সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধারণার চেয়েও দ্রুত বদলে যাচ্ছে বাংলা ভাষা। প্রতিনিয়ত বাংলায় যুক্ত হচ্ছে নতুন শব্দ, একই সঙ্গে বিলীন হচ্ছে পুরোনো কিছু। অনেকে সেটা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করলেও ভাষাবিদরা বলছেন ভিন্ন কথা।
বাংলা ভাষার সবচেয়ে আদি নিদর্শন চর্যাপদ। আবিষ্কৃত পুঁথিটিতে ৫০টি চর্যায় মোট ২৪ জন সিদ্ধাচার্যের নাম পাওয়া যায়। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র মতে, ধারণা করা হয় ৯৫০-১২০০ সালের মধ্যে চর্যাগুলো রচনা করা হয়। এই সময়ে এসে ওই চর্যাগুলোর অর্থ বোঝা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, খুব দ্রুতই কি বদলে যাচ্ছে বাংলা ভাষা?
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন আবিদ খান। তিনি তার ছোট ছেলেকে প্রথমেই ইংরেজি বর্ণমালার সঙ্গে পরিচিত করাতে শুরু করেন। সঙ্গে শেখাতে শুরু করেন ইংরেজি শব্দ। বাংলা বাদ দিয়ে প্রথমেই তিনি কেন বিদেশি ভাষা শিখাচ্ছেন?—এমন প্রশ্নে আবিদ নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বলেন, “বর্তমানে ইংরেজি সকল ক্ষেত্রেই দরকার। সেটা চাকরি থেকে শুরু উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত। বাংলা একটু পরে শিখলেও এটা নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই।
এ প্রসঙ্গে লেখক ও চিন্তাবিদ অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান মনে করেন, “এখন যারা মনে করছেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার কল্যাণে ইংরেজি বাংলাদেশের মাতৃভাষা হয়ে উঠবে, আমি মনে করি তারা যে স্বর্গে বাস করছেন, এটাকে বলে ‘অলীক স্বর্গ’। এর ইংরেজি শব্দটি সুন্দর, ‘ইউটোপিয়া’। অর্থাৎ যে জগৎ নাই, সেই জগৎ তারা চিন্তা করছেন। বাংলাদেশের মানুষ নানা সময়ে নানা ইউটোপিয়ায় ভুগেছেন। এই কথাটিকেই আহমদ ছফা আক্রমণ করেছিলেন তাঁর ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রবন্ধে, যেটার নাম দিয়েছিলেন ‘অলৌকিকতার ভূত’।”
এই অধ্যাপক আরো বলেন, “দেশ আজ দুই ভাগে বিভক্ত। অর্থাৎ যারা ইংরেজি জানেন, আর যারা ইংরেজি জানেন না। এই দুই জাতের মধ্যে ভেদ ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে।”
অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, “যারা নিজেরা নিজেদের দাস বানায়, এদের কোনো মুক্তি নাই। পরাজিত হয়ে বন্দি হওয়ার পর দাস করা এক বিষয়। কিন্তু স্বেচ্ছায় যারা দাসত্ব বরণ করে সেই দুর্ভাগা জাতিগুলো মধ্যে বাঙালি পড়ে।”
এদিকে জয় এবং জ্যাকি দম্পতির দুজনেই চাকরিজীবী। তাদের ছোট বাচ্চা নীলকে তাই সারাদিন বাসায় একা থাকতে হয়। তার পছন্দ হিন্দি কার্টুন মটু-পাতলু। সেখান থেকেই হিন্দিতে কথা বলা শিখছে সে। বাবা-মায়ের সঙ্গেও সেই ভাষাতেই কথা বলছে। এ নিয়ে বেশ দুঃশ্চিন্তায় আছেন এই দম্পতি।
এদিকে এখনকার তরুণদের ভেতরেও নতুন নতুন শব্দ ব্যবহার লক্ষ করা যায়। জোশ, ভাল্লাগছে, জটিল, খাইছো, খাবা, গ্যাছো, যাবা, প্যারা লাগতেছে—এমন বিকৃত বাংলার ব্যবহার করে তারা নিজেদের মধ্যে ভাবের আদান প্রদান করে। তাদের কাছে এটা স্মার্টনেসের বহিঃপ্রকাশও।
জিয়ান নামের এক তরুণ বলছিলেন, “নিজেদের ভেতর আমরা নানা ভাষা ব্যবহার করে থাকি। আমাদের নিজস্ব কিছু ভাষা রয়েছে, যা একেবার শুদ্ধ বাংলা শব্দ নয়।”
এভাবে পরিবর্তন ঘটছে ভাষার। তবে এই পরিবর্তনকে শঙ্কার মানতে নারাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আজম। তিনি মনে করেন, ‘‘ভাষার ক্ষেত্রে বিকৃতি কথাটা সাবধানে ব্যবহার করা উচিত। কারণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই ভাষার প্রগতি সাধিত হয়। আসলে নতুন ভাষার জন্ম এভাবেই হয়।’’
ভাষার অনেকগুলো অনানুষ্ঠানিক ব্যবহার রয়েছে বলছেন ঢাবি’র এই অধ্যাপক। তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা সাধারণত দৈনন্দিন, কথ্য এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ভাষা ব্যবহার করে থাকি। দৈনন্দিন ব্যবহারে পরিবর্তন কোনো শঙ্কার বিষয় নয়। অন্যদিকে, লক্ষ রাখতে হবে আনুষ্ঠানিকভাবে এমন ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে কি না? যেমন রেডিও-টেলিভিশনের খবর পাঠে ভাষার ঠিক ব্যবহার হচ্ছে কি না? আমার জানা মতে, টেলিভিশনে শুদ্ধ ভাষার চর্চাই করা হচ্ছে।’’
কোনো একটি ইংরেজি শব্দ যদি মানুষের মুখে প্রচলিত থাকে, তাহলে সেটা নিয়ে কোনো সমস্যা দেখেন না ড. মোহাম্মদ আজম। তার ভাষ্য, “ধরা যাক, ইংরেজি শব্দ মোবাইল, ইন্টারনেট, টেলিভিশন। এসব শব্দ বাংলা ভাষার অভিধানে ঢুকে গিয়েছে। এগুলোকে আমরা ইংরেজি শব্দ বলবো না। তবে কোনো শব্দের লেখার ভাষা যদি বাংলা অভিধানে থাকে, তবে অবশ্যই সেটা বাংলায় ব্যবহার করতে হবে।”
তরুণ প্রজন্মের নিজস্ব ভাষা প্রসঙ্গে মোহাম্মদ আজম বলেন, “মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে ভাষা ব্যবহার করছে, সেটাই তার মুখের ভাষা। ভাষা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটবে। এটা খুবই স্বাভাবিক। এখানে ঠিক-বেঠিকের কোনো প্রশ্ন নেই। শুধুমাত্র একটি লিখিত নিয়মকানুন থাকে। সেটার কিছু বাধাধরা নিয়ম থাকে।’’