• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ঈদের আগে বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট


আবদুল্লাহ আল মামুন
প্রকাশিত: এপ্রিল ৩০, ২০২২, ০৪:২৬ পিএম
ঈদের আগে বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট

রাজধানীর অনেক মুদিদোকানে মিলছে না সয়াবিন তেল। যেসব দোকানে সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে, তা বাড়তি দামে নিতে হচ্ছে ক্রেতাদের। সুযোগ বুঝে ইচ্ছামতো দাম বাড়াচ্ছেন বিক্রেতারা। শুধু রাজধানী নয়, দেশের বিভিন্ন জেলার বাজারেও সয়াবিন তেলের সংকটের খবর পাওয়া গেছে। কয়েক দিন ধরে এ সংকট শুরু হয়েছে, যা এখন প্রকট। ফলে অনেক দোকানে এখন প্রতি লিটার তেলের দাম হাঁকা হচ্ছে ২০০ টাকা পর্যন্ত। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, পরিবেশকদের কাছ থেকে চাহিদা অনুযায়ী ভোজ্যতেল পাচ্ছেন না তারা।

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পাম তেল উৎপাদনকারী দেশ ইন্দোনেশিয়া এই উদ্ভিজ্জ তেল রপ্তানি নিষিদ্ধ করায় বাংলাদেশের বাজারে সয়াবিন তেলের সরবরাহ কমেছে বলে অনেকেই অভিযোগ করছেন।

বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা এখন প্রায় ৩০ লাখ টন। এর সিংহভাগই আমদানি করা হয়। খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, পর্যাপ্ত মজুত থাকার পরও তেল সরবরাহ করছেন না মিলমালিকরা। তারা বলছেন, আমদানিকারকরা বাজারে ভোজ্যতেল সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। তাই বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে, তেলের আমদানি এবং মজুতের বিষয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

বিশ্লেষক ও বাজারসংশ্লিষ্টদের মতে, ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে ভোজ্যতেলের চাহিদা বাড়লেও ঈদের পর চাহিদা কমে যাবে। তখন পরিস্থিতি এখনকার চেয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হতে পারে।

পাশাপাশি তারা অভিযোগ করে বলছেন, বাংলাদেশের রিফাইনারিগুলোতে (শোধনাগার) পর্যাপ্ত তেল মজুত থাকা সত্ত্বেও তারা বাজারে তা সরবরাহ করছে না।

ঈদে ভোজ্যতেলের চাহিদাও বেশি থাকে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। তাদের ভাষ্য, বাংলাদেশে রান্নায় ব্যবহৃত তেলের প্রায় অর্ধেকই পাম তেল, যার ৮০ শতাংশই আসে ইন্দোনেশিয়া থেকে।

সরবরাহ কমিয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছে। বাড়ানো হচ্ছে দাম। খুচরা বাজারে শনিবার প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ২০০ টাকায় বিক্রি হলেও বোতলজাত সয়াবিন একপ্রকার উধাও হয়ে গেছে।

অনেকেই না পেয়ে বাড়তি দরে খোলা তেল নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটি কিনতে ক্রেতাদের আবারও ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। তবে কোনো কোনো এলাকার বাজার ও খুচরা দোকানগুলোতে সয়াবিন তেল খোলা ও বোতলজাত কোনোটিই পাওয়া যাচ্ছে না।

বেলা ১১টায় রাজধানীর মহাখালী কাঁচাবাজার ঘুরে ২ ও ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন পাওয়া যায়নি। প্রায় ১০ থেকে ১২টি দোকান ঘুরে এক লিটারের বোতল পাওয়া গেলেও চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। ক্রেতারা তেল না পেয়ে এক দোকান থেকে অন্য দোকানে ছুটছেন। বাজারে প্রতি লিটার ১৮০ টাকায় পাওয়া গেলেও খোলা তেল পাওয়া যাচ্ছে না।

মো. পারভেজ হোসেন নামের এক বিক্রেতা বলেন, “কয়েক দিন ধরে বাজারে তেলের সংকট বেশি। কোম্পানি আমাদের তেল সরবরাহ না করলে আমরা কোথায় থেকে বিক্রি করব। গতকালও (শুক্রবার) ৫ লিটার তীর তেল ৮৫০ টাকা দরে বিক্রি করেছি। তবু মানুষ কিনছে। আর এখন তো তেলই নেই।”

সাততলা থেকে তেল কিনতে আসা রমিজ মিয়া নামের এক ক্রেতা বলেন, “ঈদ এলেই সবকিছুর দাম বেড়ে যায়। এখন বাজারে তেল খুঁজে পাচ্ছি না। দোকানদাররা বলতেছে, তেল নেই। কোম্পানি নাকি তাদের তেল দিচ্ছে না। এজন্য বাজারে তেল নেই। এই হলো অবস্থা। তাহলে আমরা সাধারণ মানুষ এখন কী করব, দেখার কি কেই নেই?”

দুপুর সাড়ে ১২টায় রাজধানীর নয়াবাজারে গিয়ে একই চিত্র দেখা গেছে। সেখানে ২ ও ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল পুরোপুরি উধাও। এক লিটারের পাওয়া গেলেও খুব কম, নেই বললেই চলে। প্রতি লিটার ১৭০-১৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তবে খোলা তেলের দেখা মেলেনি।

কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের মেসার্স ছিদ্দিক এন্টারপ্রাইজের বিক্রেতা মনির হোসেন বলেন, “সকালে পুষ্টি কোম্পানির গাড়ি এসে ১ লিটার ২৪ পিস, হাফ লিটার ১৬ পিস এবং ২ লিটার ৯ পিস দিয়ে গেছে। আমাদের চাহিদামতো তেল কিনতে পারছি না। বাজারে এখন পুষ্টি কোম্পানি বেশি তেল সরবরাহ করছে। যার প্রতি লিটার ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা এবং ২ লিটার ৩১৮ টাকা। খোলা তেল নেই বাজারে।”

কলাবাগান থেকে ভোজ্যতেল কিনতে আসা সাদেকুল ইসলাম বলেন, “এক ঘণ্টা ধরে খোলা তেল খুঁজতেছি। কোথাও পাচ্ছি না। বোতলজাত তেল ১ লিটার পাচ্ছি। কিন্তু দাম বেশি। বাজারে হঠাৎ তেলের সংকট কেন সেটাতো আমরা ভোক্তারা বলতে পারবো না। দোকানদাররা বলছে, তাদের নাকি কোম্পানি তেল কম দিচ্ছে। বাজারে ৫ লিটার তেল নেই বললেই চলে। শুধু দুইটা কোম্পানির তেল ১ ও ২ লিটার দেখছি। এর মধ্যে কয়েকটা দোকানে ২ লিটার সূর্যমুখী তেল দেখলাম। যার প্রতি লিটার ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা এবং ২ লিটার ৩১৮ টাকা।”

এদিকে দুপুর ২টার দিকে মালিবাগ কাঁচাবাজার ঘুরে বোতলজাত সয়াবিনের তীব্র সংকট দেখা গেছে। জিনজিরা বাজার থেকে পণ্য কিনতে আসা মো. আফজাল হোসেন বলেন, “বোতলজাত সয়াবিন তেল নেই। সামান্য যা আছে বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দরে। এছাড়া খোলা তেলের দাম হু হু করে বাড়ছে। বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা লিটারে।”

বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে হাতে গোনা কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, চলতি বছর ১ মার্চ থেকে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় দুই মাসে সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ৯২ হাজার টন, যা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। একই সময়ে (১ মার্চ-২৮ এপ্রিল) ১ লাখ ৩৭ হাজার টন সয়াবিন তেল বন্দরের কাস্টম বন্ডেড ট্যাংক টার্মিনাল থেকে খালাস করেছে কোম্পানিগুলো।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বৃহস্পতিবারের বাজারদরের তালিকা বলছে, ঢাকার বাজারে এখন খোলা সয়াবিন তেলের প্রতি লিটারের সর্বনিম্ন দর ১৮৪ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগের তুলনায় ২৯ টাকা বেশি। একইভাবে পাম সুপার তেলের দাম লিটারে ২০ টাকা বেড়ে ১৬৫ টাকা হয়েছে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “সরবরাহ সংকট তো আছেই। এদিকে ইন্দোনেশিয়া ভোজ্যতেল রপ্তানি করা বন্ধ করে দিয়েছে। এতে ব্যবসায়ীরা সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাড়তি লাভের চেষ্টা করছে। এটা অনৈতিক কিন্তু বাস্তবতা। যদি দাম বাড়াতে হয়, তবে সরকারের পক্ষ থেকে ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনায় আর কীভাবে সহায়তা দেওয়া যায়, তা পর্যালোচনা করে যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করতে হবে। পাশাপাশি বাজার তদারকি আরও জোরদার করতে হবে। আমরা ভোক্তারা তো জিম্মি। আমাদের তো উৎসব করতে হবে। সেই সুযোগটাই নিচ্ছে একদল ব্যবসায়ী। যারা দাম বৃদ্ধি করছে অনৈতিকভাবে।”

এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান সংবাদ প্রকাশকে জানান, “আজকেও মৌলভীবাজার এলাকায় অভিযান চলছে। ছুটির মধ্যেও আমরা অভিযান চালাচ্ছি। আমরা মিলগুলোতে ২ থেকে ৩ দিন ধরে খোঁজ নিয়েছি। মিলগুলোর সরবরাহ ঠিক আছে।”

এদিকে তেলের দাম ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতায় রাখার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়ার পরও অসাধু চক্র থেমে নেই। সরকারের নির্ধারিত দামে সয়াবিন তেল বিক্রি করছে না। পাশাপাশি নতুন করে দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে। ইতিমধ্যে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কাছে দাম বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছে। অধিদপ্তর সে আবেদন আমলে না নিয়ে ঈদের পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সভা করে সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছে। পরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে দাম বাড়াতে চিঠি দিয়েছে।

মন্ত্রণালয় বলেছে, আমদানি করা তেলের দাম কত হবে, তা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ শুরু করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। ঈদের পর এ ব্যাপারে চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

বাংলাদেশে বছরে ভোজ্যতেল চাহিদা রয়েছে প্রায় ২৫ লাখ টন। মোট চাহিদার ৮০ শতাংশের ওপর আমদানি করতে হয়। ২০২১ সালে পাম অয়েল আমদানি করা হয়েছে ১৩ দশমিক ৫ লাখ টন ও সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ৭ দশমিক ৬ লাখ টন।

জাতীয় বিভাগের আরো খবর

Link copied!