্কা বাঁধ খুলে দেওয়ায় সিলেটের বন্যা হয়েছে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে বাঁধ থেকে পানি বের হচ্ছে। এ তথ্যটিও মিথ্যা। যেটি দেখা যাচ্ছে তা মূলত ভারতের কর্নাটকের হেমাতী নদীর গোরুর বাঁধের স্লুইস গেট খুলে দেওয়ার ভিডিও। সেটি ২০১৯ সালে ধারণ করা হয়েছিল।

এ ছাড়া সম্প্রতি বন্যার পানিতে দুই শিশুকে ভাসতে থাকা একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। ওই ভিডিওটি বর্তমান সময়ের কি না, তা সঠিক ব্যাখ্যা করতে পারেননি কেউ।

এ প্রসঙ্গে মাছরাঙা টিভির বিশেষ প্রতিনিধি ইবতেশাম নাসিম মৌ তার ফেসবুকে লিখেছেন- “ভিডিওটির জিও লোকেশন এখনো পাওয়া যায়নি। তবে ২২ তারিখে আপলোড হয়েছে, এটা ফাইন্ড আউট করা গেছে। আপলোডকারী বা আপলোডকারীরা সিলেটের বলে দাবি করা হয়।”

তিনি আরও লেখেন- “আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিশ্চয়ই এবার রুট খুঁজে বের করে সবাইকে বিষয়টি জানাবে। যাতে কোনো ধরনের ভুল-বোঝাবুঝির অবকাশ না থাকে।”

শুধু এই ঘটনা নয়। এর আগেও বেশ কয়েকটি ঘটনায় গুজব ছড়ানো হয়েছে। এতে কেঁদেছেন অনেকে। বোকাও হয়েছে। বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বড় আতঙ্কের গুজব। এই অবস্থায় আমাদের সবার উচিত সবকিছু জেনেশুনে যাচাই করে তারপর শেয়ার করা।

Link copied!